কুতুবদিয়া চ্যানেলজুড়ে চিংড়িপোনা ধরার উৎসব

53

বঙ্গোপসাগরের অংশ বিশেষ কুতুবদিয়া চ্যানেল জুড়ে চলছে চিংড়ি পোনা ধরার মহোৎসব। চিংড়িপোনা আহরণের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির কোটি কোটি রেনু (চিংড়িপোনা) পোনা মাছ। কুতুবদিয়া চ্যানেলের উপকূল ও পেকুয়া, বাঁশখালী, মাতারবাড়ি উপকূলে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মশারি জাল বসিয়ে নির্বিচারে পোনা নিধন করছে। অথচ চিংড়িপোনা ধরার ব্যাপারে সরকারি মৎস্য অধিদপ্তর থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কেউ তা মানছে না। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কুতুবদিয়া চ্যানেলের পেকুয়া উপজেলার মগনামা উপকূলে মশারি জাল বসিয়ে পোনা আহরণের দৃশ্য চোখে পড়ার মতো ছিল।
চিংড়ি পোনা আহরণকারী লেমশীখালী দরবারঘাট এলাকার ছৈয়দ আহমদ জানান, মূলত সাগরে মা চিংড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির মা মাছ বৈশাখ থেকে আষাঢ়- এ তিন মাস উপকূলে এসে ডিম ছাড়ে। তারপর পোনা মাছ কূলের পাশে বড় হতে থাকে। এ অবস্থায় আহরণকারীরা চিংড়ি পোনা ধরার জন্য মশারি জাল বসিয়ে নির্বিচারে বিভিন্ন প্রজাতির পোনা ধরে ধ্বংস করে যাচ্ছে। কিন্তু একটি চিংড়ি পোনা ধরার সময় বিভিন্ন প্রজাতির হাজার হাজার পোনা মারা হচ্ছে যা ভবিষ্যতের জন্য হুমকি।
পেকুয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বেনজির আহমদ জানান, আগামি ২০ মে থেকে ৬৫ দিন সাগরে সকল যান্ত্রিক ও জাল বসিয়ে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। সে সময়েই এসব নেট জাল দিয়ে পোনা ধরা বন্ধ করে দেয়া হবে। পোনা ধরা বন্ধ করার জন্য সেই সময় থেকে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক বিজ্ঞান (ইনস্টিটিউট) বিভাগের শিক্ষক ড. শরীফুজ্জামান বলেন, কুতুবদিয়া উপকূল এবং তৎসংলগ্ন সাগর উপকূলে প্রায় তিন লাখ মানুষ মশারি জাল দিয়ে পোনা মাছ আহরণ করে আসছে। একটি চিংড়ি পোনা ধরার জন্য প্রায় পাঁচ শতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের পোনা মারা হচ্ছে। অনেকাংশে দেখা গেছে দুই-তিনটি মশারি জাল থেকে কয়েকটা চিংড়ি পোনা পাওয়া গেলেও চেনা অচেনা লাখ লাখ সামুদ্রিক মাছের পোনা মেরে ফেলা হচ্ছে। সরকারিভাবে এই পোনা মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞার আইন থাকলেও কার্যতঃ কেউ তা মানছেন না। এ আইন প্রয়োগের জন্য জেলা এবং উপজেলায় মৎস্য অফিস থাকলেও তারা এ ব্যাপারে অমনযোগী।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাসিম আল মাহমুদ বলেন, অবশ্য চিংড়ি পোনা নিধন বন্ধ করার জন্য প্রত্যেক উপকূল এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে চিংড়ি পোনা আহরণকারিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, কুতুবদিয়া উপকূলে পোনা ধরা বন্ধ করা গেলেও পেকুয়া, বাঁশখালী, মাতারবাড়ি উপকূলের পোনা আহরণকারীদের দমন করা যাচ্ছে না। পেকুয়া, বাঁশখালী উপজেলা প্রশাসন তাদের সহযোগিতা করলে প্রত্যেক মাছের প্রজনন মৌসুম বৈশাখ মাস পোনা ধরা বন্ধ করা সম্ভব হতো।
কুতুবদিয়া দ্বীপের উত্তর ধুরুং আকবর বলী ঘাট এলাকায় মশারির জাল দিয়ে পোনা আহরণকারী নাজমুল হক (৩২) জানান, কুতুবদিয়া চ্যানেলে জোয়ারের সময় দুই থেকে তিন শতাধিক চিংড়ি পোনা জালে আটকা পড়ে। এ পোনা প্রতি পিস গড়ে ৪০-৫০ পয়সা বিক্রি করা হয় পাইকারী ক্রেতাদের কাছে। তবে অল্পকিছু চিংড়ি পোনার কারণে নানা প্রজাতির অসংখ্য সামদ্রিক পোনা মারা পড়ছে বলে তিনি শিকার করেন।
দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নের বাতিঘর পাড়া গ্রামের মোসলেহ উদ্দিন (৫৫) বলেন, কুতুবদিয়া দ্বীপের ৬ ইউনিয়নে চিংড়ি পোনা আহরণের জন্য ১৫ জন মহাজন পুঁজি বিনিযোগ করে বিভিন্ন বয়সের মানুষকে পোনা মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করছেন। আহরণকৃত পোনা মহাজনের নিকট ছাড়া অন্য কোথাও বিক্রি করতে পারে না কেউ। তাই মাছ আহরণকারীরা মহাজনের কাছে জিম্মি।
কুতুবদিয়ার ফিশিং ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদিন কোম্পানী বলেন, চিংড়ি পোনা ধরার জন্য মশারি জাল ব্যবহার করা হয় সাগরে। এ সময় কয়েকটি চিংড়ি পোনা ধরা পড়লেও হাজার হাজার বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের পোনা পানিতে না ফেলে বালুচরে আর চরে ফেলে দেওয়া হয়। এ ভাবে পোনা মাছ ধ্বংস করা হলে একদিন সাগর মাছ শূন্য হয়ে পড়বে।
অমজাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হরি মোহন দাশ জানান, বৈশাখ মাসে চিংড়ি পোনা ধরার কাজে যুক্ত থাকায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে গেছে। গত এক মাসে চিংড়ি পোনা ধরার কারণে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি খুব কম ছিল।