কুটুস আর চুচুর গল্প

279

একজন কুটুস, আর অন্যজন চুচু। আমি ওদের এই নামেই ডাকি। আমার দুঃখ-কষ্ট, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা সব কিছুই ওদের দু’জনের সাথে ভাগ হয়। ওদের আনন্দে আমি উচ্ছল হই, আর কষ্ট দেখে মুষড়ে পড়ি। এ রকম আদর আর ভালোবাসায় আমাদের দিন কাটে।
কুটুস হলো একটি কাঠবিড়ালী, আর চুচু ছোট্ট খরগোশ। কুটুস এ গাছ ও গাছ লাফÑঝাঁপ করে উড়ে বেড়ায়। আর চুচু, ছোট্ট খরগোশটা মখমলে সবুজ ঘাসের মাঠে হুটোপুটি করে ছুটে বেড়ায় মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। কী মজা আর আনন্দ ওদের, তাই না?
কাঠবিড়ালী কুটুস- গাছের এ ডাল থেকে ও ডাল উড়ে উড়ে পাকা ফল খায়। আর ছোট খরগোশ চুচু, দৌঁড়Ñঝাঁপ করে ঘাস ফড়িং আর প্রজাপতির পিছু নেয়।
আমি কুটুসের উড়ো-উড়ি দেখি আর অবাক হই। হঠাৎ-ই আমি কাঠবিড়ালী কুটুসকে প্রশ্ন করি, ‘কাঠবিড়ালী পেয়ারা তুমি খাও? গুড় মুড়ি খাও? দুধ ভাত খাও? বাতাবি নেবু লাউ?‘
কুটুস আমায় বলে, ‘না না! আমি ওসব কিছু চাই না! আমি চাই আমার দুনু সোনাকে।’
দুনু সোনা হলো, ওদের ভাষায় ‘দিদিমা’ অর্থাৎ নানী। ওরা দু’জনই দিদিমাকে ‘দুনু’ বলে ডাকে। দুনুকে ওরা দু’জনই খুব ভালোবাসে।
দুনুর প্রতি কুটুসের ভালোবাসা দেখে চুচু ফোঁস করে ওঠে। বলে, ‘দুনু শুধু আমারই।’
বাগিচায় লতানো লতায় হলুদ ঝিঙে ফুলে ছেয়ে গেছে। মিষ্টি কুমড়োর ডগায় অগুনতি ফুল ফুটেছে। দেখে মনে হয় এ যেন কুঞ্জবন। ফুলের মধু নিতে বাগিচায় উড়ে বেড়ায় প্রজাপতি। চুচু তা দেখে এদকি-ওদিক ছুটে যায় প্রজাপতির কাছে। আমি ভাবি, চুচু’র মনে হয়তো প্রশ্ন জেগেছে, ‘প্রজাপতি! প্রজাপতি! কোথায় পেলে ভাই এমনই রঙিন পাথা।’
দোয়েল, শালিক আর চড়–ই পাখিরা ঘাসের বনে খুঁটে খুঁটে কিছু খায়। চুচু ওদের বন্ধু করে নিতে চায়। চুচু ওদের পানে ছুট দিলেই পাখিগুলো ফুড়–ত! চুচু’র মাথায়ও দুষ্টুমি খেলা করে। তখনই দুনুকে মনে পড়ে ওর। ছুটে যায় দুনুর কাছে। এখনও দুনুর কোলের উষ্ণতা চায়। কোলে চড়ে চুচু তখন অনুভব করে হাওয়ার নাচন। এ যেন ওর পরম পাওয়া।
হঠাৎ-ই সকালের সূর্যটা মেঘের আড়ালে মুখ লুকোয়। দুপুর হতেই সূর্যমামার সঙ্গে আর দেখা হয় না। মনে হয় দিনের আলো নিভে গেছে। ঝমঝম বৃষ্টি নামে। কুটুস আর চুচু’র কন্ঠে সুর ভাসে। ওরা নাচতে নাচতে গান ধরে, জধরহ, জধরহ মড় ধধিু! ঈসড়ব ধমধরহ ধহড়ঃযবৎ ফধু!’
আমি সেই মূহুর্তে গেয়ে উঠি, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি। আহা হা হা হা । আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি। আহা হা হা হা!’
ওরা দু’জন নির্বাক হয়ে শোনে। আমি গেয়ে চলি, ‘কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই, কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি। -আহা, হা হা হা !‘
কুটুস আর চুচু হয়তো বাংলায় গাওয়া গানটির পুরোট বুঝতে পারে না।
কারণ ওরা থাকে বাংলাদেশ থেকে অ-নে-ক দূরে। ওদের আবাস অষ্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। কিন্তু তাতে কি! ওরা আমার গানের ভাব বুঝে নেয়।
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর। এখন ওরা কি করবে? চুপচাপ কী বসে থাকা যায়। হঠাৎ-ই চুচ’র কন্ঠে ফোটে সুর। গুঞ্জরিত হয় গানের কলি, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি। আহা হা হা হা।’
ধীরে ধীরে বৃষ্টির ধারা কমে আসে। কিছুক্ষণ পরই কালো মেঘ সরে যায়। বৃষ্টির টুপ-টাপ বন্ধ হয়ে আকাশ ফর্সা হয়।
কুটুস রঙ নিয়ে খেলা করে। বৃষ্টির পর সূর্য রশ্মির ছটায় আকাশে যখন রঙধনু ফোটে তখনই কুটুসের রঙের খেলা শুরু হয়। বেগুনী, নীল, আকাশি, সবুজ হলুদ, কমলা এবং লাল-এই সাতটি রঙে রঙধনু আঁকে কুটুস।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে। ঠিক তখনি , ‘গানের তানে ভেসে, ভেসে সুরের ডানায় অবশেষে, দিন ফুরিয়ে যায়।’
কুটুস ্আর চুচু, ওদের ঘরে ফেরে। দিন শেষে সাঁঝ নামে। ওরা দু’জন তখন সুখ-স্বপ্নে বিভোর।
ওরা ওদের দুষ্টুমি আর খুনসুটিতে আবারো মগ্ন হয়ে যায়। আমিও ওদের সাথে হাত মেলাই। কারণ কাঠবিড়ালী কুটুস আর ছোট্ট খরগোশ চুচু আর কেউ নয়। ওরা আমার নাতনি ‘প্রমিতি’ আর নাতি শৌর্য্য-প্রত্যয়’। আমার ভাবনায় ওরা খেলা করে। ‘আহা কী আনন্দ, আকাশে-বাতাসে।’