কুজনের গুজব ও সামাজিক অস্থিরতার বাস্তবতা

103

একবিংশ শতাব্দীর তথ্য প্রযুক্তির যুগে এসেও আমরা বিশ্বাস করি সেতু নির্মাণে মানব শিশুর মস্তক দেওয়ার অবাস্তব কল্পকাহিনী। পুলিশ প্রশাসন, সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সচেতন মহল হতে এসব অপপ্রচার ও গুজবের বিরুদ্ধে নির্দেশনা প্রদান করা হলেও তাতে কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি বরং আরও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে চোখ পড়লে শুধু নেতিবাচক সংবাদ। আমরা রোহিঙ্গা, সিরিয়া, ফিলিস্তানীদের জন্য কাঁিদ, তীব্র নিন্দা জানায় অথচ আমাদের পাশে পাশবিক নির্যাতনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা নিরপরাদ মানুষগুলোর জন্য আমাদের হৃদয়ে কোমলতা আসে না বরং নিশ্চিত মৃত্যুর ভিডিও মোবাইলে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে কত লাইক বা কমেন্ট পড়লো সেটার হিসাব কষি! কি কঠিন নির্মম বাস্তবতা আমরা এসব মানুষের জন্য একটুও মর্মাহত হই না। তবে কিছু কিছু মানুষের মর্মবাণী শুধু ফেইসবুক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সূত্রমতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গণপিটুনিতে মারা গেছে ৩৬ জন এবং এদের সবাই নিরীহ। জুলাই মাসের ৭ জনসহ মোট ৪৩ জন। আট বছর আগে ২০১১ সালের জুলাই মাসে ঢাকার সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশি গ্রামে ‘ডাকাত সন্দেহে’ গণপিটুনিতে ছয় ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনার আট বছরেও বিচারকাজ শেষ হয়নি। আসামিরা সবাই জামিনে আছেন। গণপিটুনিসহ বিভিন্ন হত্যা মামলাগুলোর বিচার কাজ আলোর মুখ না দেখার ফলে এ ধরণের হত্যাকান্ডের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। আমরা কখনো ফিরিয়ে দিতে পারবো না ছেলেধরা সন্দেহে বাড্ডায় গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম রেনুর প্রাণ, তার মেয়ে তাসমিন এর মা ডাক। দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের হত্যাকান্ড ঘটলেও কোন কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। আমাদের চৌকষ পুলিশ বাহিনী, এতগুলো গোয়েন্দা সংস্থা, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ব্যক্তিগণ কী কোনভাবে এসব কর্মকান্ডের হেতু বের করতে পারছেন না, নাকি আমরা সবাই আস্তে আস্তে এসব পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছি! আমাদের গণতন্ত্র কি নাগরিকদের গণপিটুনি শিক্ষা দিচ্ছে ? সাধারণ মানুষ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াবে কিন্তু সমাধানের পথ কখনো খুঁজে পাবে না এটাই বাস্তবতা।
আইন নিজের হাতে নেওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে অধিকাংশ মানুষ বিচারহীনতাকে দায়ী করছে। বিচারহীনতা সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার কোন শুভ লক্ষণ আপাতত চোখে পড়ছে না। যে দেশে জাহালমদের মত নিরপরাধ মানুষ বছরের পর বছর জেলে থাকে, প্রধান বিচারপতির বিরদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়, যখন দুদক কর্মকর্তা নিজেই দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত এবং ওসি মোয়াজ্জেমরা সমাধানের নামে তামাশা দেখে- সেখানে সাধারণ মানুষের আর কী বলার থাকে। আলোচিত অভিজিৎ, তনু, সাগর-রুনি, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনসহ অসংখ্য হত্যাকান্ড অপরাধীদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। বর্তমান বাস্তবতায় দার্শনিক সলোনের দেওয়া উক্তি পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে-আইন মাকড়শার জালের মত, ক্ষুদ্র কেউ পরলে আটকে যায়, বড়োরা ছিড়ে বেড়িয়ে আসে। ফলে একের পর এক নারকীয় ঘটনা ঘটে চলেছে। আমরা সবাই বলে থাকি সামাজিক অবক্ষয় ও বিচারহীনতার কারণে এসব পাপাচার বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা নিজেদের অবস্থানে কতটা সঠিক। নিজের সন্তান অপরাধ করলে কোন মা বাবা বলবেনা তার সন্তান সত্যি অপরাধী, ঘটনার পর অভিযুক্তদের পিতা-মাতার বক্তব্য শুনে মনে হয়,অন্যর ক্ষতি করতে পারলে তা যেন মা বাবার জন্য গর্বের, আপনার এলাকায় এমন অনেককে খুঁজে পাবেন যারা সন্ত্রাসী ছেলেকে নিয়ে গর্ব করে এবং সেই সন্তানের পিতামাতা হতে পেরে নিজেদের সৌভাগ্যবান ভাবেন। অন্যদিকে কোন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে প্রশ্রয় নিয়ে কেউ হত্যাকান্ড ঘটালে তার দলের শীর্ষ নেতারা সবসময় চেষ্টা করেন অপরাধীকে বাঁচাতে কারণ ওনারা খুব ভালো করেই জানেন গুন্ডা পান্ডাদের লালন পালন না করলে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব না। আমরা মুখে বলতে পারি কিন্তু করতে পারি না। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের গৃহবধুর গণধর্ষণ, ফেনীর নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা,নারায়ণগঞ্জে বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক ২০ এর অধিক ছাত্রী ধর্ষণ, বেহেস্তের দোহায় দিয়ে ছাত্রীদের সাথে মাদ্রাসা শিক্ষকের যৌনতা, কুমিল্লায় বিচারকের এজলাসে হত্যা মামলার বাদীকে চুরিকাঘাতে খুন, রাজধানী ওয়ারিতে ধর্ষণের পর শিশু সায়মাকে হত্যা কিংবা বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যাকান্ড এসব কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মূলত দীর্ঘ সময় ধরে চলা রাজনৈতিক অরাজকতা, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, বিচারহীনতা সর্বোপরি দুর্নীতির আগ্রাসনের কারণে দিন দিন এ ধরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলো বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রের নাটবল্টুগুলোর অবস্থা খুব নড়বড়ে। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগগুলোর কার্য-ক্ষমতার সমন্বয় না থাকলে যেকোন দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার অবনতি হয়। আর এই অরাজক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির মানুষ অদ্ভূদ কিছু ঘটনার জন্ম দিচ্ছে-সম্প্রতি গুজব ছড়িয়ে গলাকাটা ও ছেলেধরা সন্দেহে হত্যাকান্ড, সংখ্যালগু ইস্যু নিয়ে দেশকে বলি দিয়ে আমিরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে প্রিয়ার সাহার অবাস্তব অভিযোগই প্রমাণ করে আমরা কতটা নিচে নেমেগেছি।
দেশে এখন কোন ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক টিভি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজে প্রচার করা হয় এ ব্যাপারে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। প্রশ্ন হচ্ছে সব বিষয়ে যদি প্রধানমন্ত্রীকে চিন্তা করতে হয় তাহলে বাকীদের কাজ কী? এটা মাথায় রাখতে হবে প্রধানমন্ত্রীর একার দেশপ্রেম দিয়ে দেশের কাঙ্খিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা যদি প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগকে নৈতিকতা ও সততা দিয়ে সহযোগিতা না করি তাহলে কখনোই দেশে পরিবর্তন আসবে না। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবার অংশগ্রহণ অবিচ্ছদ্য। আমরা যতক্ষণ না নিজেরা শুদ্ধ হচ্ছি ততক্ষণ দেশে ভালো কিছু আশা করা বোকামী। আমরা প্রতিনিয়ত শুনছি অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দেশ অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছরের মধ্যে দেশে কোন বেকার থাকবে না, কেউ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে না, নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ হবে, চিকিৎসায় বিদেশ নির্ভরতা কমবে, কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে সবল হবে আরও কতশত কথা। অথচ একবার ভেবে দেখুনতো দেশের কোন সেক্টরটি আপনার মনের প্রশান্তি জুগিয়েছে-সাধারণ মানুষের উত্তরে কোন ইতিবাচক মন্তব্য আসবে না এটা নিশ্চিত। চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল যাবেন সেখানে অস্থিরতা, বিচারের জন্য আদালতে যাবেন সেখানে দীর্ঘসূত্রতা, সাহায্যের জন্য পুলিশের কাছে যাবেন পড়বেন চাঁদাবাজির খপ্পরে, নিজের ভিটেমাটি রক্ষায় ভূমি অফিসে যান সেখানেও হয়রানীর শিকার হবেন। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকারি চাকুরীজীবীদের বেতন দ্বিগুনের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি করেছেন। যাতে অতিরিক্ত অর্থের লোভে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সাধারণ মানুষকে সেবা থেকে বঞ্চিত না করে। তবুও বদলায়নি আমাদের চিরচেনা রূপ। পুরো ব্যাংক ব্যবস্থা ঋণ খেলাপীদের পেটে, শেয়ার বাজারে ধ্বস, বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, নতুন করের বোঝা, নিয়ন্ত্রণহীন সড়ক ব্যবস্থা সব মিলেমিশে দুর্বিষহ জীবন। সাধারণ মানুষের শান্তি কোথায় বলতে পারেন? মনে করতে পারছেন না। ঘরে, স্কুলে, অফিসে কোথাও কি মানুষের নিরাপত্তা আছে? এখন শিক্ষক হচ্ছেন ধর্ষক আর রক্ষক হচ্ছে ভক্ষক। তবে সব প্রতিষ্ঠানে হচ্ছে তা কিন্তু না তবুও ঘটে যাওয়া বিভৎস ঘটনাগুলো কারণে সবখানে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলোর জন্য আমরা কখনো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়া, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, দুর্নীতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবসহ নানা বিষয়কে দায়ী করছি। কিন্তু সমাধান কিভাবে হবে সেই বিষয়ে সবার সম্মিলিত আন্তরিক কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। ঘটনা ঘটার দু‘চারদিন পর্যন্ত তা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হয় কিন্তু নতুন আরেকটি ঘটনায় পুরানো ঘটনা চাপা পড়ে যায়। ঘুণে ধরা সমাজ নিয়ে ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র কথা, ‘যে দেশে গুণের সমাদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না। বাস্তবে আমাদের দেশেও একই অবস্থা। আমরা এখন মানুষকে মূল্যায়ন করি টাকা দিয়ে। সুশিক্ষা,সততা ও দেশপ্রেম এসব শব্দ গ্রন্থে থাকলেও বাস্তবতায় চোখে পড়ে না। যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ পরিবার ও শিক্ষাঙ্গন জাতি গঠনে কাজ করে সেই দুটি প্রতিষ্ঠানে চরম অস্থিরতা কাজ করছে । শিক্ষা আর এখন সমাজ সংস্কারে কাজে আসে না বরং তা ব্যক্তি স্বার্থ অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার। সমাজের সবচেয়ে আদি সংগঠন পরিবার, অথচ আমাদের বর্তমান প্রজন্ম কী শিক্ষা পাচ্ছে পরিবার থেকে। আমরা এখন নিজেরাই নিজেদের বিশ্বাস করতে পারি না, অপরকে কি করে বিশ্বাস করবো। নৈতিক অধঃপতন আমাদের বিবেক ও জ্ঞানকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
কোন ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা না ভেবে সরকারের উচিত এর মূল উদঘাটন করে অপরাধী যে হোক না কেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। ক্রসফায়ার নয় বরং অপরাধের শেকড় বের করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজকে সুন্দর করতে হবে। মাদক, জঙ্গি, দুর্নীতি ও ধর্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযানকে ব্যর্থ করতে কোন কুচক্রী মহল ছেলে ধরার মত নতুন নতুন ইস্যু সৃষ্টিকে করে দেশকে অস্থিতিশীল করে দিচ্ছে কিনা তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। সমাজের সংস্কার প্রয়োজন, সঠিক পরিচর্যার অভাবে সমাজের অস্থিমজ্জায় ঘুনপোঁকা বাসা বেঁেধছে। স্বার্থপরতা, সুবিধাভোগী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে দেশকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আর এ দায়িত্ব কারো একার নয় বরং আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সমাধানের পথ খুঁজে বের করে আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাস গড়াই হবে মূল লক্ষ্য।
আমরাও স্বপ্ন দেখি কোন একদিন আমাদের দেশে অপরাধীর সংখ্যা শূন্যের কোটায় নেমে নেদারল্যান্ডের মত কারাগারগুলো বন্ধ হয়ে যাবে কিংবা শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত হয়ে ফিনল্যান্ডের মত বিশ্বের সেরা সুখী দেশ । সেইদিন শিক্ষকরা হবেন জাতি গড়ার কারিগর, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সত্যিকারের হবেন সেবক,রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে বেরিয়ে আসবে যোগ্য শাসক এবং সাধারণ মানুষ হবেন দেশ প্রেমিক। তখন আর থাকবেনা কুজনের গুজব ও সামাজিক অস্থিরতা, সেই দিন থেকে শুরু হবে আত্মসুখের দিনলিপি…..

লেখক : সহকারি পরিচালক (উপাচার্য’র কার্যালয় ও জনসংযোগ)
সাদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
ঊ-সধরষ:-ংধরফসঁহহধ০৭@মসধরষ.পড়স