কীভাবে মারা গেল সেই ডলফিনগুলো?

43

বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসে কারণে গত তিন সপ্তাহ ধরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ভ্রমণ নিষিদ্ধ রয়েছে। একইসঙ্গে মাছধরার নৌকা বা ট্রলার প্রবেশও নিষিদ্ধ। সাগরের প্রকৃতির নির্জনতায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে হঠাৎ দেখা মেলে একদল ডলফিনের। কিন্তু গত ২৩ মার্চ দুপুরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী পয়েন্টে ১০ থেকে ১২টিরও বেশি ডলফিনের একটি দল উপকূলের খুব কাছাকাছি চলে আসলে স্থানীয়রা এসব ডলফিনের খেলা করার দৃশ্যটি ভিডিও করেন। সাগর উপকূল থেকে কিছু দূরে এসব ডলফিনে ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য ফেসবুকে ভাইরাল হয়। তবে এরপর আর দেখা যায়নি সেই ডলফিনগুলোকে। কয়েকদিন পর সৈকতে ভেসে আসে ডলফিনের মৃতদেহ।
গত ৩ ও ৪ এপ্রিল টেকনাফ উপকূলে ভেসে আসে অন্তত দুটি ডলফিনের মৃতদেহ। স্থানীয়রা বলছেন অন্যান্য সৈকতে আরও কয়েকটি মৃত ডলফিন সৈকতে দেখেছেন তারা। তবে কয়টি ডলফিন মারা গেছে এবং কীভাবে এগুলোর মৃত্যু হলো তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ১০ থেকে ১২টি ডলফিন মারা গেছে এবং স্থানীয় জেলারা এগুলোকে জালে ফেলে পিটিয়ে হত্যা করেছে। তবে মৎস্য কর্মকর্তারা দাবি করছেন, একটি ডলফিনের লাশ পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, এই ডলফিনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে, অথবা এটি আত্মহত্যাও করে থাকতে পারে। কক্সবাজার সাগরে ভেসে আসা মৃত ডলফিনটি ‘আত্মহত্যা’ করতে পারে বলে ধারণা করছেন কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম খালেকুজ্জামান। তিনি বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজার সাগরে ১২টি নয়, শুধু একটি ডলফিনের মৃতদেহ ভেসে এসেছে। ওই ডলফিনটির মৃতদেহ ময়নাতদন্ত হয়েছে। তবে এখনও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে আসেনি। প্রতিবেদন পেলে বিস্তারিত জানা যাবে। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
এস এম খালেকুজ্জামান বলেন, গত সপ্তাহে টেকনাফ শামলাপুরে সমুদ্র সৈকতে একটি ডলফিনের মৃতদেহ ভেসে আসে। খবর পেয়ে আমরা দ্রুত মৃত ডলফিনটি মৎস্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণে নেই। ময়নাতদন্ত শেষে এটিকে সমাহিত করা হয়েছে। এই পর্যন্ত আর কোনও ডলফিনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, পৃথিবীতে যত প্রাণি রয়েছে এর মধ্যে মানুষ, বানর ও ডলফিন বুদ্ধিমান। এই তিনটি প্রাণীর বুদ্ধি বেশি এবং জাগতিক বিষয় সম্পর্কে তারা ধারণা লাভ করে। শান্ত প্রকৃতির এই নিরহ প্রাণি ডলফিন কারও ক্ষতি করে না। ডলফিন এমন একটি নিরীহ প্রাণি। সাগরে কোনোভাবে জালে আটকা পড়লে তিন ঘণ্টার অধিক সময় পার হলে মারা যেতে পারে। আবার নির্দিষ্ট সময়ে যন্ত্রণা ভোগ করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে পারে। হার্টব্লক হয়েও মারা যেতে পারে। বয়সের কারণে মারা যেতে পারে এবং আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা যেতে পারে। তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে জানা যাবে ওই ডলফিনের কেন ও কীভাবে মৃত্যু হয়েছে।
তবে এই কর্মকর্তার যুক্তি উড়িয়ে দিয়েছেন স্থানীয় পরিবেশবাদিরা। তারা বলছেন, সাগরে একের পর এক ডলফিন মারা যাচ্ছে জেলেদের জালে আটকা পড়ে। অশিক্ষিত ও অসচেতন জেলেরা সাগরে মাছ ধরার সময় জালে আটকা পড়লেই ডলফিনকে পিটিয়ে মারছে।
জানতে চাইলে কক্সবাজারের স্বেচ্চাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলসের প্রধান নির্বাহী রাশেদুর মজিদ বলেন, আমাদের হাতে তথ্য রয়েছে যে সাম্প্রতিক সময়ে ১০ থেকে ১২টি ডলফিনকে পিঠিয়ে হত্যা করেছে জেলেরা। ডলফিনগুলো জেলেদের জালে আটকা পড়ে। এর পর জাল বাঁচাতে ডলফিনগুলোকে হত্যা করা হয়। এই রকম টেকনাফ, ইনানী ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ভেসে এসেছে ডলফিন। তাদের শরীরে আঘাতে চিহ্ন রয়েছে।
কক্সবাজার পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু বলেন, সাগরে ডলফিনগুলো বাঁচাতে হলে জেলেদের প্রশিক্ষণের কোনও বিকল্প নেই। জেলেদের বোঝাতে হবে যে মাছ ধরার সময় যদি কোনও ডলফিন জালে আটকা পড়ে, তাহলে দ্রুত সময়ে ডলফিন গুলোকে উদ্ধার করে সাগরে ছেড়ে দিতে হবে। তা নাহলে কক্সবাজার বঙ্গোপসাগর চ্যানেলে যে সমস্ত ডলফিন দেখা যায় তা এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বায়োলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ মুহাম্মদ শরীফ বলেন, ডলফিন হচ্ছে মূলত স্তন্যপায়ী প্রাণি। এরা বাতাসের অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকে। মাছের মতো বেশিক্ষণ পানির নিচে ডুব দিয়ে থাকতে পারে না। পানির উপরিভাগে ডলফিনের বিচরণ। স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানি পছন্দ করে। যেহেতু ডলফিন পানির উপরিভাগের প্রাণি, সেহেতু জেলেদের জালে আটকা পড়ার আশঙ্কা বেশি। যদি কোন কারণে জালে আটক পড়ে তাহলে ডলফিনকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়াও কিছু লোভী জেলে তাদের হত্যা করে। কারণ, ডলফিনের পাখনা ওষুধ এবং খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে। আমি এই পর্যন্ত যতগুলো মৃত ডলফিন দেখেছি, বেশিরভাগ ডলফিনের পাখনা কাটা। মোদ্দা কথা হচ্ছে, ডলফিন মানুষের মতো অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারে না। তাদের কিছুক্ষণ পরপর পানির উপরিভাগে এসে অক্সিজেন সংগ্রহ করতে হয়। যদি অক্সিজেনের কোনও অভাব হয় তাহলে নির্ঘাত ডলফিন মারা যাবে।
বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের সামুদ্রিক শাখার উপপ্রধান ড. মোহাম্মদ আব্দুল আলীম বলেন, কক্সবাজার সৈকতে মৃত ডলফিন ভেসে আসার খবর আমি পেয়েছি। তবে আমার মনে হয়, জেলেরা এত নিষ্ঠুর নয় যে ডলফিন হত্যা করবে। কারণ, ডলফিন সাগরে কারও ক্ষতি করে না। বিশেষ করে জেলেদের মধ্যে প্রচলন রয়েছে ডলফিন খুব উপকারি প্রাণি। কোনও দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে এবং জেলেদের বিপদে ডলফিনরা সতর্ক করে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে জেলেরা ডলফিন হত্যা করবে বলে মনে হয় না। তবে ইঞ্জিলচালিত বোট বা ট্রলারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েও এসব প্রাণির মৃত্যু হতে পারে। এই মুহূর্তে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কিছু মন্তব্য করা কঠিন।