কিশোর মুক্তিযোদ্ধার গল্প

159

(পূর্ব প্রকাশের পর)
শহরে আসার তিনদিনের মাথায় একদিন বিকেলে বাবা এসে তার চাকরির সংবাদ দেয়। সঙ্গে ‘ডান্ডি’ কার্ড পাবার কথাও।
বাবার শহরের আসার মিশন আস্তে আস্তে সাকসেসফুল হতে থাকলো। প্রথম কারণ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। অর্থাৎ চাকরি। বাবা জানতো যেভাবে হোক মালিকের কাছে গেলে বাবার চাকরি হবে। মালিক যদিও বিহারী তারপরও বাবাকে অনেক পছন্দ করতো। দীর্ঘ চাকরি জীবনে বাবা কখনো অকারণে ছুটি ভোগ করেনি। সততা, ছিলো বাবার মধ্যে অন্য আরেকগুণ। বাবা কোনদিন অসততাকে প্রশ্রয় দেয়নি। তাছাড়া বিহারীদের মধ্যে ভালো খারাপ আছে। বাবার মালিকটা ছিলো ভালো দলের। বাবার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য মালিকের মাধ্যমে জামাই বাবুর খবর নেয়া। ঠিক ঠিক একদিন বাবা খবর আনেন জামাই বাবু বেঁচে আছেন। বাবার মালিক এক পাকিস্তানি মেজরের মাধ্যমে এই খবরটা সংগ্রহ করেন। বাবা একদিন দেখাও করতে যান। সাত রাস্তার মোড়ে রেলওয়ের অফিস। পাকিস্তানি ও রাজাকারদের টর্চার সেল। পারতপক্ষে কেউ এই রাস্তা মাড়ায় না। কারণ ওই টর্চার সেল থেকে সারাক্ষণ কান্না, চিৎকার, চ্যাঁচামেচির শব্দ। রাজাকার, আলবদর, আল শামস্রা বাঙালি ধরে ধরে এনে এই টর্চার সেলে নির্যাতন করে। সেই নির্যাতনের করুণ কাহিনি লোকমুখে অনেক শোনা যায়। জামাই বাবুকে দেখে বাবা চিনতে পারছিলো না। মুখে ইয়া বড় বড় দাঁড়ি গজিয়েছে। চোখগুলো ভেতরে ঢুকে আছে। শরীর কংকালসার। লোহার দরজার এক পাশে বাবা, অন্য পাশে জামাই বাবু। দুজনের চোখে পানি। দুইজন এগিয়ে গিয়ে হাতের আঙুলের সাথে আঙুল মেলায়। বাবা তখন জানতে পারেন জামাই বাবুকে দুই দুই বার ইলেকট্রিক চেয়ারে বসে সক্ দিয়েছে। এখানে একটি ইলেকট্রিক চেয়ার বসানো আছে। বাঙালিদের ওখানে বসিয়ে সক্ দেয়। আর মুক্তিবাহিনির কথা জানতে চায়। ভাগ্য খারাপ থাকলে ওই চেয়ার থেকে কেউ উঠে আসতে পারে না। সক্ দিতে দিতে মেরে ফেলে। কিন্তু জামাই বাবুকে দুই দুইবার চেয়ারে বসিয়ে মারেনি। সে কারণ জামাই বাবুও জানে না। দু’জনের চোখ জলে ভাসতে ভাসতে কথা বিনিময় হচ্ছে। বেশিক্ষণ কথা বলতে দেয়নি। একজন সিপাহি এসে জামাই বাবুকে নিয়ে যায়। এসব কথা বাবা যখন বাড়িতে বলছিলোÑ তখন সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ে। তবুও এইটুকু সান্ত¡না জামাইবাবু বেঁচে আছেন। আমার ভেতর আরো জেদ জমা হতে থাকে।
কিছুদিন পর জামাই বাবু ছাড়া পায়। মুখভর্তি বড় বড় দাঁড়ি গজিয়েছে। প্রথম দেখায় চিনতে পারিনি। বাবা অনেক দৌড়াদৌড়ি করে জামাই বাবুকে ছাড়িয়ে এনেছেন। বাড়িতে খুশির বদলে কয়েকপশলা কান্না পর্ব চলে। জামাই বাবু টানা একমাস ঘর থেকে বের হননি। ভয়ে সবসময় আচ্ছন্ন। বাড়িতে কারো সঙ্গে তেমন কথা বলেন না। ঘরের এককোণে বসে কি যেন লেখেন। দিদি ছাড়া কেউ উনার কাছে যান না। আর যান পাড়ার সুরেশ কবিরাজ। এই বাসায় আসার পর থেকে কবিরাজ মশাই উনার চিকিৎসা করছেন।
হঠাৎ একদিন বাবা আমাকে রিয়াজ উদ্দিন বাজারে নিয়ে গেলো। অনেক বড় বাজার সম্ভবত দেশের সবচেয়ে বড়। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। বাবা কেন আমাকে রিয়াজউদ্দিন বাজারে নিয়ে এলো। বড় একটা মুদির দোকানে ঢুকে ক্যাশে বসা সওদাগরের সাথে বাবা কথা বলছে। দেখলে বুঝা যায় সওদাগর বাবার পূর্ব পরিচিত। আমি দোকানের বাইরে দাঁড়ানো। মিনিট কয় পর বাবা আমার হাত ধরে উনার কাছে নিয়ে গেলেন। সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত চাকরি। দোকানের সামনে রাখা মালামাল পাহারা দেয়া ও ফাই ফরমায়েস খাটা। বেতন দৈনিক আট আনা। আমার বেশ খুশি খুশি লাগছিলো। প্রথমত: চাকরির পয়সা মায়ের হাতে তুলে দিতে পারবো। দ্বিতীয়ত: চারটার পর একটু এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করা যাবে। এতোদিন বাসার বাইরে গেলে সবাই বারণ করতো। কারণ পাড়ায় প্রায় বাড়িই বিহারীরা দখল নিয়েছে। বিহারী ছেলেদের সাথে মিশতে গিয়ে কখন কি বিপদ হয় আশংকায় বড়রা আমাকে বের হতে দিতো না। সম্ভবত এই কারণে আমাকে চাকরিতে ঢোকানো। আমার চাকরির স্থল ও বাসার দূরত্ব যদিও বেশি না। তবুও একটু ঘুরে যেতে হয়। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের অন্য পাড়ে রিয়াজউদ্দিন বাজার, এই পাড়ে আমাদের বাসা।
দোকানে আরো একটা ছেলে আছে। ও আমাকে এটা ওটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। কাস্টমার আসলে কি করতে হবে বা সামনে দাঁড়িয়ে থেকে কিভাবে মালামালের উপর চোখ রাখতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক ব্যাপার স্যাপার। আমি কিছু না বলে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে যাচ্ছিলাম। তাছাড়া একদিনে সব বুঝাও কি সম্ভব? তবে এটুকু বুঝলাম ওই আমাকে কাজ শেখাবে। ও যা বলবে সেভাবে কাজ করতে হবে। আমি খুব উৎসাহ নিয়ে চাকরি জীবন শুরু করলাম। যে ছেলেটার কথা বলছিলাম ওর নাম হচ্ছে মাহবুব। বয়সে আমার চাইতে কয়েক বছরের বড় হবে। প্রথম দেখাতে ওকে আমার খুব ভালো লেগে যায়। একটি লাঠি সদৃশ্য, লাঠির আগায় ছোট ছোট চিকন লম্বা জাতীয় বাঁধা, আমার হাতে দেয় মাহবুব। সামনে রাখা সেমাইয়ের টুকরির ওপর ওই লাঠি নড়াচাড়া করা। মাছি তাড়ানো। কিছুক্ষণ পর পর এই কাজটা করে যাওয়া। দোকানের সওদাগরকে দেখে ভালো মনে হলো। একখানা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে চতুরদিকে দেখছে, পেটটা একটু বেশি মোটা, মনে হলো। কাস্টমার থেকে টাকা নিতে গিয়ে ক্যাশবাক্স খুলতে গেলে পেটে গিয়ে বাজছে। আমার মনে হয় সব সওদাগরের পেটমোটা। পেটের মধ্যে সব টাকার বান্ডিল। ঠিক তিনটের দিকে সওদাগর হাত ইশারায় আমাকে ডাকলো। হাতে আট আনা দিয়ে বললো যাও আজ প্রথমদিন, ছুটি। আমি খুশিতে কি বলবো বুঝতে পারছি না। জীবনের প্রথম কামাইয়ের পয়সা। পয়সাটা হাতে নিয়ে সওদাগরের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। উনি লজ্জা পেয়ে না না করছিলেন। আমি নাছোড়বান্দা। মাহাবুবের কাজ থেকে চোখ বিনিময় করে দোকান থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম। এবার আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশ ধব ধবে সাদা তুলোয় ভরা। মনটা আরো ভরে গেলো। আস্তে আস্তে কয়েকপা এগিয়ে সামনে থাকা মাছের বাজারে ঢুকলাম। চার আনা দিয়ে একটা আস্ত ইলিশ মাছ কিনে বাসার দিকে যাত্রা করলাম। মা আমাকে দেখে অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। মাকে ইলিশটা দিয়ে বাকি চার আনা হাতে দিলাম। মা হয়তো ভাবতে পারেননি, আমার এইসব কর্ম।
চাকরির পঞ্চম দিন। প্রতিদিনের মতো আমি আমার কাজ করছি। হঠাৎ কোত্থেকে চারজন পাকিস্তানি আর্মি এসে দোকানে ঢোকে, কি যেন চাচ্ছে। না বলাতে ফিরে যাবার মুহূর্তে আমিও পাশে ছিলাম। এক মিলিটারির বুটের তলায় আমায় পায়ের বুড়ো আঙুল তেঁতলে যায়। মাগো বলে চিৎকার দিলাম। ওদের ভেতর কোন ভাবান্তর দেখতে পেলাম না। ফিরে দেখলো, গমগমিয়া হাটা শুরু করলো। ওদের মধ্যে কোন অনুশোচনা দেখলাম না। মাহবুব দৌড়ে এসে আঙুল চেপে ধরে। রক্ত কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। আমাকে কাঁধে নিয়ে কাছে থাকা একটা ফার্মেসিতে নেয়। মুখে জমে থাকা থু থু ওয়াক করে পাকিস্তানি মিলিটারীদের দিকে ফেললাম।
যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করছি। দোকানের লোকটা সাদা তুলোয় কি যেন দিয়ে আঙুলের চারদিকটা পরিষ্কার করছে। আমার যন্ত্রণা আরো বেড়ে গেলো। সাদা কাপড়ের ব্যান্ডেজ আমার আঙুলে। আমি যখন যন্ত্রণায় উহ্ আহ্ করছিলাম। মাহবুবের মুখের চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট দেখছিলাম। ওর প্রতি আমার ভালোবাসা বেড়ে গেলো। ব্যান্ডেজ সমেত দোকানে আসার সাথে সাথে সওদাগর আমাকে ছুটি দিয়ে দিলো। সঙ্গে দু’খানা আধুলি। আঙুলের ব্যাথা একটু কমবে। বাসায় যাওয়া হবে না। নিউ মার্কেটের আশপাশটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে জাগলো। অন্য সময় বাসায় বললে না বলতো, এখন আমি চাকরি করি। তাই অনেকটা স্বাধীন।
নিউ মার্কেটে ঢুকতে যাবো অমনি একজনের সঙ্গে চোখাচোখি। কিছুক্ষণ তাকালাম লোকটাও আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। দুজন দু’জনকে চিনতে পারি। মুখ দিয়ে কেউ শব্দ করলাম না।
(চলবে)