কিশোর মুক্তিযোদ্ধার গল্প

164

(পূর্ব প্রকাশের পর)
শরীরের কোথাও গুলি লেগেছে। হারান জানে হেমন্ত মামা গ্রামের এক নির্ভেজাল মানুষ। কারো সাথে কোনদিন দুকথা হয়েছে কেউ বলতে পারবে না। জল, জল বলে মুখ দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে। হারান কি করবে বুঝতে পারে না। এতোটুকুন বয়স। তাও দৌড়ে কাছের পুকুর থেকে দুই হাত একত্রিত করে জল ভরে। হেমন্ত মামার কাছে আসতে আসতে দুই হাতের আঙুল গড়িয়ে জল পড়ে যেটুকু ছিলো তা এনে মুখের উপর ধরে। মুখে জল পড়তেই বিড় বিড় করে কি যেন বলতে চাইলো। হারান বুঝতে পারে না। এক সময় দুই চোখের পাতা এক হয়ে মুখটা একদিকে কাত হয়ে পড়ে। মৃত্যু, হারান এই প্রথম দেখেছে। চিৎকার করে কান্নার করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না। অনেক দূর থেকে ছোট্ট আওয়াজ হারানের কানে আসতে থাকে। গ্রামের লোকজন ফিরতে শুরু করেছে। হেমন্ত মামার নিথর দেহর পাশে বসে আছে হারান। এখনো কোনো কোনো বাড়ি জ্বলছে। চারিদিকে কান্নার মাতম। জ্বলতে কোনো বাড়ি অবশিষ্ট নেই। ফিরে এসে যে যার মতো আগুন নেভাতে ব্যস্ত। হারানের মা পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে হেমন্তের লাশের কাছাকাছি আসে। হারানের সেই দিকে খেয়াল নেই। মা ছুটে এসে হারানকে জড়িয়ে ধরে। চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয়Ñ কিরে বাপধন তুই এতোক্ষণ কোথায় ছিলি? দৌড়ের মধ্যে তুই যে আমার হাতখানা ছেড়ে দিলি আমি আর খুঁজে পেলাম না। পাহাড়ের কাছে গিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। ভেবেছিলাম তুইও কোনো না কোনোভাবে দৌড়ে এখানে এসেছিস। হারান কিছু বলছে না। দুই চোখ হেমন্তর লাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এরই মধ্যে অনেক লোকের ভিড় হয়। ভিড় ঠেলে কেউ কেউ এগিয়ে এসে হেমন্ত বাবুর হাত ধরে বুঝতে চেষ্টা করে জীবিত আছে কিনা।
লোকজন লাশ ধরাধরি করে এনে হেমন্ত বাবুর বাড়ির উঠোনে রাখে। হারান লাশের একখানা পা কাঁধে নিয়ে উঠোন অবধি আসে। মাও সাথে সাথে থাকে। হারানের এখানে কোন কাজ নেই। যা করবে বড়রা। মার হাত ধরে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
যদিও ওটা মামার বাড়ি। কিন্তু এই ক মাস এই বাড়িকে নিজ বাড়ির মতোই মনে হয় হারানের। মামা-মামির কান্না এখনো থামেনি। দোতলা মাটি মিশ্রিত কাঠের বাড়ি। পুড়ে ছাই। ভেতরে কেউ ঢুকতে পারছে না। লাল অঙ্গার থেকে আগুনের তেজ বের হচ্ছে। হারানের মা এক পা দু পা করে তার ভাই এবং বৌদির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তাদের সাথে সেও সুর করে বিলাপ করছে।
হেমন্ত মামার মৃত্যু হারানের মনে দারুণ রেখাপাত করে। ওর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না এ রকম একজন নিরীহ গোবেচারা মানুষকে পাকিস্তানিরা গুলি করে মারতে পারে। হেমন্ত বাবু গ্রামের লোকদের প্রায়ই বিনে পয়সায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করতো। কদাচিত কেউ এক/দুই টাকা দিলে নিতো। কারো প্রতি কোনো দাবি ছিলো না। শুধুই একটা ব্রত মানুষকে সেবা দিয়ে যাওয়া। তাছাড়াও হেমন্ত বাবুর দাদু ছিলেন- স্বরাজী আন্দোলনের পুরোধা মাস্টার দা সূর্যসেনের সাথী। বংশপরম্পরায় হেমন্ত বাবুর ঘাড়ে এসে বাসা বাঁধে মানুষকে সেবা করার। গ্রামের লোকজন কেউ তার নাম ধরে ডাকতো না। দু’চার গ্রামের লোকজনদের কাছে ডাক্তার বাবু নামে পরিচিত। আজ সেই ডাক্তার বাবু হারানের সামনে মৃত্যুবরণ করেছে। হারানের প্রতিশোধের মন আরও জোরালো হয়।
মামার পুড়ে যাওয়া বাড়ির ধ্বংসাবশেষ সরাতে অনেক রাত হয়ে যায়। যা ছিলো সব পুড়ে ছাই। এমনকি খাটের নিচে রাখা ক্ষেতের আলু, কুমড়ো পুড়ে কেমন একটা উদ্ভট গন্ধ নাকে আসতে থাকে। সারাদিন কারো মুখে কোনো দানা পানিও পড়েনি। হারানেরও খাবার কথা আজ মনে পড়েনি। আগুন থেকে কোন রকমে বেঁচে যাওয়া একখানা হাড়ি পেয়ে হারানের মা, উঠোনে গর্ত করে চুলো বানিয়ে ডাল, চাল যোগাড় করে খিচুড়ি রান্না করে। রাত কাটায় বাড়ির বাইরে।
ক’দিন পর বাবা দিদিকে নিয়ে এই বাড়িতে হাজির। বাবা খবর আনে শহরে মিলিটারিরা আগের মতো অত্যাচার করছে না। সন্দেহ হলে ডান্ডি কার্ড চেক করে। ডান্ডি কার্ড শহরে লোকদের পরিচয়পত্র। তাছাড়া মুক্তিবাহিনির ভয়তো ছিলই। বাবা যে কোম্পানিতে চাকরি করতো সেটা পাকিস্তানি কোম্পানি। বাবার ধারণা শহরে গিয়ে পুরনো চাকরিতে যোগদান করে পরিবারের সবার অন্ন সংস্থান করা। মামার একার পক্ষে এতো লোকের ভার বহন করা কষ্ট। সেটা বাবা বুঝতে পারে। এছাড়াও শহরে যাওয়ার আরেকটা উদ্দেশ্য বড় জামাই বাবুকে খুঁজে বের করা।
কষ্টে সৃষ্টে দিন কয়েক কাটানোর পর হারানরা আবারো শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। নৌকা ঠিক করা ছিলো।
মামা, মামী ও সুশীল থেকে বিদায় নেবার সময় হারান বারবার অন্য মনস্ক হয়ে পড়ে। এই ক’দিনে মামার বাড়ি হারানের মনে অন্য রকম জায়গা করে নেয়। পাহাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, ডাক্তার বাবুর মৃত্যু, দীঘির পাড়, সব কিছুতেই যেন হারানের দুই চোখ। নৌকা চলা শুরু করে ক্যা কুড়ুত ক্যা কুড়ুত। এক সময় খাল পেরিয়ে কর্ণফুলি নদীতে নৌকা প্রবেশ করে। নদীতে অনেকগুলো লাশ। কোনটার পেট ফুলা, কোনটার মুখ বিকৃত। বাবার নির্দেশে সবাই মাথা নিচু করে রাখে। ফেলে যাওয়া সেই পুরনো বাড়িতে ওঠে হারানরা। রেখে যাওয়া জিনিসপত্র সব আগের মতোই আছে। এক হাতল ওয়ালা ভাঙা চেয়ার, নড়বড়ে খাট, পাক ঘরের জিনিস, কাপড়-চোপর সব ঠিক আছে। তবে জিনিসপাতির উপর প্রায় ইঞ্চি দুয়েক ময়লা জমে আছে। পাড়ায় আগের মতো শোরগোল নেই। কেমন গুমোট গুমোট ভাব। কেউ কারো দিকে নজর দিচ্ছে না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সম্ভবত কোনো আতঙ্ক সবাইকে ঘিরে আছে।
শহরে আসার তিনদিনের মাথায় একদিন বিকেলে বাবা এসে তার চাকরির সংবাদ দেয়। সঙ্গে ‘ডান্ডি’ কার্ড পাবার কথাও।
বাবার শহরের আসার মিশন আস্তে আস্তে সাকসেসফুল হতে থাকলো। প্রথম কারণ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। অর্থাৎ চাকরি। বাবা জানতো যেভাবে হোক মালিকের কাছে গেলে বাবার চাকরি হবে। মালিক যদিও বিহারী তারপরও বাবাকে অনেক পছন্দ করতো। দীর্ঘ চাকরি জীবনে বাবা কখনো অকারণে ছুটি ভোগ করেনি। সততা, ছিলো বাবার মধ্যে অন্য আরেকগুণ। বাবা কোনদিন অসততাকে প্রশ্রয় দেয়নি। তাছাড়া বিহারীদের মধ্যে ভালো খারাপ আছে। বাবার মালিকটা ছিলো ভালো দলের। বাবার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য মালিকের মাধ্যমে জামাই বাবুর খবর নেয়া। ঠিক ঠিক একদিন বাবা খবর আনেন জামাই বাবু বেঁচে আছেন। বাবার মালিক এক পাকিস্তানি মেজরের মাধ্যমে এই খবরটা সংগ্রহ করেন। বাবা একদিন দেখাও করতে যান। সাতরাস্তার মোড়ে রেলওয়ের অফিস। পাকিস্তানি ও রাজাকারদের টর্চার সেল। পারতপক্ষে কেউ এই রাস্তা মাড়ায় না। কারণ ওই টর্চার সেল থেকে সারাক্ষণ কান্না, চিৎকার, চ্যাঁচামেচির শব্দ। রাজাকার, আলবদর, আল শামস্রা বাঙালি ধরে ধরে এনে এই টর্চার সেলে নির্যাতন করে। সেই নির্যাতনের করুণ কাহিনি লোকমুখে অনেক শোনা যায়। জামাই বাবুকে দেখে বাবা চিনতে পারছিলো না। মুখে ইয়া বড় বড় দাঁড়ি গজিয়েছে। চোখগুলো ভেতরে ঢুকে আছে। শরীর কংকালসার। লোহার দরজার এক পাশে বাবা, অন্য পাশে জামাই বাবু। দুজনের চোখে পানি। দুইজন এগিয়ে গিয়ে হাতের আঙুলের সাথে আঙুল মেলায়। বাবা তখন জানতে পারেন জামাই বাবুকে দুই দুই বার ইলেকট্রিক চেয়ারে বসে সক্ দিয়েছে। এখানে একটি ইলেকট্রিক চেয়ার বসানো আছে। বাঙালিদের ওখানে বসিয়ে সক্ দেয়। আর মুক্তিবাহিনির কথা জানতে চায়। ভাগ্য খারাপ থাকলে ওই চেয়ার থেকে কেউ উঠে আসতে পারে না। সক্ দিতে দিতে মেরে ফেলে। কিন্তু জামাই বাবুকে দুই দুইবার চেয়ারে বসিয়ে মারেনি। সে কারণ জামাই বাবুও জানে না। দু’জনের চোখ জলে ভাসতে ভাসতে কথা বিনিময় হচ্ছে। বেশিক্ষণ কথা বলতে দেয়নি। একজন সিপাহি এসে জামাই বাবুকে নিয়ে যায়। এসব কথা বাবা যখন বাড়িতে বলছিলো- তখন সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ে। তবুও এইটুকু সান্ত¡না জামাইবাবু বেঁচে আছেন। আমার ভেতর আরো জেদ জমা হতে থাকে।
কিছুদিন পর জামাই বাবু ছাড়া পায়। মুখভর্তি বড় বড় দাঁড়ি গজিয়েছে। প্রথম দেখায় চিনতে পারিনি। বাবা অনেক দৌড়াদৌড়ি করে জামাই বাবুকে ছাড়িয়ে এনেছেন। বাড়িতে খুশির বদলে কয়েকপশলা কান্না পর্ব চলে। জামাই বাবু টানা একমাস ঘর থেকে বের হননি। ভয়ে সবসময় আচ্ছন্ন। বাড়িতে কারো সঙ্গে তেমন কথা বলেন না। ঘরের এককোণে বসে কি যেন লেখেন। দিদি ছাড়া কেউ উনার কাছে যান না। আর যান পাড়ার সুরেশ কবিরাজ। এই বাসায় আসার পর থেকে কবিরাজ মশাই উনার চিকিৎসা করছেন।
হঠাৎ একদিন বাবা আমাকে রিয়াজ উদ্দিন বাজারে নিয়ে গেলো। অনেক বড় বাজার সম্ভবত দেশের সবচেয়ে বড়। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। বাবা কেন আমাকে রিয়াজউদ্দিন বাজারে নিয়ে এলো। বড় একটা মুদির দোকানে ঢুকে ক্যাশে বসা সওদাগরের সাথে বাবা কথা বলছে। দেখলে বুঝা যায় সওদাগর বাবার পূর্ব পরিচিত। আমি দোকানের বাইরে দাঁড়ানো। মিনিট কয় পর বাবা আমার হাত ধরে উনার কাছে নিয়ে গেলেন। সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত চাকরি। দোকানের সামনে রাখা মালামাল পাহারা দেয়া ও ফাই ফরমায়েস খাটা। বেতন দৈনিক আট আনা। আমার বেশ খুশি খুশি লাগছিলো। প্রথমত: চাকরির পয়সা মায়ের হাতে তুলে দিতে পারবো। দ্বিতীয়ত: চারটার পর একটু এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করা যাবে। এতোদিন বাসার বাইরে গেলে সবাই বারণ করতো। কারণ পাড়ায় প্রায় বাড়িই বিহারীরা দখল নিয়েছে। বিহারী ছেলেদের সাথে মিশতে গিয়ে কখন কি বিপদ হয় আশংকায় বড়রা আমাকে বের হতে দিতো না। সম্ভবত এই কারণে আমাকে চাকরিতে ঢোকানো। আমার চাকরির স্থল ও বাসার দূরত্ব যদিও বেশি না। তবুও একটু ঘুরে যেতে হয়। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের অন্য পাড়ে রিয়াজউদ্দিন বাজার, এই পাড়ে আমাদের বাসা।
দোকানে আরো একটা ছেলে আছে। ও আমাকে এটা ওটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। কাস্টমার আসলে কি করতে হবে বা সামনে দাঁড়িয়ে থেকে কিভাবে মালামালের উপর চোখ রাখতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক ব্যাপার স্যাপার। আমি কিছু না বলে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে যাচ্ছিলাম। তাছাড়া একদিনে সব বুঝাও কি সম্ভব? তবে এটুকু বুঝলামÑ ওই আমাকে কাজ শেখাবে। ও যা বলবে সেভাবে কাজ করতে হবে। আমি খুব উৎসাহ নিয়ে চাকরি জীবন শুরু করলাম। যে ছেলেটার কথা বলছিলাম ওর নাম হচ্ছে মাহবুব। বয়সে আমার চাইতে কয়েক বছরের বড় হবে। প্রথম দেখাতে ওকে আমার খুব ভালো লোগে যায়। একটি লাঠি সদৃশ্য, লাঠির আগায় ছোট ছোট চিকন লম্বা জাতীয় বাঁধা, আমার হাতে দেয় মাহবুব। সামনে রাখা সেমাইয়ের টুকরির ওপর ওই লাঠি নড়াচাড়া করা। মাছি তাড়ানো। কিছুক্ষণ পর পর এই কাজটা করে যাওয়া। দোকানের সওদাগরকে দেখে ভালো মনে হলো। একখানা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে চতুরদিকে দেখছে, পেটটা একটু বেশি মোটা, মনে হলো। কাস্টমার থেকে টাকা নিতে গিয়ে ক্যাশবাক্স খুলতে গেলে পেটে গিয়ে বাজছে। আমার মনে হয় সব সওদাগরের পেটমোটা। পেটের মধ্যে সব টাকার বান্ডিল। ঠিক তিনটের দিকে সওদাগর হাত ইশারায় আমাকে ডাকলো।