কিশোর গ্যাং নির্মূলে চট্টগ্রামের পুলিশ প্রশাসনের উদ্যোগ প্রশংসনীয়

70

গ্যাং করে কিশোরদের অপরাধ জগতে নিয়ে যাওয়া অথবা নিজেরাই নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অপরাধে জড়িয়ে পড়া কোনটাই দেশ ও সমাজের জন্য ভালো খবর নয়। কিন্তু এখবর দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে আছে। সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিশোর গ্যাং-এর নামে যেসব সামাজিক অপরাধ চলছে তা নাগরিক সমাজকে উদ্বিগ্ন না করে পারে না। এ অবস্থায় কিশোর গ্যাং কালচারের মূলোৎপাটন জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষকরে এ গ্যাং কালচারের পেছনে যেসব বড় ভাই বা রাজনৈতিক শক্তি ইন্ধন যোগায় তাদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান জরুরি। আশার কথা চট্টগ্রামের পুলিশ প্রশাসন কিশোর গ্যাং-এর বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। গতকাল রবিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত সংবাদ উল্লেখ করা হয়, সিএমপির নবনিযুক্ত কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে প্রথমবার মতবিনিময়েই হাল সময়ে পাড়া-মহল্লায় দৃশ্যমান হওয়া পশ্চিমা ধাচের ‘কিশোর গ্যাং কালচার’ ভবিষ্যত প্রজন্ম ও জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে মন্তব্য করেন। একইসাথে দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে শহরের কোথাও কিশোর গ্যাং- নামে কোনও উৎপাত মোটেও সহ্য করা হবে না জানিয়ে এ ধরনের কালচারের নামে যারা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত হবে তাদের পাশাপাশি আড়ালে থেকে ছত্রছায়া প্রদানকারী বড় ভাইদেরও কোনও ছাড় না দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এরপর সিএমপির অপরাধ বিভাগের সবকটি শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদেরকে ১৬ থানা এলাকার কিশোর গ্যাং-এর তালিকা হালানাগাদ করার ব্যাপারে নির্দেশনা দেন। কিশোর অপরাধচক্রের কারা কোন এলাকায় সক্রিয় রয়েছে, কোন চক্রের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে রয়েছে, কাদের বিরুদ্ধে কী মামলা রয়েছে বা নেই- বিস্তারিত সব তথ্য হালনাগাদ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জোনের ডিসিরা তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম তদারক করবেন। ওই তালিকা ধরেই প্রতিটি চক্র ও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের আইনের আওতায় আনতে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ভয়াবহ আকারে বেড়েছে। বিশেষ করে যেসব শিশু-কিশোরকে আমরা সুন্দর শৈশব ও কৈশোর দিতে পারিনি, যারা মা-বাবার স্নেহ-ভালোবাসা এমনকি জীবনযাপনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, তারা সহজেই নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় পেশাদার অপরাধীরা নিজেদের স্বার্থে শিশুকিশোরদের ব্যবহার করে থাকে। পরবর্তীকালে এদের অনেকের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব হয় না। সম্প্রতি চট্টগ্রামে উড়ালসড়কে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে যেসব শিশু-কিশোর ধরা পড়েছে, তাদের প্রায় সবারই জীবন ভাগ্যবিড়ম্বিত। সুস্থ ও স্বাভাবিক শৈশব বলতে যা বোঝায়, তা তারা পায়নি। এদের বেশির ভাগ বাস করছিল রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল বা ফুটপাতে। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মূলত কিশোর গ্যাংই চট্টগ্রামের উড়ালসড়কে ছিনতাই করে থাকে। গত ২৮ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত র‌্যাব-পুলিশ নগরে অভিযান চালিয়ে ৪৪ জনকে আটক করে। তাদের কাছে ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত ছুরি, রড ও সুতা পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, নেশার টাকা জোগাড় করতে তারা ছিনতাই করে থাকে। আটক শিশুকিশোরদের কিশোর সংশোধন ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।
ছিনতাই ও মাদক সেবন দুটোই গুরুতর অপরাধ। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত শিশু-কিশোরদের অপরাধী হিসেবে দেখা যাবে না। কোনটি অপরাধ আর কোনটি অপরাধ নয়, তা বোঝার বয়স তাদের হয়নি। সেক্ষেত্রে সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত সঠিক। কিন্তু সমস্যা হলো, দেশে শিশু-কিশোর সংশোধন কেন্দ্র নামে যে কটি প্রতিষ্ঠান আছে, কোনোটিই মানসম্মত নয়। প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবলও সেখানে নেই। যাঁরা এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন, তাঁরা অনেক সময় শিশু–কিশোরের সঙ্গে নির্দয় আচরণ করে থাকেন। ফলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এই অবস্থার দ্রæত অবসান হওয়া জরুরি। প্রতিটি কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে উপযুক্ত বৃত্তিমূলক কাজের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে এখান থেকে বেরিয়ে কাউকে অনিশ্চিত পথে পা বাড়াতে না হয়। প্রত্যেক শিশু-কিশোরের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দিতে হবে। কারও উপযুক্ত অভিভাবক না থাকলে রাষ্ট্রকে তার অভিভাবকের দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা পুলিশ প্রশাসনের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
সমাজবিজ্ঞানী ও পুলিশ কমিশনারের সাথে সহমত পোষণ করে বলতে চাই, কিশোর অপরাধ নির্মূলে পুলিশি পদক্ষেপের পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনও দরকার। আইনের কঠোর প্রয়োগের চেয়ে সামাজিক অনুশাসন ও পারিবারিক শিক্ষাই কিশোর অপরাধ নির্মূলে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।