কাশ্মীরের আর্তমানবতার চিৎকার জাতিসংঘে খান-মোদির বাকযুদ্ধ

68

কাশ্মীর নিয়ে জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনের সাধারণ সভায় খান-মোদি বাঘযুদ্ধে মুখোমুখী হচ্ছে। এ বিষয়ে ইমরান খান যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীনকে পাশে পেয়েছেন। জাতিসংঘে নিজেকে কাশ্মীরিদের ‘প্রতিনিধি’ হিসাবে আখ্যা দিয়ে বিশ্বের দরবারে উপত্যকার মানুষদের কথা তুলে ধরবেন বলেও আগেই মন্তব্য করেছিলেন ইমরান। অন্য দিকে, কাশ্মীর প্রসঙ্গে ইতিমধ্যেই রাশিয়া ও ফ্রান্সের সমর্থন পেয়েছে ভারত এটি যে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তা বারবারই বলে আসছে মোদি সরকার। ফলে ২৭ সেপ্টেম্বর দিনের সাধারণ সভায় ভারত-পাক, দু’দেশই যে কাশ্মীর প্রসঙ্গে নিজেদের পক্ষ সমর্থনে জোরালো যুক্তি তুলে ধরবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই এবারের সভায় দুই নেতার বক্তব্য আলাদাভাবে গুরুত্ব পাবে বিশ্ব নেতাদের কাছে। পাকিস্তানের দাবি, কাশ্মীরের ওপর থেকে বিশেষ মর্যাদা তুলে নেবার পর ভারত যে সেখানে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। সে বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে পাকিস্তান। এ নিয়ে ইসলামাবাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে চীন ও তুরস্কসহ বিশ্বের অর্ধশতাধিক রাষ্ট্র। চীন-তুরস্কসহ অর্ধশতাধিক দেশ কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের অবস্থান সমর্থন করে যৌথ বিবৃতি প্রদান করে। এক্সপ্রেস ট্রিবিউন ও আনাদলু এজেন্সির খবরে বলা হয়, সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি কাশ্মীরে ভারত সরকারের দমন-নিপীড়নের কথা আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের সামনে তুলে ধরেন। পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অভিযোগের পর চীন-তুরস্কসহ অর্ধশতাধিক রাষ্ট্র এক যৌথ বিবৃতিতে কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে ভারতের প্রতি আহŸান জানান। টুইটারে দেয়া এক পোস্টে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কাশ্মীর ইস্যুতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে ৫০টিরও বেশি দেশ পাকিস্তানের পক্ষে ঐতিহাসিক যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে ভারত সরকারের প্রতি পাঁচটি আহŸান জানিয়ে বলা হয়, জাতিসংঘ সনদ, নিরাপত্তা কাউন্সিলের রেজুলেশন, মানবাধিকারের মান এবং আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে একমত হয়ে ভারত শাসিত জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের সম্মান রক্ষায় আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের আহŸান থাকা উচিত। বিশেষত তাদের জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা অধিকারের বিষয়ে। কাশ্মীরে যোগাযোগের ওপর বিধিনিষেধ ও অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহার এবং রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে দেশগুলো। পাশাপাশি সেখানে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও বন্দুকের ব্যবহার বন্ধ এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বাধাহীন প্রবেশাধিকারের দাবি জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমরা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবানা বাস্তবায়নের মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীর সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করছি। চীন-তুরস্কসহ ৫০টি দেশের সমর্থনের ঘটনাকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক সাফল্য আখ্যায়িত করেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। শাহ মাহমুদ কোরেশি বলেন, যৌথ বিবৃতিতে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে জাতিসংঘ এবং ওআইসি-র অর্ধশতাধিক রাষ্ট্র ভারতের প্রতি আহŸান জানিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চীন ও পাকিস্তানের অনুরোধে ১৬ আগস্ট নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্বদ্বার বৈঠকে বসে জাতিসংঘ। বৈঠকে জম্মু-কাশ্মীর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। গত কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর বিষয়ে আলোচনা হলো। তবে প্রবল ক্ষমতাধর নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য দেশের এ আলোচনায় কাশ্মীর সংকট সমাধানে তেমন কোনো ফল আসেনি বলে জানিয়েছে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন। জাতিসংঘের একজন কূটনীতিকের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈঠকের পর নিরপত্তা পরিষদের বিবৃতিতে কাশ্মীর ইস্যুতে কোনো কথা বলা হয়নি। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের পর গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয়াকে পরিষদের ন্যূনতম কাজ হিসেবে দেখা হয়। কাশ্মীর ইস্যুতে এবার ন্যূনতম পদক্ষেপটি নেয়া হয়নি। জাতিসংঘের ওই কূটনীতিক আরও জানান, নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের পর কোনো বিবৃতি দেয়া হলে তা কাশ্মীরের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি আরো বাড়িয়ে তুলবে মনে করে এর বিরোধিতা করে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের একাংশ। আবার পরিষদের আরেকটি অংশ এই বৈঠক শেষে কোনো বিবৃতি দেয়া হলে তা হবে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়া— এমন ভাবনা থেকে বিবৃতি দেয়ার বিরোধিতা করে। এছাড়া বৈঠকে ফ্রান্স, জার্মানি ও জাতিসংঘ কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সুযোগ নষ্ট হওয়াসহ পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করতে পারে এমন ভাষা ব্যবহারের বিরুদ্ধে মত দেয়। জাতিসংঘের আরেকজন কূটনীতিক জানান, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাকেই কাশ্মীর ইস্যুতে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। কাশ্মীর নিয়ে পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে এবং চীন পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে আসছে। এ কারণে ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদ বৈঠকে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না বলে আগে থেকেই ধারণা করে আসছিলেন পর্যবেক্ষকরা। সেটিই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো। এই ফলহীন বৈঠকের পর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি মালিহা লোধি। তিনি বলেন, ‘এ বৈঠক প্রমাণ করেছে, ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জনগণের চিৎকার-ধ্বনি জাতিসংঘের কানে পৌঁছেছে।’ মালিহা লোধি দাবি করেন, এ বৈঠক প্রমাণ করে কাশ্মীর ইস্যু একটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। কাশ্মীর ইস্যুর একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য পাকিস্তান প্রস্তুত বলেও জানান তিনি। অন্যদিকে জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আকবরউদ্দিন বলেন, ‘কাশ্মীর ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমাদের আন্তর্জাতিক কোনো পক্ষকে প্রয়োজন নেই।’ এদিকে জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন বলেন, ‘কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান উভয়েরই একতরফা পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকা উচিত বলে মনে করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ।’ এদিকে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকতে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। কাশ্মীরের ভারতীয় অংশে বিধিনিষেধ আরোপের খবরে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন মহাসচিব। ১৯৪৮ ও ১৯৫০ সালের দশকে কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের বিরোধের বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এর মধ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গণভোট নেয়ার কথাও ছিল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অস্ত্রবিরতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য ১৯৪৯ সাল থেকে জম্মু-কাশ্মীরে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মোতায়েন আছে। কিন্তু সব কিছু উপেক্ষা করে স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা ৫ আগস্ট বাতিল করে শেষ অধিকারটুকুই বাতিল করে ভারত। এর প্রেক্ষিতে ভারতীয় সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে কাশ্মীরিদের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিয়ে নরেন্দ্র মোদি ঐতিহাসিক ভুল করেছে বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি বলেন, এই ভুলের কারণে কাশ্মীরিদের স্বাধীনতা পাওয়ার ঐতিহাসিক এক সুযোগ এসেছে। তার মতে এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে কাশ্মীর স্বাধীন হয়ে যাবে। ২৬ আগস্ট জাতীর উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ইমরান খান বলেন, ক্ষমতায় আসার পর একাধিক বার ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছিলাম। বলেছিলাম, শান্তি স্থাপনে ভারত এক পা এগোলে, চার পা এগোব আমরা। কিন্তু আলোচনায় বসতেই রাজি হয়নি ভারত। সবকিছুর জন্য শুধু পাকিস্তানকে দায়ী করে গিয়েছে। সন্ত্রাসে মদত জোগানোর অভিযোগ তুলেছে। তিনি বলেন, ভারতে উগ্র হিন্দুপন্থী নামে পরিচিত সংগঠন আরএসএস এবং দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভুলের কারণে কাশ্মীরিরা স্বাধীনতার সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, কাশ্মীর সমস্যা এখন আর কোনো দ্বিপাক্ষিক সমস্যা নয়। এটি এখন আন্তর্জাতিক সমস্যা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের নজর কাড়তে পেরেছি; এটাই বড় সাফল্য। আমরা এটা নিয়ে জাতিসংঘে যেতে পেরেছি; এটাই আমাদের সফলতা। কাশ্মীর সিদ্ধান্তের জন্য বিজেপি এবং সঙ্ঘের হিন্দুত্ববাদ আদর্শকেও দায়ী করেন ইমরান। খান বলেন, জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপ করে ভারত সরকার। উপত্যকাকে ভেঙে দু’টুকরো করেছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিয়ম নীতির তোয়াক্কাও করেনি ওরা। নিজেদের দেশের সুপ্রিম কোটের্রও পরোয়া করেনি। মহাত্মা গান্ধী এবং জওহরলাল নেহরু কাশ্মীরবাসীকে যে প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে গিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানেরও পরিপন্থী। বিজেপি এবং আরএসএস-এর শুধু একটাই লক্ষ্য, হিন্দুস্তান শুধু হিন্দুদের। বাকিদের সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকতে হবে। ইমরান খান বলেন, ফ্যাসিবাদী আদর্শে বিশ্বাসী আরএসএস।
মোদি পূর্ববর্তী সরকার তাদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বার্তা দেওয়ায় মহাত্মা গান্ধীকেও খুন করেছিল ওরা। তিনি বলেন, পবিত্র কোরানের আদর্শে বিশ্বাস করি আমরা। তাই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় বিশ্বাস করি। আরএসএস-এর আদর্শ সম্পূর্ণ বিপরীত। ভারতকে হুঁশিয়ারি দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কাশ্মীরের এক ইঞ্চিও ছাড়তে রাজি নয়। আমরা কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়ব। তিনি আরও বলেন, মনে রাখতে হবে, এই অঞ্চলটিতে যদি কোনো সময় পারমাণবিক যুদ্ধ লেগে যায়, তাহলে কেউই জয়লাভ করবে না। এই যুদ্ধের ফলে ভোগ করবে সারা বিশ্ব। তাই এটি আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের ওপর নির্ভর করবে। সর্বশেষ কাশ্মীর নিয়ে স্বাধীনতাকামী বিশ্ববাসির নজর এবার জাতিসংঘের সাধারণ সভার প্রতি। ইমরান খান ও মোদি কি বার্তা দিচ্ছে জাতিসংঘকে আর জাতিসংঘ কি বার্তা দিচ্ছে কাশ্মীর প্রসঙ্গে বিশ্ববাসীকে?

লেখক : সমাজকর্মী ও প্রাবন্ধিক