কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর গাছ

7

তৈয়ব চৌধুরী, রাউজান

হালদা, কর্ণফুলী নদী আর পাহাড়বেষ্টিত রাউজান উপজেলায় এক সময় সারি সারি খেজুর গাছে গ্রাম বাংলার এক অপূর্ব সৌন্দর্য দৃশ্যমান হতো। আবহমান গ্রামবাংলার এ চিরন্তন রূপ এখন আর নেই বললেই চলে। একটা সময় ছিল যখন শীত মৌসুম শুরু হলেই বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে খেজুর রস আহরণের ধুম পড়ে যেত। গ্রামের মেঠো পথগুলোর ধারে সারি সারি খেজুর গাছে মাটির হাঁড়ি টাঙিয়ে রাখার দৃশ্য চোখে পড়ত খুব সহজেই, যার রসের মৌ মৌ গন্ধ পাওয়া যেত। অপেক্ষা করতে হতো কখন রস নামবে, কখন হবে মীতের পিঠাপুলি। এখন আগেরমতো আর খেজুর গাছ চোখে পড়ে না। ফলে রসের চাহিদাও আর পূরণ না হওয়ায় শীতের পিঠায় নবান্নের উৎসবও আর পালন করতে দেখা যায় না।
একসময় গ্রামের কৃষক-কৃষাণীরা নবান্নের উৎসবে মেতে উঠতেন রসের তৈরি শীতের নানান পিঠা নিয়ে। তখন গ্রামে বিয়ের পর বা এক আত্মীয় অন্য আত্মীয়ের বাড়িতে খেজুর রস ও শীতের পিঠা পাঠাতেন উৎসবের মতোই। এখনো কোনো কোনো পরিবার এই ঐতিহ্য ধরে রাখলেও অধিকাংশ পরিবার বাধ্য হয়ে মিঠা দিয়ে তৈরি নানান পিঠা আত্মীয়-স্বজনকে পাঠান। ফলে রসের সেই প্রকৃত স্বাদ সম্পর্কে অজ্ঞতায় নিমজ্জিত হচ্ছে নতুন প্রজন্ম।
মেয়ের বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়িতে শীত মৌসুমে নানান বাহারি পিঠার সঙ্গে খেজুর রস পাঠানোর রেওয়াজ এখনো বিদ্যমান। রসসহ পিঠা না পাঠালে মেয়ের শ্বশুরপক্ষ অসন্তুষ্ট হয়। গাঁও-গঞ্জে যখন খেজুর গাছ প্রচুর ছিল, তখন স্বেচ্ছাশ্রমে কাজে যুক্ত মানুষদের খেজুর মিষ্টান্ন ও শীতপিঠা দিয়ে কাজ শেষে আপ্যায়ন করা হতো। শুধু তাই নয়, গ্রামের দুষ্টু ছেলেরা খেজুরের রস চুরি করে খেয়ে খুব আনন্দ পেতো। এমনকি যার গাছের রস চুরি করেছে, তাদের বাড়িতে এনে ছেলে ও আত্মীয়-স্বজনদের খাওয়াত। এ নিয়ে অনেক গল্প-কবিতাও রয়েছে। আগে শীত আসলেই গ্রাম-গঞ্জ, শহরের ফুটপাত হতে শুরু করে প্রতিটি স্থানে পিঠা বানানোর ব্যস্ততা বেড়ে যেত। বাহারি রকমের পিঠা তৈরির উৎসবে আত্মহারা হতো সর্বস্তরের মানুষ। শীতের আগমনী বার্তায় হতদরিদ্র মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠতো পিঠা তৈরি। এ পিঠা বিক্রি থেকে অর্জিত অর্থের মাধ্যমে চলতো তাদের সংসার। তীব্র কনকনে শীতকে উপেক্ষা করে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সড়কের পাশে, হাটে-বাজারে, পাড়া-মহল্লার মোড়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পিঠা বিক্রির উৎসব চলত। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এসব পিঠা খাওয়ার জন্য ভিড় করতে দেখা যেত। এসব পিঠা বিক্রির কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যুক্ত হতেন। এখন সে দৃশ্য চোখে পড়ে না। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ঘরে ঘরে চিতল, দুধ চিতল, পুলি, ভাপা, পাখন, তেলে, গোটাপিঠা, মোয়াসহ হরেক রকমের পিঠা তৈরিতে গৃহিণীরা ব্যস্ত সময় কাটাতো।
কিন্তু সেই দিনগুলো এখন অনেকটাই স্মৃতি। অবাধে খেজুর গাছ নিধন এবং পেশাদার গাছি সঙ্কটের কারণে উপজেলায় ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস ও রসের তৈরি রাব প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। গ্রামাঞ্চলে ধীরে ধীরে জেঁকে বসতে শুরু করেছে শীত। আর শীত এলেই অযতœ ও অবহেলায় বেড়ে ওঠা খেজুর গাছের কদর বাড়ে সবার কাছে। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে বড়ই মধুর লাগে প্রাকৃতিক কোমল পানীয় খেজুরের মিষ্টি রস। খেজুর গাছের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যত শীত বাড়বে, তত মিষ্টি রস দেবে। হাড় কাঁপানো শীতকে উপেক্ষা করে গাছিরা সাত সকালে খেজুরের রস সংগ্রহ করতে যান গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কিন্তু কালের বিবর্তনে খেজুর গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। আগামিতে এটি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ না করলে খেজুর গাছের অস্তিত্ব সংকট দেখা দেবে রাউজানে।
কিন্তু কালের বিবর্তনে কর্মচাঞ্চল্যের কারণে মানুষ এখন বাড়িতে পিঠা তৈরির উৎসব-আমেজ হারিয়েছে। এতে শীতের বাহারি নকশী করা পিঠা খাওয়ার স্বাদ ও আমেজ হারাচ্ছে এ প্রজন্ম। ভবিষ্যত প্রজন্ম হারাচ্ছে পিঠা তৈরির কৌশল।
সূত্রমতে, গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে খেজুর গাছ বিলুপ্তির পথে। খেজুর গাছের পাতা দিয়ে ঘরের ঝাড়ু তৈরি করা হয়। আর খেজুর কাটা দিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় ঘেরা দেয়া হয়। যাতে বাড়িতে চোর বা অবাঞ্চিত লোক ঢুকতে না পারে। এছাড়া খেজুর পাতা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। খেজুর গাছ কেউ রোপণ করত না। পাখ-পাখিরা খেজুর খেয়ে মাটিতে বীজ ফেললে এ ধরণের বীজ থেকে খেজুরের গাছের জন্ম হতো। এখন গাছ যেহেতু নেই, কোনো পাখি আর খেজুর খেতে পারে না। তাই গাছেরও জন্ম হচ্ছে না। তাছাড়া সাধারণ মানুষের খেজুর গাছ রোপণের প্রবণতা খুবই কম।
যদিও রাউজানের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর আর্থিক সহযোগিতায় রাউজানে কয়েক বছর আগে ৪ হাজার নতুন খেজুর গাছ রোপণ করা হয়েছিল।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ইমরান হোসাইন জানান, খেজুর গাছ প্রতিবছরই হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে রাউজান উপজেলায় ৫ শতাধিক গাছ খেজুর রসের জন্য প্রস্তুত করছেন এখানকার গাছিরা। এখানকার আবহাওয়ার সাথে মানানসই খেজুর গাছ এমনিতেই জন্মে। অন্যান্য সময় অযতœ-অবহেলায় পড়ে থাকা খেজুর গাছের কদর বেড়ে যায় শীতকালে। তবে হারিয়ে যাওয়া এসব গাছ রক্ষায় রাউজানের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর আর্থিক সহযোগিতায় রাউজানে কয়েক বছর আগে ৪ হাজার নতুন খেজুর গাছ রোপণ করা হয়। যা হয়তো ভবিষ্যতে হারানো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে ভ‚মিকা রাখতে পারে।