কালুরঘাট সেতুর জন্য আ. লীগে যোগ দিতেও রাজি এমপি বাদল

80

কালুরঘাট সড়ক কাম রেল সেতু নির্মাণের জন্য এবার নিজ দল জাসদ ছেড়ে প্রয়োজনে আওয়ামী লীগে যোগ দিতেও রাজি বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম-৮ আসনের সংসদ সদস্য মঈন উদ্দিন খান বাদল। এর আগে গত জুন মাসে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সেতু নির্মাণের সুরাহা না হলে সংসদ থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। জীবনসায়াহ্নে এসে কালুরঘাটে নতুন সেতু ছাড়া মহাজোট নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর কোনও চাওয়া নেই বলেও জানান চট্টগ্রামের প্রবীণ এ সাংসদ। গতকাল শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম ক্লাবে কালুরঘাট সড়ক কাম রেল সেতু নির্মাণের দাবিতে চট্টগ্রামের সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন।
মঈন উদ্দিন খান বাদল বলেন, কালুরঘাট সেতুর ওপর থেকে ৭১-৭৯ জায়গায় কর্ণফুলী নদী দেখা যায়। দশ কিলোমিটার স্পিডের ট্রেন মাত্র আড়াই মাইল গতিতে ফার্নেস অয়েলবাহী ও কয়েকটি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে কালুরঘাট পুরানো সেতু দিয়ে ভেঙে যাওয়ার ভয়ে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০ হাজার লোক এ সেতু দিয়ে হেঁটে পার হন। এ সেতুর ওয়েটিং টাইম কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা। অপেক্ষাকালীন মানুষ আমার মৃত মাকে গালি দেন। এর থেকে মুক্তি চাই। এ নিয়ে সংসদে ও প্রধানমন্ত্রীকে অনেকবার বলেছি, এখনো বলছি। কালুরঘাট সড়ক কাম রেল সেতু চাই ই চাই।
সাংসদ বাদল বলেন, দায়দায়িত্ব মাথায় রেখে বলতে চাই, ১০ বছরে বহুবার বলেছি, চট্টগ্রামের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ হচ্ছে। রাষ্ট্রের বিনিয়োগে মাথায় রাখতে হবে প্রায়োরিটি ও কস্ট বেনিফিট। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের জন্য কর্ণফুলী, শঙ্খ, মাতামুহুরী, বাঁকখালীতে সেতু লাগবে। জলাবদ্ধতার সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির প্রতিষ্ঠানকে দিলেন না কেন? চট্টগ্রাম খুবই স্পর্শকাতর এলাকা। এটিকে কুড়িগ্রাম ভাবলে হবে না। কালুরঘাট সেতু থেকে ৩৯ কিলোমিটার দূরে কর্ণফুলী টানেল। রেল তো টানেল দিয়ে যাবে না। কালুরঘাট সেতু দিয়ে কক্সবাজারে রেল যাবে। আমাদের দাবি রেল কাম সড়ক সেতু করা হোক।
এর যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রবীণ এ সাংসদ বলেন, এ সেতু নিয়ে চারবার সমীক্ষা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান, বাংলাদেশ ও কোরিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সমীক্ষাগুলো চালিয়েছে। কোরিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সমীক্ষা শেষে মাত্র ১১শ ৯০ কোটি টাকায় এই সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতার প্রতিবেদন দিয়েছে। এমনকি সেতুটি নির্মাণের ব্যাপারে তারা ৮শ কোটি টাকা কোরিয়ান অর্থ সহায়তার প্রস্তাবনাও দেয়। তাহলে সেতুটি নির্মাণে সরকারের মাত্র ৩৯০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ পেলেই কাজ শুরু করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এটি সবচেয়ে বড় সামরিক প্রয়োজনীয়তা মেটাবে। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ হাবকে সংযুক্ত করবে। কক্সবাজারে ঝিনুক মার্কা আন্তর্জাতিকমানের রেল স্টেশন করা হচ্ছে। আমি এর বিপক্ষে নই। যদি কালুরঘাট সেতু না হয় তাহলে ঝিনুক ভেঙে মুক্তা বেরিয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম-৮ আসনের এ সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে আরো বলেন, আপনি চট্টগ্রামের দায়িত্ব হাতে নিয়েছেন। এই চট্টগ্রামের উন্নয়নে আপনি হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছেন। সর্বশেষ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বপ্রথম উদ্যোগ কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ করছেন। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন করতে কালুরঘাট রেল সেতু নির্মাণ করা হবে। আমার দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর একমাত্র দাবি শুধু রেল সেতুর সাথে সড়ক সংযুক্ত করা। এই সড়ক কাম রেল সেতুটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রামের সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সাথে সমগ্র দেশের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
তিনি বলেন, আমার জীবদ্দশায় কালুরঘাট সড়ক কাম রেল সেতুটির বাস্তবায়ন দেখে যেতে চাই। এই সেতুর জন্য আমি আমার ‘সবেধন নীলমণি’ রাজনৈতিক জীবনের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি সাংসদ পদ থেকে অব্যাহতি নেয়ার কথা পর্যন্ত বলেছি। আমার দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর জন্য আমি তো আর কিছু চাইনি। সেতুর বিনিময়ে যদি আরো কিছু দিতে হয় আমি তাও দিতে প্রস্তুত। যে মাটির জন্য ’৭১ এ জীবন বাজি রেখেছিলাম, যে মাতৃভূমি রক্ষার জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করেছি, সে মাটির জন্য আমি শেষ বারের মত কালুরঘাট সড়ক কাম রেল সেতুর বাস্তবায়ন চাই।
বক্তব্যের এক পর্যায়ে এই কালুরঘাট সড়ক কাম রেল সেতু নির্মাণের বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত নিজের দল ছাড়ার ঘোষণাও ব্যক্ত করেন জাসদ নেতা মঈন উদ্দিন খান বাদল। তিনি বলেন, মাটির টানে ঘর ছেড়েছি। জীবন সায়াহ্নে এসে মানুষের টানে একটি সেতুর জন্য সংসদও ছাড়ব বলেছি। তবুও আমি সড়ক কাম সেতুটি চাই। প্রেমের টানে মানুষ জাত কূল মান বিসর্জন দেয়। আমি এবার জনগণের প্রেম রক্ষায় নিজের জাত ছেড়ে প্রয়োজনে আওয়ামী লীগে আসবো। সেতু ছাড়া আমার আর কিছুই চাই না।
সাংসদ বাদল সংসদে একজন ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্য হওয়া সত্তে¡ও কালুরঘাট সড়ক কাম রেল সেতু নির্মাণে সরকারের পক্ষ থেকে মাত্র ৩৯০ কোটি টাকা বরাদ্ধে তাকে কেন এত কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে- মতবিনিময়ে উপস্থিত সাংবাদিকরা উস্মা প্রকাশ করেন। এসময় তিনি নিজকে ‘হেডাম’ ছাড়া এমপি বলে মন্তব্য করেন। চট্টগ্রামের স্বার্থে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতিকে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের বিষয়ে চট্টগ্রামের সিনিয়র সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুরোধ করেন।
এর প্রতিউত্তরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি আলী আব্বাস বলেন, জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হলো প্রায় এক বছর। এই সময়ে চট্টগ্রামের উন্নয়ন নিয়ে সাংসদদের কোনো সমন্বিত পরিকল্পনাই তো চোখে পড়েনি। আপনারা সংসদ সদস্যরা আজ পর্যন্ত একসাথে বসেননি। আপনাদের সমন্বয়হীনতাও উন্নয়নের প্রতিবন্ধক-এই প্রসঙ্গ অনেকটা যৌক্তিক। দশের লাঠি একের বোঝা। কালুরঘাট সড়ক কাম রেল সেতু হবে। চট্টগ্রামের সব সংসদ সদস্য ও মেয়রকে নিয়ে গোলটেবিল আলোচনা করেন। আপনি পারবেন। আপনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশের শ্রেষ্ঠ পার্লামেন্টারিয়ান। যে নেত্রী আপনাকে সম্মান দিয়েছেন, তিনি সেতুও দেবেন। আমরা সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাবো।
এমপি বাদল আরো বলেন, ফ্লাইওভার করছেন সবার বাধা উপেক্ষা করে। চট্টগ্রাম পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য যেখানে ফ্লাইওভারের নিচেও পানি, উপরেও পানি। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিটি আমি সংসদে তুলে ধরে স্পিকারের কাছে পাঠিয়েছি। গবেষণা বলছে, ৪১ বছর পর চট্টগ্রাম পানির নিচে ডুবে যাবে। এর নমুনা এখন দেখছি। চট্টগ্রাম-৮ আসনের শহরাঞ্চলে জোয়ারের পানি ঢুকে। জোয়ার কবে আসবে জেনে বিমানবন্দরে যেতে হবে।
মতবিনিময় সভায় সিনিয়র সাংবাদিক সিভয়েস সম্পাদক এম নাসিরুল হক, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ ফারুক ইকবাল, দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম আবাসিক সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, দৈনিক কালের কণ্ঠের চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ মোস্তফা নঈম, দৈনিক যুগান্তরের চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার তাদের মতামত তুলে ধরে বক্তব্য দেন।