‘কালুরঘাট প্রতিরোধ যুদ্ধ ও অন্যান্য’

227

বাংলাদেশের খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থা চট্টগ্রামের বলাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও কবি শামসুল আরেফীনের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গ্রন্থ ‘কালুরঘাট প্রতিরোধ যুদ্ধ ও অন্যান্য’।
গ্রন্থটিতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ৮.৪৫-৯.০০ টার মধ্যে হালিশহর ইপিআর সদর দপ্তরের অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম ইপিআর সৈনিকদের নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই যুুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। এই রেজিমেন্টের বিদ্রোহ করতে অনেক বিলম্ব হয়। রাত ৩.০০ টার প্রাক্কালে মেজর জিয়া এই রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব নিয়ে একটি ৪৫ গ্যালনের ড্রামের উপর দাঁড়িয়ে বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়ে সৈনিকদের কালুরঘাটের দিকে রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দেন। রাত ৩.০০ টায় রওয়ানা হওয়ার সময় ইবিআরসি থেকে পালাতে সক্ষম হওয়া সৈনিকদের অনেকে তাদের সাথে যুক্ত হয়। তারা রওয়ানা হওয়ার সময় রাস্তায় ব্যারিকেড সরানো ও সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করার কাজে নিযুক্ত সৈনিকরা তখনও ফিরে না-আসায় ষোলশহরস্থ হেড কোয়ার্টারে নায়েব সুবেদার আবদুল মালিকের নেতৃত্বে একটি ছোট সেনাদল তাদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য রাখা হয়। সৈনিকরা ফিরে এলে কী করবে, সেই নির্দেশনাও নায়েব সুবেদার আবদুল মালিককে দেয়া হয়।
অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পথিমধ্যে কালুরঘাটে ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুুরীর নেতৃত্বাধীন কোম্পানির সাক্ষাৎ পায়। তারা চট্টগ্রাম শহরে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের সাথে যোগ দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু মেজর জিয়ার নির্দেশে ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী তাঁর কোম্পানি নিয়ে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে থাকতে বাধ্য হন। এরপর, এই রেজিমেন্ট ও কোম্পানি বোয়ালখালির করলডেঙা পাহাড়ে পৌঁছে। এভাবে শুরু হয় কালুরঘাট প্রতিরোধ যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ সন্ধ্যা ৭.৩০ টায় ২০ জন সৈনিক নিয়ে মেজর জিয়া কালুরঘাট যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রামগড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পরবর্তীতে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত এই প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে কালুরঘাটের পতন ঘটে।
গ্রন্থটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল কালুরঘাটের পতনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হওয়া কালুরঘাট প্রতিরোধ যুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।
গ্রন্থটিতে লেখক শামসুল আরেফীন এই প্রতিরোধ যুদ্ধের বিস্তারিত ইতিহাস সংগ্রহ করে কালুরঘাট প্রতিরোধ যুদ্ধ শিরোনামের প্রবন্ধের মাধ্যমে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভিত্তিক অনেকগুলো প্রবন্ধ এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কালুরঘাট প্রতিরোধ যুদ্ধসহ এই প্রবন্ধগুলো রচনায় লেখককে ফিল্ড ওয়ার্কের উপর নির্ভর করতে হয়েছে অধিক। কালুরঘাট প্রতিরোধ যুদ্ধ প্রবন্ধটির সংক্ষিপ্ত রূপ এবং অন্যান্য প্রবন্ধের মধ্য থেকে সুবেদার মেজর টি এম আলী বাহিনী, কেংড়াছড়ি অপারেশন, ১৫৫ নম্বর মাহবুবুর রহমান গ্রুপ, চিরিঙ্গা গণহত্যা, রানীরহাট যুদ্ধ, রাঙ্গুনিয়া তহশিল অফিস অপারেশন, রাঙ্গুনিয়া ফরেস্ট অফিস রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন প্রভৃতি প্রবন্ধ ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন প্রজেক্ট, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ’-এ ইতোমধ্যে প্রেরণ করা হয়েছে বলে গ্রন্থটির ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন লেখক।
উল্লেখ্য, শামসুল আরেফীন দীর্ঘকাল ধরে লোকগবেষক হিসেবে এপার-ওপার বাংলার সাহিত্যাঙ্গনে বেশ পরিচিত। তিনি লোকসাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ ও অন্যান্য বিষয়ে চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশন থেকে অনেকগুলো গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। ‘কালুরঘাট প্রতিরোধ যুদ্ধ ও অন্যান্য’ ছাড়া তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম: আস্কর আলী পন্ডিত: একটি বিলুপ্ত অধ্যায় (ফেব্রুয়ারি ২০০৬, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১১২), বাঙলাদেশের লোককবি ও লোকসাহিত্য ১ম খন্ড (ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১২৮), বাঙলাদেশের লোককবি ও লোকসাহিত্য ২য়-৪র্থ খন্ড (জানুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৪০), আস্কর আলী পন্ডিতের দুর্লভ পুথি জ্ঞানচৌতিসা ও পঞ্চসতী প্যারজান (সংগ্রহ ও সম্পাদনা; ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৮০), বাংলাদেশের বিস্মৃতপ্রায় লোকসঙ্গীত ১ম খন্ড (সংগ্রহ ও সম্পাদনা; ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৪৩২), বাঁশরিয়া বাজাও বাঁশি (পল্লীগানের গ্রন্থ; ২০১২ সালে ‘বাংলাদেশের বিস্মৃতপ্রায় লোকসঙ্গীত ১ম খন্ড’ গ্রন্থভুক্তির মাধ্যমে প্রকাশিত), আস্কর আলী পন্ডিত: ৮৬বছর পর (সংগ্রহ ও সম্পাদনা; ফেব্রুয়ারি ২০১৩, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৬০), গাঙ্গেয় বদ্বীপের অনন্য সঙ্গীতজ্ঞ: স্বপন কুমার দাশ(সম্পাদনা; সরগম একাডেমি, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩২), আঠারো শতকের কবি আলী রজা ওরফে কানুফকির (ফেব্রুয়ারি ২০১৭, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১২০), আহমদ ছফার অন্দরমহল (ফেব্রুয়ারি ২০০৪, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৪৪), রুবাইয়াত-ই-আরেফীন (কাব্য, ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬৪), বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার দুর্লভ দলিল (ফেব্রুয়ারি ২০১৬, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১২০), সূর্য-পুত্র (কাব্য, ফেব্রুয়ারি ২০১৮, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬৪), কবিয়াল মনিন্দ্র দাস ও তাঁর দুষ্প্রাপ্য রচনা (২০১৮) প্রভৃতি। শামসুল আরেফীনের এসব গ্রন্থ বা তাঁর দীর্ঘদিনের লোকগবেষণা নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে অনেকবার অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি টিভি চ্যানেল ‘মাছরাঙা’ গত ২৭ ফেব্রæয়ারি ২০১৮, সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত পূর্ণ এক ঘন্টা ব্যাপী এই লোকগবেষণা নিয়ে চ্যানেলটির ব্যাপক জনপ্রিয় ‘রাঙাসকাল’ নামক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেছে। এশিয়ান টিভিও এই লোকগবেষণা নিয়ে সম্প্রচার করেছে একটি অনুষ্ঠান।