কালুরঘাট এলাকায় নতুন সেতু হোক ‘মইন উদ্দিন খান বাদল’ এর নামে

88

‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা,
কে বলে আজ তুমি নাই,
তুমি আছ মন বলে তাই- – – -’

শ্যামল মিত্রের এই গানটি মনে পড়ে গেল আজ। কারণ, দাফন শেষ হতে না হতেই ফুলে ফুলে ঢেকে গেল তাঁর কবর! কথা ছিল কালুরঘাট এলাকায় নতুন সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু না হলে, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ থেকে ‘পদ’ ত্যাগ করবেন। কিন্তু সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলনা, পদ’ ত্যাগের আগেই হয়ে গেল ‘জীবন’ ত্যাগ। গত ৭ নভেম্বর তারিখে ভোর ৫ টার সময়ে ভারতের বেঙ্গালুরে নারায়ণ হৃদরোগ ইনস্টিটিউট-এ নিয়মিত চেকআপ করতে গেলে, হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি। নিশ্চয় বুঝতে দেরী হয়নি কারো, কার কথা বলছিলাম? হ্যাঁ, বলছিলাম বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক বাহক, বীর চট্টলার অহংকার, সংসদে অনলবর্ষী বক্তা, মুক্তিযোদ্ধা, কেন্দ্রীয় জাসদ এর কার্যকরী সভাপতি, চট্টগ্রাম ৮ আসনে পরপর ৩ বার নির্বাচিত হ্যাট্রিক সংসদ সদস্য জনাব মইন উদ্দিন খান বাদল সাহেবের কথা।


সেই দিন ছিল ৭ নভেম্বর, চলমান জেএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রসচিবের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি প্রশ্ন আনতে বোয়ালখালী থানার উদ্দেশ্য গাড়িতে উঠি। সম্ভবতঃ সকাল ৭টার দিকে জনৈক ব্যক্তি থেকে অবিশ্বাস্য ও অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ পায়, মইন উদ্দিন খান বাদল আর নেই। সপ্তাহ কয়েক আগেও বোয়ালখালীতে এসেছিলেন। বছর দুয়েক আগে ব্রেণ ষ্ট্রোক হবার পর থেকে এমনিতেই অসুস্থ ছিলেন, এছাড়া হার্টেও সমস্যা ছিল। কিন্তু মৃত্যু হবার মত বড় ধরনের কোন প্রকার অসুখের খবর পায়নি। তাই বিশ্বাস করতে না পেরে মোবাইলে অনলাইন নিউজ দেখতে থাকি। না, অনলাইন পত্রিকাসমূহে কোন প্রকার ব্রেকিং নিউজ নাই। এরপর উনার একজন কাছের মানুষ পশ্চিম গোমদন্ডী বশরত নগর স্কুলের সম্মানিত সভাপতি ইব্রাহীম ভাই থেকে নিশ্চিত হয় শোনা সংবাদ সত্য, আমাদের সবার প্রিয় মইন উদ্দিন খান বাদল সাহেব আর নেই। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে দেখলাম, কত শত শত শোকের স্ট্যাটাস! অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের আবেগিক স্ট্যাটাসে, মইন উদ্দিন খান বাদলের সাথে তাদের নিজ নিজ ছবি। এই থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়, সংসদ সদস্য হয়েও জাতি ধর্ম বর্ণ দল মত ছোট বড় ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই সহজে তাঁর কাছে যেতে পারতেন। একই সাথে প্রমাণিত হয়, তিনি জনপ্রিয় ও গণমানুষের নেতা ছিলেন।
মইন উদ্দিন খান বাদল সাহেবের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ’৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পরে। ঐ সময় তিনি আমাদের পাড়া এলাকায় একা একটি গাড়ি নিয়ে এসে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে চাল ডাল তেল চিড়া চিনি ত্রাণ হিসাবে বিতরণ করেছিলেন। এরপর বিভিন্ন সভা সমিতিতে, অনুষ্ঠানে বহুবার দেখা হয়েছে। আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম তাঁর মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা শুনতে। অবাক হয়ে যেতাম ভাবনার গভীরতা ও সুউচ্চ চিন্তা দেখে।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে, তাঁকে প্রথমবারের মত সংসদে দেখতে পেলাম। তখন বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ছিলেন সংসদের স্পিকার। সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে কোন একটি বিষয়ে আলোচনার সময় স্পিকার আব্দুল হামিদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম-১০ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব মইন উদ্দিন খান বাদল আপনার সময় ২ মিনিট।’ তখন বাদল সাহেব দাড়িয়ে অত্যন্ত ভাবগম্ভীর হয়ে বলিষ্ঠ কন্ঠে বলেন, ‘মিঃ স্পিকার, আমার দুই মিনিট দরকার নাই, এক মিনিটে শেষ করব, আর বাকী এক মিনিট আপনার প্রিয়ভাজন অন্য কাউকে দিয়েন’ বলে বক্তৃতা শুরু করেন। এরপর তাঁর বক্তৃতায় ঐতিহাসিক তত্ত¡ তথ্য উদ্ধৃতি সমৃদ্ধ উপস্থাপনের অবস্থা দেখে, স্পিকার একাধিকবার সময় বাড়াতে বাধ্য হয়েছিলেন। এছাড়া তাঁর সকল সময় বক্তব্য ছিল অত্যন্ত গভীর তাৎপর্যপূর্ণ, জ্ঞানভিত্তিক ও আদর্শিক সুউচ্চ চিন্তাসম্পন্ন। দর্শক শ্রোতা সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে বাধ্য হত। যা প্রধানমন্ত্রীসহ বহু মন্ত্রী নেতা অকপটে স্বীকার করেছেন। ’৬০ এর দশকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলেও, মইন উদ্দিন খান বাদল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন, এবং আমৃত্যু সমাজতন্ত্রের সাথে যুক্ত থাকেন। উল্লেখ্য তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে, চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধে অন্যতম নেতৃত্ব দানকারী ছিলেন তিনি।
সত্য কথা অপ্রিয় হলেও বলতে হয়; আমার দেখা ও জানা মতে স্বাধীনতাত্তোর বোয়ালখালীতে সংসদ সদস্যগণের হাত ধরে যে সকল উন্নয়নমূলক কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে, সরকার দলের সংসদ সদস্য না হওয়ার সত্তে¡ও কেবল মইন উদ্দিন খান বাদলের সময়ে দৃশ্যমান উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। যেমন- বোয়ালখালী উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন, গ্রামীণ জনপদ উন্নয়ন, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন, কর্ণফুলীর নদীর ভাঙ্গন রক্ষা বাঁধ, ভান্ডালজুড়ি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয় সরকারিকরণ, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ ইত্যাদি। এছাড়া শিক্ষা স্বাস্থ্য ক্রীড়া সড়ক কালভার্ট ইত্যাদি উন্নয়নের মাধ্যমে বোয়ালখালীকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। বলা যেতে পারে তাঁরই আমলে বোয়ালখালী উপজেলা আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। বেঁচে থাকলে হয়ত উপশহরে রূপ নিত শহরসংলগ্ন এই বোয়ালখালী উপজেলা। এছাড়া তাঁর নির্বাচনী এলাকা শহর অংশে, আশেকানে আউলিয়া ডিগ্রী কলেজ সরকারিকরণ, ষোলশহরে টেক্সটাইল এন্ড জুট ইনস্টিটিউট, মোহরায় বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, চান্দগাঁও এলাকায় এক হাজার কর্মজীবী নারীর বাসস্থান নির্মাণ, কর্ণফুলীর তীরে অত্যাধুনিক সরকারি গুদাম ইত্যাদি অনেক ধরনের বহুমুখী উন্নয়ন করে গেছেন।
এখন কথা হচ্ছে, মইন উদ্দিন খান বাদলের মৃত্যুর পর আমরা তাঁর আত্মার মাগফেরাত বা শান্তি কামনা করেছি। আমি মনেকরি তাঁর আত্মা শান্তি পাবে তখনই, যখন কালুরঘাট এলাকায় নতুন সেতু নির্মাণ হবে। কারণ জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি কালুরঘাট এলাকায় নতুন রেল কাম সড়ক সেতুর জন্যে সংসদের ভিতরে বাইরে সর্বাত্মক সংগ্রাম করে গেছেন। এমনকি ৩১ ডিসেম্বর এর মধ্যে সেতুর কাজ শুরু না হলে তিনি পদত্যাগ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যা (সেতু নির্মাণ) নির্বাচনি প্রচারণায় বোয়ালখালীবাসীকে প্রতিশ্রæতিও দিয়েছিলেন। এমনকি শেষপর্যন্ত এই-ও বলেছেন, সেতুর জন্যে যদি দীর্ঘ সময়ের জাসদ রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে হয়, সেতুর প্রয়োজনে তিনি তাতেও সম্মতি আছেন।
এখন কথা হচ্ছে সেতু হবে হয়ত, কিন্তু সেতুর স্বপ্নদ্রষ্টা, সেতুর জন্যে আমৃত্যু লড়াকু সৈনিক মইন উদ্দিন খান বাদল দেখবেন না। তাই সেতু হলেও এলাকায় সর্বসাধারণের মনের ভিতর স্বাভাবিক ভাবে শূন্যতা ও হাহাকার বিরাজ করবে। এই অবস্থায় আমার দাবি থাকবে, কালুরঘাট এলাকায় দ্রæত সড়ক কাম রেল সেতু নির্মাণ করে সেতুটি তাঁরই নামে নামকরণ করা হোক, যাতে করে তাঁর আত্মা শান্তি পায়, আর তিনিও যাতে সেতুর মাধ্যমে বেঁচে থাকেন যুগ যুগ ধরে। যদিও বা তিনি এমনিতেই, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন বিরল প্রজ্ঞাবান অসাম্প্রদায়িক আদর্শিক অসাধারণ রাজনীতিবিদ ও বিজ্ঞ বক্তা হিসাবে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন আপামর জন সাধারণের মনের মণিকোঠায়।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক