কালজয়ী এক মহাপ্রাণ

63

বাবু মিয়া। সম্ভ্রান্তÍ মুসলিম জমিদার পরিবারে যার জন্ম। পিতা নুরুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন এডভোকেট। আইন বিষয়ে কৃতিত্বের সাথে পড়াশোনা শেষ করেও পারিবারিক জমিজমা, বিষয় সম্পত্তি তত্ত¡াবধানের ফাঁকে আইন চর্চা বা আইনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার ফুসরৎ তাঁর কখনোই হয়নি। কিন্তু, তাঁর পারিবারিক জমিদারিত্বের বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে আসেন পুত্র বশিরুজ্জামান চৌধুরী ও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। এলাকার মানুষ বাবু যাদেরকে অত্যন্ত আপন ভেবে বশির মিয়া ও বাবু মিয়া বলেই ডাকতেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে শিল্পপতি ব্যবসায়ী হিসেবে সাফল্যের চরম শিখরে আরোহন করেছিলেন ১৯৪৫ সালের ৩ মে চট্টগ্রামের আনোয়ারার হাইলধরে জন্ম নেয়া বাবু মিয়া। তিনি দুই দুইবার চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ছাড়াও দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এবং ওআইসিভুক্ত দেশের আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীক সংগঠন তথা চেম্বারের সভাপতি ছিলেন। তথাপি তিনি ব্যবসায়ী পরিচয়ের চেয়েও একজন রাজনৈতিক নেতা পরিচয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। জমিদারী জাঁকজমকে, জৌলুস, সুখ, আহলাদ আর আতিশর্যে যার জীবন কাটার কথা, যার ছিল আইনজ্ঞ জমিদার পিতা, ছিল প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বড় ভাই সেই রাজনীতিপ্রিয় আখতারুজ্জামান চৌধুরীকে রাজনৈতিক কারণে হতে হয়েছে ফেরারী, সইতে হয়েছে কারাভোগ। গ্রামের হাইলধর স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে আনোয়ারা হাই স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল হয়ে পটিয়া হাই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন করে ঢাকার নটরডেম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়া অবস্থায় বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হয়ে শেষে ১৯৬৪ সালে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন এসোশিয়েট ডিগ্রি লাভ করেন।
ক্রম বিকশিত টুঙ্গিপাড়ার খোকা যখন জনতার মুজিব হয়ে ওঠেছিলেন, মাধ্যমিকে পড়া কৈশোরোত্তীর্ণ হাইলধরের বাবু মিয়া তখন তাঁরই সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ এক তরুণ। ১৯৫৬ তে গঠিত অবিভক্ত চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের নির্বাহী সদস্য এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি (তথ্য সূত্র-চট্টল গবেষক, ইতিহাস পর্যালোচক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক নাছির উদ্দিন চৌধুরীর লেখা দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর প্রকাশিত প্রবন্ধ)।
মাঝে কয়েক বছর উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে দেশে এসে ১৯৬৫ সালে বড় ভাইয়ের সাথে ব্যাবসায় নিয়োজিত হলেও রাজনীতিপ্রিয় মানুষটি দেশের ক্রান্তিলগ্নে কেবল অর্থের পিছনে না ছুটে ১৯৬৭ সালে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং বঙ্গবন্ধুর নৈকট্য লাভ করেন। সত্তরের নির্বাচনে আনোয়ারা থেকে নির্বাচিত হন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। পাকিস্তান সরকার বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে তাঁর পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউজ হয়ে ওঠে সংগ্রাম কমিটি চট্টগ্রামের অলিখিত কার্যালয়। এখানে বসেই চট্টগ্রামের নেতারা আন্দোলন সংগ্রামের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ নিয়ে থাকতেন। ১৯৭১ সালের ২৫মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণাটির টেলিগ্রাফ চট্টগ্রাম পৌঁছুলে এই জুপিটার হাউজ থেকেই সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। পাঠানো হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে আখতারুজ্জামান চৌধুরী পাড়ি জমান ভারতে। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে তাঁকে এই সরকারে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য করা হয়। পরিবর্তীতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যসহ নানান দেশে কাজ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাবেক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে তিনি বাংলাদেশের গণপরিষদ সদস্য হন। দায়িত্ব নেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসেবে।
আন্তর্জাতিক চক্রান্তে দেশের বিপথগামী সেনা কর্তৃক ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ঠ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে এবং ৩ নভেম্বর জেলহত্যায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর আওয়ামীলীগের ওপর দুর্যোগ নেমে আসে। জনতার বাবু মিয়াকে বেছে নিতে হয় ফেরারী জীবন। কিন্তু, থেমে থাকেননি তিনি। সুযোগ বুঝে নিজের মেধা, শ্রম আর অর্থ দিয়ে অন্ধকার দুর্দিনে পতিত আওয়ামীলীগকে সারাদেশে সংগঠিত করার প্রয়াস চালান তিনি। এতে ক্ষিপ্ত স্বৈরাচারী সেনা শাসক জিয়াউর রহমানের কোপানলে পড়ে কারাভোগ করতে হয় প্রিয় নেতা বাবু ভাইকে।
১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে এসে সভানেত্রীর দায়িত্ব নিয়ে দল গোছানোর কাজে নামলে আস্থার সাথে পাশে থাকেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জননেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভাই।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের তপ্ত সময়ে ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে বাবু ভাইয়ের মত মহীরুহের সুশীতল ছায়া অনুভব করেছি প্রথম। পর্যায়ক্রমে পশ্চিম পটিয়া থানা ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের আহŸায়কের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ মহীয়ান নেতার ঘনিষ্ট সান্নিধ্য ও নেতৃত্ব লাভের সুযোগ আমার হয়েছে। আমি দেখেছি, মানুষকে তিনি খুব বেশি ভালবাসতেন। পছন্দ করতেন শত সহ¯্র মানুষের কাছে থাকতে এবং মানুষের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতেন। তিনি নিজগ্রাম, চট্টগ্রাম, ঢাকা যেখানেই যেতেন শত সহ¯্র মানুষ তাকে ঘিরে গমগম করত। তিনি মানুষের সুখ দুঃখের কথা অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে শুনতেন। ছোট বড় কোন অসংগতি সহজে তার চোখ এড়াতে পারতনা। ভির ঠেলে বৈঠকখানায় যে লোকটি তাঁর কাছে যেতে পারেননি, বাসা হতে বের হওয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে তিনি তাকে কাঁছে ডেকে তাঁর সমস্যার কথা শুনেছেন। তিনি কথা বলার চেয়ে শোনাটায় বেশি গুরুত্ব দিতে পারতেন বলেই হয়তো, তাঁকে দেখেছি অনেক জটিল সমস্যার সমাধান অতি অল্প কথাতেই সহজে দিতে পারতেন। মানুষের কথা শোনার মত ধর্য্য ও ইচ্ছা শক্তি তাঁর মধ্যে ছিল বলেই হয়তো তিনি সমস্যা গভীরে যেতে পারতেন এবং সহজে সমাধান খুঁজে বের করে আনতে পারতেন। দেখেছি, অনেকেই তাঁর কাছে তাদের পারিবারিক, সামাজিক সমস্যা নিয়ে আসতেন। মানুষের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংকটে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, পরামর্শ ও মন্তব্য তিনি এক উক্তিতে দিয়ে দিতেন। তাঁর সিদ্ধান্ত, পরামর্শ ও মন্তব্য সবসময় সব জায়গায় সার্বজনীনতা পেয়েছে গুরুত্বের সাথে।
১৯৪৫ এর ৩ মে হাইলধরে আবির্ভুত মহাপ্রাণ প্রিয়নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভাই ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাভেথ হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের আগে ১৯৮৬, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে আনোয়ারা-পশ্চিম পটিয়া থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। বিভিন্ন সময়ে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য, শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক, সভাপতি মÐলীর সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন এবং আমৃত্যু চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ছিলেন। এছাড়া তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এর দায়িত্ব পালন করছিলেন। এই মৃত্যুঞ্জয়ী কালপুরুষ, মহাপ্রাণ- মহাজীবনের অবসানে তাঁর কফিন যখন চট্টগ্রাম আসে বুঝলাম, তিনি কেন মানুষকে এত ভালবাসতেন। তাঁর দাফনোত্তর নামাজে জানাজায় মানুষের ঢল রূপ নিয়েছিল বিশাল জনসমুদ্রে। এ বিশাল জনসমুদ্রে মিলিত জনতার আবেগ ছাপিয়ে গিয়েছিল প্রশান্ত মহাসাগরের বিশালতাকেও। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, পরিবার পরিজন, ব্যবসায়ী ছাড়াও অনেক মানুষকে দেখেছি গুমরে গুমরে কাঁদছিল যাদের পরিচয় কেউ জানেনা। অত্যন্ত সাধারণ মানুষ যারা রাজনীতি বোঝেনা, বোঝেনা ব্যবসা বাণিজ্য। তারা ছিল কেবল বাবু ভাইয়ের আত্মার আত্মীয়, ভালবাসার মানুষ, উপকারলাভী।
মৃত্যুর ৭ বছর পরও এখনো প্রিয়নেতা বাবু ভাইকে হারানোর স্মৃতি মনে করে শত সহ¯্র মানুষ নীরবে নিভৃতে চোখ মুছে কান্না লুকায়। বাবু ভাইয়ের সাথে রোমাঞ্চকর ও আনন্দের সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করে এখনো হাজার হাজার মানুষের চোখের কোনে ঝিলিক দেয় স্মিত হাসির রেখা।
স্মৃতিতে, জাগরণে
আদর্শে, অনুপ্রেরণায়
অনুভবে, স্পন্দনে-
গণমানুষের হৃদয়ের মণিকোটায় বেঁচে আছেন প্রিয়নেতা, থাকবে অমর হয়ে ধরে অনন্তকাল।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা,প্রাবন্ধিক