কাজ কম করা স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ, তবে সুবিধাও আছে

61

অনেক পরিচিত একটি গতানুগতিক গল্প হলো- একজন নিবেদিত কর্মী অবশেষে অবসর গ্রহণ করেন এবং তারপরে অলস দিনগুলো কাটানোর প্রত্যাশায় বিহ্বল হয়ে যান। ওইসব মানুষের জন্য যাদের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য পেশাগত পরিচয় ঢাকা পড়ে যায়, কাজ ছাড়া জীবন কেবল জীবনের ফ্যাকাসে সংস্করণ। প্রদত্ত কাজ একটি সপ্তাহকে অর্থবহ করতে এবং কাঠামো গড়তে সহায়তা করে, ভবিষ্যতের অবসর সময়টিকে বিস্ময়কর এবং অস্বাস্থ্যকর মনে হতে পারে এবং এমনকি অপরাধ ও মাদক অপব্যবহারের মতো অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার মতো মনে হতে পারে।
বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এবং আমেরিকায় কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ভেনচার ফর আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্ড্রু ইয়াং বলেছেন, ‘তথ্য, সাধারণ জ্ঞান এবং মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে এটি স্পষ্ট যে অনেক মানুষ কাজ না করার কারণে সংগ্রাম করছে। আমরা অলস; আমাদের বেশি সময় থাকলেও আমরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে চাই না। আর সময়ের সাথে সাথে আমরা প্রচুর ভিডিও গেম খেলতে শুরু করি এবং বেশি মদ পান করি’। সমাজ সাধারণত কর্মহীন মানুষের প্রতি সদয় হয় না বলেও তিনি মনে করেন।
কিন্তু মানুষ যদি সমাজপন্থী হয়ে যায়, তাহলে? এর জন্য একটা ধাক্কার প্রয়োজন। কিন্তু মানুষ কি আরও সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারে, মিছিল করতে পারে বা তাদের সম্প্রদায় বা রাজনীতিতে জড়াতে পারে? খবর বিবিসি বাংলার
ব্যস্ত থাকা আর ‘কাজ করা’ এক বিষয় নয়
পয়সার বিনিময়ে চাকরি করা সক্রিয় জীবন যাপনের একমাত্র উপায় নয়। উদাহরণস্বরূপ, জাপানি ধারণা ইকিগাই মানুষকে জীবনের আনন্দ খোঁজার জন্য এমন সব কাজের ওপর মনোনিবেশ করতে উৎসাহ দেয় যা তাকে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে সাহায্য করবে। ২০১০ সালে জাপানি নারী এবং পুরুষদের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, তাদের এক তৃতীয়াংশের কম তাদের ইকিগাই মেনে কাজ করে। এই ইকিগাই বলতে বোঝায় ব্যক্তির শখ, সম্পর্ক এবং কিছু কাজ যার জন্য পারিশ্রমিক মেলে না ঠিকই; তবে তাদের অবসরকে অর্থবহ করে তোলে।
অবসর সময় সবসময় আলসে সময় নয়
বর্তমানে, নারীদের দীর্ঘমেয়াদে অতিরিক্ত কাজ করার প্রবণতা রয়েছে, তবে তাদের সেই কাজকে বেতনভোগী কর্মক্ষেত্রগুলোর মতো যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। যেমন- বাচ্চাদের দেখাশোনা করা, বয়স্ক পিতা-মাতার খেয়াল রাখা এবং ঘরোয়া, সামাজিক এবং সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে করতে তাদের অনেক সময় লেগে যায়।
বেতনভুক্ত কাজের বোঝা কমিয়ে এই বেতনহীন কাজের জন্য পর্যাপ্ত সময় এবং শক্তি বের করতে হচ্ছে- যেটা এখন অনেক দেখা যায়।
ইতোমধ্যে অবৈতনিক যত্নের জন্য সময় বা শক্তি নিরস্ত করতে পারে- তবে কোম্পানি এবং সরকারের এ ধরণের সেবায় কম বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। কেননা তারা বিনা বেতনে কাজ করা এসব মানুষের ওপর নির্ভর করে।
বেশি দীর্ঘ সপ্তাহ ব্যয়বহুল হতে পারে
যাদের সাপ্তাহিক ছুটি অনেক দীর্ঘ- তবে বেতন আগের মতোই- তারা নিজেদের এই বাড়তি সময় গল্ফ খেলা থেকে শুরু করে বয়স্ক ব্যক্তিদের সেবা দেয়ার মতো নানা কাজের মাধ্যমে কাটান। লন্ডনের বিপণন ও যোগাযোগ পরামর্শদাতা আলেকজান্দ্রা হার্টনাল আবিষ্কার করেছেন যে, ফ্রিল্যান্সিংয়ে যাওয়ার পর তার আরাম আয়েশ বিদায় নিয়েছে। তাই তিনি সপ্তাহে চারদিনের বেশি কাজ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি অতিরিক্ত অর্ধেক দিন ব্যয় করেন তার পছন্দের কাজটি করে। আর সেটি হলো পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয়ে গ্যালাপাগোস কনজারভেশন ট্রাস্টের হয়ে যোগাযোগের কাজ করেন তিনি। এই অংশটি তার ব্যক্তিত্বের সাথে জুড়ে গেছে: তিনি সক্রিয় থাকতে পছন্দ করেন। তবে হার্টনাল এটাও স্বীকারও করেন যে তার আর্থিক নিরাপত্তা তার স্বেচ্ছাসেবার কাজকে সম্ভব করে তুলেছে।
এটি আরও বৈষম্য তৈরি করতে পারে
জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের লেবার হিস্টারিয়ান ফিলিপ রেক জানান যে, সপ্তাহে চার দিন কাজ করা, চাপমুক্তভাবে কাজ করার একটি দিক হতে পারে। যা হার্টনালের মতো সচ্ছল পেশাদার কর্মচারীদের উপকারে আসে। আবার তাদেরও উপকারে আসছে যাদের কাজের প্রয়োজন। স্বল্প বেতন বা অবসর পরবর্তী সীমিত সঞ্চয় নিয়ে যারা অনিশ্চিত কর্মক্ষেত্রে কাজ করছেন, তাদের জন্য বাইরে সখের কাজ করা অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা মনে হতে পারে। ‘অবসর সময়’ সম্ভবত একটি বিভ্রম হতে পারে, কারণ তারা তাদের প্রধান আয়ের পরিপূরকতার জন্য অন্য কোনো উপায় খুঁজতে থাকে।
যেহেতু তারা আন্তরিকভাবে তাদের মূল আয়ের পাশাপাশি আয়ের আরেকটি পরিপূরক উপায় খুঁজছে তাই রিক পরামর্শ দিয়েছেন, ‘আমরা একসাথে একমত হতে পারি যে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার পরিবর্তে ২৮ ঘণ্টা কাজ করাই আদর্শ, এবং এই সময়ে অর্জিত আয় যথেষ্ট। তবে খন্ডকালীন শ্রম, মিনি জবস বা শূন্য-ঘণ্টা চুক্তিগুলোর বিস্তৃতি দেখে ধারণা করা যায় যে শিগগিরই এ বিষয়ে ঐক্যমত্য পৌঁছানো যাবে’।
সপ্তাহে যারা এরকম হাতে গোনা কয়েক দিন কাজ করতে চান তাদের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে এই সময়ের মধ্যে কাজ করে সবার জন্য আদর্শ জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করা যাবে কিনা। যার মধ্যে উঠে আসতে পারে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম, ন্যূনতম মজুরির হার বা কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনলেও বেতন না কাটার মতো প্রসঙ্গ।
এটি অন্যদের সাহায্য করার ফল দেবে না
একটি চ্যালেঞ্জ হলো কাজের বাইরে কিছু সময় বের করলেই কমিউনিটির মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো সম্ভব না। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্ট্রেলিয়ান স্টাডিজের অতিথি সভাপতি মেলানিয়া ওপেনহেইমার বলেছেন, অস্ট্রেলিয়ায় ‘কর্মক্ষেত্রে সক্রিয় মানুষরা হলেন ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা। অন্য কথায়, তারাই ব্যস্ততম ব্যক্তি- যারা সর্বাধিক স্বেচ্ছাসেবী কাজ করেন’।
এটির আংশিক কারণ হলো ‘স্বেচ্ছাসেবা’ অনেকের ধারণার চাইতে অনেক বেশি কিছু। বাচ্চাদের কোনো ফুটবল ম্যাচের রেফারি হিসেবে কাজ করা, স্কুলের মেলায় অংশ নেয়া, নতুন অভিবাসীদের বসতি স্থাপনে সহায়তা করা, নাগরিক বিজ্ঞানের প্রকল্পে অবদান রাখা, ধর্মীয় উৎসব আয়োজনের পরিকল্পনা করা।
ওপেনহিমারের দৃষ্টিতে, সময় এই ধরণের কাজের প্রধান বাঁধা নয়- তবে সম্ভাব্য স্বেচ্ছাসেবীদের সমর্থন করা এবং তাদেরকে সুযোগ দেয়া গুরুত্বপূর্ণ।
তবে সব খারাপ নয়… : সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজ করার পর মানুষ আসলে তাদের অবসরে কি করবে তা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে কোনো জরিপ নেই। তবুও মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে সপ্তাহে কম সময় কাজ করার অনুরোধ করে যাচ্ছে যেন তারা আরও অবসর পায়। যাতে করে তারা তাদের স্বাস্থ্য, উৎপাদনশীলতা, পারিবারিক সময় এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পেছনে সময় দিতে পারে।
১৯৫৪ সালে, জার্মান রাজনীতিবিদ রিক সপ্তাহে ছয় দিন কাজের পরিবর্তে পাঁচ দিন কাজ করা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘যদি আমরা একবার মুক্ত শনিবার পাই, তাহলে আমাদের অনুশীলনের সময় হবে; আমরা সিনেমা, থিয়েটার বা সার্কাস ঘুরে দেখতে পারবো; আমাদের মোটরবাইক এবং স্কুটারগুলো নিয়ে গ্রামাঞ্চলে ঘুরে আসতে পারবো এবং আমাদের বাগানে কাজ করতে পারবো’। রিক বলেন, ‘একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হলো সপ্তাহে চার দিনের কাজের ধারণাটি চাকরিজীবী এবং চাকরিদাতাদের যথেষ্ট সমর্থন পেয়েছে। স্বল্প-ঘণ্টা কাজ করার দাবি আদায়ে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ট্রেড ইউনিয়নকে এই স্বল্প কর্মঘণ্টা কার্যকর করতে কঠোর লড়াই করতে হয়েছে’।
রিকের ধারণা- এক শতাব্দী আগের তুলনায় বর্তমানের নিয়োগকর্তারা বেশি পরোপকারী, তবে তারা সম্ভাব্য উৎপাদনশীলতা লাভের বিষয়ে সতর্ক রয়েছেন। তবে কাজের সপ্তাহ কমিয়ে আনার পক্ষে শ্রমিকদের এই আন্দোলনের একটি দিক নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যে তারা এই দাবির মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের চাইতে ব্যক্তিগত অবসর সুবিধার দিকে বেশি মনোনিবেশ করছে।
সম্পদ পরিমাপের অন্যান্য উপায় : দীর্ঘমেয়াদে, আমাদের এই কম কাজ করা কি আমাদের নিজেদের সংজ্ঞাকে বদলে দেবে কিংবা অন্যদের সাথে মিথস্ক্রিয়া করি সেটা বদলাতে পারে? যোগাযোগের পরামর্শদাতা হার্টনাল বলেছেন, ‘আপনার পরিচয়টি কাজের সাথে যুক্ত বলে আমি মনে করি। এবং তিনি বেতনভুক্ত কাজের জন্য এতো কম সময় ব্যয় করতে চান না। ভবিষ্যতে, তাহলে, ‘আপনি কি করেন?’ এই প্রশ্নটি ভয়ঙ্কর হতে পারে। কেননা এই প্রশ্ন থেকে শুধু বর্তমান চাকরির কথা ছাড়াও আরও বিভিন্ন উত্তর আসতে পারে। পাশাপাশি বৃহত্তর পরিসরে, কাজের রূপান্তর মানুষকে আরও কল্পনাপ্রবণ হওয়ার ভালো সুযোগ দেয়।
সারাথ দাওয়ালা ভারতের হায়দ্রাবাদের একজন সমাজবিজ্ঞানী এবং বেটার ইনকাম আর্থ নেটওয়ার্কের ভাইস-চেয়ারম্যান, এটি একটি দাতব্য সংস্থা যারা মানুষের মৌলিক আয় নিয়ে কথা বলতে উৎসাহ দেয়। তিনি বলেন, পৃথিবীতে শুধু কাজের উৎপাদনশীলতাই যথেষ্ট না। এখানে বড় ধরণের সফলতার সূচকের প্রয়োজন। যেমন ভুটানের গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস জরিপ যা দেশের সম্মিলিত সুখের হার পরিমাপ করে বা নিউজিল্যান্ডের সুস্থতা বাজেট যা পুঁজিবাদী অর্জনের চাইতে নাগরিকদের সুখকে জোর দেয়া হয়।
ভারতীয় উপজাতীয় গ্রামে প্রাথমিক আয় নিয়ে দাওয়ালার কাজটি ‘সংহতির প্রভাব’- এর পরামর্শ দেয়, প্রতিবেশীরা একে ওপরকে অর্থ ধার দেয় যেন তাদেরকে আকাশচুম্বী সুদের ঋণের ওপর নির্ভর করতে না হয়। এজন্য তারা বিবাহের মতো বিশেষ অনুষ্ঠানে অর্থ/সম্পদ সংগ্রহ করে থাকেন।
দাওয়ালা মনে করেন, সমাজ যেভাবে সময়কে সংগঠিত করে তা কাজ এবং অবসর, অথবা বেতনভুক্ত কাজ এবং সম্প্রদায়ের কাজের মধ্যে যে কৃত্রিম পার্থক্য, তার সাথে সাথে পরিবর্তন হতে পারে। ভবিষ্যৎ অনুমানযোগ্যভাবে অনিশ্চিত হতে চলছে বলেও দাওয়ালা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন. ‘এটাই আসলে যথার্থ সময় ভাববার যে আপনি ভবিষ্যতে অফিসে বেশি সময় ব্যয় করতে চান নাকি খরগোশ পেলে সময় কাটাতে চান’।