কাজী হাকিম দাদ চৌধুরী

25

আ ব ম খোরশিদ আলম খান

চা শিল্পে আজ চট্টগ্রামের যে ঔজ্জ্বল্যময় অবস্থান তার পেছনে রয়েছে অনন্য কৃতিত্বপূর্ণ অবদান কাজী হাকিম দাদ চৌধুরীর। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের বরেণ্য কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব। ১৯২৪ সনে হাটহাজারী উপজেলার পূর্ব ধলই গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে আলহাজ্ব হাকিম দাদ চৌধুরীর জন্ম। মরহুম কাজী দুলা মিয়ার পরিবারে বিত্ত বৈভবের মাঝে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি কখনো নিজেকে চারপাশের মানুষ থেকে আলাদা ভাবতেন না। হাকিম দাদ চৌধুরী শিশুকাল থেকে বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি হালদার পূর্বপাড়ে স্থানীয় রোসাংগিরি ইংলিশ মাইনর স্কুলে ও উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে প্রথম জীবনে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত থাকলেও পরে চা শিল্পের উন্নয়নে নিজেকে নিবেদিত রাখেন। হাকিম দাদ চৌধুরীর জীবন ছিল বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য। তিনি বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে ১৯৫২ সনে মিল্কভিটা ডেইরি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করে অনন্য ভূমিকা রাখেন। তিনি মিল্কভিটার নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে একে ব্যবসাসফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটান। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯১ সন পর্যন্ত নয় বারের মতো বাংলাদেশ চা সংসদ, চট্টগ্রাম এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ৫৪ সনে গ্লান্টার্স লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক, ১৯৭৫ সন থেকে গ্লাডস্টোন ওয়াইলি এন্ড কোম্পানির পরিচালক ও ১৯৯৫ সন থেকে চেয়ারম্যান, ১৯৮৫-৮৬ সনে লায়ন্স ক্লাব খুলশির প্রেসিডেন্ট, ১৯৮২ সনে কাটিরহাট মফিদুল ইসলাম মাদ্রাসার সহ সভাপতি ও মফিদুল ইসলাম এতিমখানার সভাপতি, ১৯৬৬-৬৯ সনে কাটিরহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি, ১৯৯৫ সন থেকে কাটিরহাট মহিলা কলেজের উপদেষ্টা, ১৯৭৩ সন থেকে বাংলাদেশ কমোডিটিস লিমিটেড এর পরিচালক, ১৯৯৫ সন থেকে প্রগ্রেসিভ ব্রোকারস লিমিটেড এর কার্যনির্বাহী পরিচালক, ১৯৯১ সনে লেবার কোর্ট মনোনীত সদস্য, ১৯৪৮-১৯৫২ সনে রিগ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কো. লিমিটেড এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক- এ ধরনের বহু শিক্ষামূলক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। হাকিম দাদ চৌধুরীর চা শিল্পের উন্নয়নে জীবনভর সম্পৃক্ততা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। বাংলাদেশ টি বোর্ডের সহায়তায় চা বাগান সম্প্রসারণ, চা উৎপাদন, বিপণন, চা বাগানের রোড, সেতু নির্মাণে এবং চা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
হাকিম দাদ চৌধুরী আজীবন মানবসেবায় নিবেদিত ছিলেন। তিনি বলতেন, মানুষের জন্ম শুধু আয় করে খাওয়া ও পরিবার নিয়ে বসবাস করার জন্য নয়। একজন মানুষের এ সমাজকে অনেক কিছু দেয়ার আছে। টাকা পয়সা ধন সম্পদ উপার্জন করার চেয়ে ব্যয় করাটা অনেক কঠিন, তিনি প্রায় সময় এই কথা বলতেন। তিনি সময়কে খুব মূল্য দিতেন। সময়কে কাজে লাগিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জনসেবায় সময় ব্যয় করার ওপর তিনি বেশ গুরুত্ব দিতেন। তিনি মনে করতেন, সময় খুবই মূল্যবান। তাই প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাতে হবে। অযথা সময়ের অপচয় করাকে তিনি খুবই ঘৃণ্য মনে করতেন। একজন মানুষ এতোগুলো সংস্থা-সংগঠনে কীভাবে সময় দিয়েছেন, এতোগুলো সংগঠন-প্রতিষ্ঠানে কীভাবে সম্পৃক্ত থেকেছেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। সময় সচেতন এবং কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন বলেই তিনি বহু সংস্থা-সংগঠন সফলভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হন। একজন দানবীর ও অতিথিপরায়ণ হিসেবেও তাঁর বিশেষ সুখ্যাতি রয়েছে। চা শিল্পে নিয়োজিত হাজার হাজার শ্রমিকদের ভাগ্যোন্নয়নে ও তাদের জীবনযাত্রা পাল্টে দিতে জীবনভর ব্যাপৃত ছিলেন কাজী হাকিম দাদ চৌধুরী। বাংলাদেশ চা সংসদের প্রাক্তন সহ সভাপতি সমাজসেবী মোরশেদুল আলম কাদেরী তাঁর এক লেখায় স্মৃতিচারণে বলেছিলেন কাজী হাকিম দাদ চৌধুরীর কর্মকীর্তির কথা। তিনি বলেন, শ্রম আদালতের একজন সদস্য হিসেবে তিনি হাকিম দাদ চৌধুরীকে দেখেছেন কীভাবে তিনি শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারের জন্য অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৬১ সনের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামসহ দেশের চা বাগানগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং চা বাগানগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিপণনে তখন সামনের কাতারে থেকে বিশেষ ভূমিকা রাখেন কাজী হাকিম দাদ চৌধুরী। তিনি তখন সরকারি নানা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ-সমন্বয় সাধন করে চা শিল্পের উন্নয়নে অবদান রাখেন। তাঁর স্মৃতি রক্ষায় প্রতিষ্ঠিত কাজী হাকিম দাদ চৌধুরী মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ২০১৭ সন থেকে হাটহাজারী ধলইয়ে গোল্ডকাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হচ্ছে। ১৮ দিনব্যাপী উক্ত টুর্নামেন্টের সমাপনী দিনে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল এম. হারুনুর রশীদ। তাঁরই জ্যেষ্ঠ পুত্র সমাজসেবী-সংগঠক আলহাজ্ব কাজী মহসীন চৌধুরী এ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে সমাজসেবার পাশাপাশি এলাকায় খেলাধুলার প্রসারে নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন। আজ হতে ১৯ বছর আগে ২০০১ সনের ১৭ সেপ্টেম্বর কাজী হাকিম দাদ চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। আমরা এ কীর্তিমান ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি এবং তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। লেখক : সাংবাদিক