কাক নিয়ে কাকা-কাকী…

631

বউ বাপের বাড়ি চলে এলো স্বামীর আচরণে বিরক্ত হয়ে, আর কখনো ফিরে যাবে না এই তার সংকল্প। কদিন পর স্বামী নিজে এলো শ্বশুরবাড়ি বউকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। বউয়ের সেই এককথা সে ফিরে যাবে না, স্বামীর বিরুদ্ধে তার নানান অভিযোগ। মাঝখানে শালিসকারক শ্বশুর তথা কন্যার বাপ নিজে। মেয়ের মনখে জামাই’র বিরুদ্ধে এত নালিশ শুনে তিনি জামাইকে বললেন, ‘দেখ তোমার বিরুদ্ধে আমার মেয়ের এত নালিশের পর মেয়েকে আমি তোমার সাথে কেমনে দিই?’ জামাতাম ‘ঠিক আছে সব দোষ আমার, কিন্তু আপনার মেয়েরও তো দোষ আছে।’ শ্বশুর। ‘আমার মেয়ের কি দোষ?’ জামাতা। ‘আপনার মেয়ে আমাকে একটু আদরও করতে জানে না।’ বউ রেগে তখন। ‘এই মিথ্যা কথা বলবেনা, কে বলেছে আমি আদর করতে জানি না?’ পাশে তখন তাদের মাস্টার মশাই ভাত খাচ্ছেন, তাঁকে দেখিয়ে বউ, ‘ঐ দেখ আমাদের স্যার, তোমার সাথে বিয়ের আগে আমি কতবার আমাদের স্যারকে আদর করেছি। বিশ্বাস না হয় উনাকে জিজ্ঞেস করো, স্যার একটু বলেন তো আমি আদর করতে জানি কিনা।’ স্যার সাক্ষী দিবেন কি? ভাতের গ্রাস সবেই মনখে দিয়েছেন গিলতে পারেননি, অদ্দূরে উঠে দৌঁড়। ইহজনমে তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না, হাহাহা।
এখন কার দোষ বেশি, স্বামীর না স্ত্রীর? সে হিসেব না হয় আপনারাই করুন, আমি চলুন উক্ত গল্পটির অবতারণা কেন করলাম তা খুঁজে বের করি। কদিন আগে দেখলাম কাক নিয়ে এক প্রকাশনা হয়ে গেল। অবশ্য প্রকাশনাটি সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ কোন জ্ঞান নেই, জ্ঞান যা লাভ হয়েছে তা পূর্বদেশ মারফত পরোক্ষভাবে। জানতে পারলাম প্রকাশনাতে অনেক জ্ঞানগর্ভ কাকা-কাকীগণ কাককে নিয়ে প্রচুর সারগর্ভ কা কা করেছেন। মাশাল্লাহ, কাক সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। কাক এই করে, কাক সেই করে, কাক নোংরা-আবর্জনা খেয়ে পরিবেশ বিশুদ্ধ করে, আমাদের উপকার করে। কাক নিয়ে কবিতা, গল্প-প্রবন্ধ, প্রবাদ-প্রবচন, রচনা, ইত্যাদি কাকের নানান গুণগান করেছেন। উল্লেখিত গল্পটির স্ত্রীর ন্যায়, সে যেমন খালি স্বামীর দোষ ধরেছে তাঁরাও তেমন কাকের শুধু গুণ বলেছেন। জানিনা দোষ কিছু তাঁরা নির্ণয় করেছেন কিনা কাকের। তবে স্বামীর মত কাকের হাজার গুণের মেলায় দোষ কিছু একটা ধরতে পারি কিনা দেখি। কাক সবকিছু পরিষ্কার করে মানি, কিন্তু তারে বসে যে মাথার উপর ছাড়ে তা কেমনে মানি। কি সুন্দর স্যুটেড, বুটেড হয়ে কিংবা শাড়ী-চুড়ি, মনখপালিশ, ঠোঁটপালিশ লাগিয়ে কত চমৎকার সেজেগুজে বের হল রাস্তায়। তারপর কাক বেটা তারের উপর থেকে পটাস করে ছেড়ে দিল সোজা মাথায়। তীরে এসে তরী ডুবার মত সত্তর বছরের পরিশ্রম যেন মনহূর্তেই মাটি হয়ে গেল।
ঘটনা একদম মাষ্টারের সাথে মিলে গেল না? স্বামীর হাজার দোষ সত্তে¡ও স্ত্রীর ঐ একটি দোষই যেমন স্বামীর সব দোষকে ঢেকে দিতে যথেষ্ট ঠিক তেমন হাজার গুণ সত্তে¡ও কাকের ঐ একটি দোষই তার সব গুণকে ঢেকে দিতে যথেষ্ট। কাক তার সারা বিশ্ব পরিষ্কার করে দেওয়ার গুণ দিয়েও মাথার উপর ছাড়ার দোষকে ঢাকতে পারবে না। দশমন দুধে একফোঁটা মনত পড়ার মত কাকের আজীবনের কৃতিত্ব ঐ একবার হাগার মধ্যদিয়ে শেষ। কারণএত সেজেগুজে বের হয়ে যার মাথায় তা পড়ে, একমাত্র সে’ই বুঝে কত ধানে কত চাল। ঠাটা পড়ার চাইতে কাকের বিষ্ঠা পড়াটা বড় বেদনার। আর তা যখন ঘটে, মনে হয় তখন কাকটাকে ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে। অতএব ক্ষমার অযোগ্য এমন দোষ থাকার পরও কাক কিন্তু সংযত হয় না, সময়-অসময় সে কারেন্ট অফ করেদিয়ে বসে থাকে! পঁচা-গলা খেয়ে মাতাল হয়ে তারা তারে বসে করে মাতলামি। তাতো বটেই, মদ খেলে যেমন নেশা হয়, পঁচা খেলেও তেমন নেশা হয়। কারণ মদ তো হয় পঁচা থেকেই, ভাত-পঁচা, ফল-পঁচা, সব পঁচা থেকেই তো নেশা হয়। অতএব দুটি তারের দুই প্রবাহের নেশাগ্রস্ত দুই দল মাতাল কাকের অতি মহব্বতের ফসল গুড়–ম। ফলে তার শেষ, ট্রান্সফরমার শেষ, সুতরাং কারেন্ট শেষ। এবার এক সপ্তাহ্ অন্ধকারে দিন যাপন, কারণ তার ঠিক করতে তিন দিন, ট্রান্সফরমার বসাতে চার দিন, মোট সাত দিন কেরোসিন শিখায় কালক্ষেপণ।
অতএব এই জ্বালা কি আর সয়? কোথায় টেলিভিশন, কোথায় কম্পিউটার, কোথায় মোবাইল চার্জ, কোথায় ফ্যান-এসি-হিটার? সব বন্ধ, গোটাবিশ্ব হতে আপনি বিচ্ছিন্ন পুরা এক সপ্তাহ্। শালার কাক, আর সময় পেলি না, এতক্ষণ হাগার কোন খবর নেই। যেই মানুষ একটা সুন্দর করে সেজেগুজে তোর নীচ বরাবর এসেছে, অমনি শুরু হয়ে গেল তোর নিম্নচাপ। ছেড়ে তাকে পুরা বিশ্রী করে দিস। ডাস্টবিনে জটলা পাকাস পাকা, কিন্তু পঁচা-গলা খেয়ে তোরা তারে উঠে কেন মাতলামি করিস? ফলে নিজে মরিস আমাদেরও মারিস। সুতরাং এভাবে যদি কাকের দোষ বের করতে যাই তবে অনেক দোষ ধরা যাবে, তার চাইতে চলুন কাকের একটি ব্যর্থতার গল্প শুনি। এক ছিল কাক, একদিন তার ত্বীন ফল খেতে মন চাইল সে ত্বীন গাছে গেল। ত্বীন গাছ বলল, আমার ফল অতি পবিত্র, তার কথা পবিত্র কোরানে আছে। তুমি নোংরা-পঁচা খাও তাই তোমার ঠোঁট নাপাক, সুতরাং আমার ফল খেতে চাইলে তোমাকে আগে ঠোঁট ধুয়ে পবিত্র হয়ে আসতে হবে। কাক তখন গেল পুকুরে ঠোঁট ধুতে। পুকুর বলল, আমার পানিতে মানুষ অজু করে নামাজ পড়ে তুমি যদি তাতে ঠোঁট ধৌ তাহলে তা অপবিত্র হয়ে যাবে। অতএব তুমি একটি ঘটি এনে তাতে পানি নিয়ে ঠোঁট ধৌ। কাক তখন ঘটির জন্য কুমারের কাছে গেল। কুমার তাকে বলল মাটি এনে দিতে তাহলে সে ঘটি বানিয়ে দিবে।
কাক মাটির কাছে গেল, মাটি বলল মহিষের শিং দিয়ে তাকে কুঁড়ে নিতে। সে তখন মহিষের কাছে গিয়ে শিং চাইল। মহিষ বলল বাঘকে ডেকে আনতে যাতে বাঘ তাকে মেরে শিং নিতে পারে। কাক বাঘের কাছে গেল বাঘ বলল, আমার তো শক্তি নেই আমার জন্য গাভীরদুধ নিয়ে এসো। দুধ খেয়ে আমার বল হলে তবে আমি মহিষকে মারতে পারব। কাক তখন গাভীর কাছে গেল, গাভী বলল, ঘাস না খেলে তো আমার দুধ হবে না। তুমি আগে ঘাস নিয়ে এসো, তা খেলে আমার ওলানে দুধ আসবে তুমি তখন দুধ নিতে পারবে। কাক ঘাসের কাছে গেল, ঘাস বলল, আমাকে কাটতে তো কাস্তে লাগবে। তুমি গিয়ে কাস্তে নিয়ে এসো তাহলেই আমাকে নিতে পারবে। কাক এবার গেল কামারের কাছে, কামার বলল, কাস্তে বানাতে তো আমার আগুন লাগবে। তুমি গিয়ে আগুন নিয়ে এসো তাহলে আমি তোমাকে কাস্তে বানিয়ে দেব। কাক গেল এক গৃহস্থের কাছে আগুনের জন্য, গৃহস্থ বলল, আগুন কোথায় নিবে? কাক বলল, আমার ঠোঁটে দাও। গৃহস্থ তাই দিল, কাক বলে উঠল, ঠোঁটে নয়, ঠোঁটে নয়, ঠোঁট জ্বলে যাচ্ছে, আমার ডানায় দাও। গৃহস্থ দিল, কাক, ডানা পুড়ে যাচ্ছে, আমার পুচ্ছে দাও। সেখানে দিলে বলে উঠে পুচ্ছ পুড়ে যাচ্ছে আমার পায়ে দাও, পা পুড়ে যাচ্ছে আমার পিঠে দাও। এমন করতে করতে কাক শেষ পর্যন্ত আগুনে পুড়ে মারা গেল। ফলে ত্বীন আর তার খাওয়া হল না।
গল্পটি দাদার মনখ থেকে শুনা, জানি না বই-পুস্তকে এটি আছে কিনা। যদ্দূর মনে হয় কিতাবী কাহিনীর বাইরে এটি খাঁটি আমাদের গ্রামবাংলার মাটি থেকে উঠে আসা একটি রস। আলোচ্য কাক প্রকাশনাতে গল্পটি স্থান পেয়েছে কিনা, তা’ও জানিনা। পেলে ভালো, না পেলে আরো ভালো, তাহলে এতবড় একটি প্রকাশনার বাইরেও কাক নিয়ে একটি গল্প বলার কৃতিত্বের দাবী করতে পারব। সে যাই হোক, গল্পটি হতে যা বুঝা গেল গ্রামবাংলা কাক পছন্দ করে না। এবং তা বুঝার জন্য, তাঁরা যে কাককে সফল হতে দেননি, ত্বীন খেতে দেননিÑ এটাই যথেষ্ট। আসলে গ্রামবাংলায় বলতে গেলে কাক ছিলই না। গ্রাম গুলো ছিল তখন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, কাক পরিষ্কার জায়গায় থাকে না, তাদের স্থান হল নোংরা জায়গা, তাই শহর। গ্রামবাংলায় যেকটি কাক ছিল তারা তো আর নোংরা পেত না, ফলে তারা মনরগীর ছানাগুলোকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যেত। এজন্যে গ্রামবাংলা কাক পছন্দ করত না। অবশ্য গ্রামবাংলা যে গোটা আবর্জনাহীন ছিল তা কিন্তু নয়। গরু মরা, মহিষ মরা, ছাগল মরা, ছুঁচো-ইঁদুর মরা, ইত্যাদি পরিবেশ দূষিত করত। তবে তার জন্যে ছিল শকুন, হাড়গিলা, পেঁচা, ইত্যাদি। হাড়গিলা- এ এক অদ্ভুত পাখি, মহাভারতে রয়েছে গরুড়, যাকে সবাই ঈগল বলে জানে। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন এ হাড়গিলাই গরুড়। হিড়িম্বার স্নেহনীড়ে পালিত গরুড় ঘটোৎকচ মেঘনাদবধ। মনহূর্তেই আস্ত হাড় গিলে সাবাড় করে ফেলে, পাঁচ ফুট উচ্চতার বিশাল এই পাখি ডানা মেললে বার ফুট ছাড়িয়ে যায়! [[RTF bookmark start: }_GoBack[RTF bookmark end: }_GoBack
হাড়গিলা নামে যে কোন পাখি আছে সেটাই আমি জানতাম না। আজ হতে বহুদিন আগে জাতীয় এক দৈনিকে মৌলানা ভাসানীকে নিয়ে তাঁর জন্ম কিংবা মৃত্যু বার্ষিকীতে একটি ফীচার বেরিয়েছিল। তাতে পড়েছিলাম সম্ভবত এমন, ‘৭৪ সালের দিকে ভাসানীকে গৃহবন্দী করা হয়েছিল। মনসুর আলী ও কামরুজ্জমান সাহেবকে তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য পাঠান হয়েছিল। ভাসানী; মনসুর হাড়গিলা পাখি চেন? মনসুর; চিনি না হুজুর। ভাসানী; শকুন গরুমরা খেয়ে যাওয়ার পর পড়েথাকা আস্ত কঙ্কালটি গিলে শেষ করে এই হাড়গিলা পাখি। তোমরা পড়েছ সেই হাড়গিলার কবলে।’ ফিচারটি থেকেই আমি প্রথম হাড়গিলা সম্পর্কে ধারণা লাভ করি। এত বেশি আবর্জনা সে একা হজম করতে পারে, যা কয়েকশ কাক মিলে পারে না। তবে আমি বিস্মিত হলাম, মনসুর আলী সাহেব কেন হাড়গিলাকে চিনলেন না। তাঁর জন্ম ১৯১৭ সালে, তখন পুরা বাংলাই গ্রাম ছিল। থাক সেই কথা মূলত বলতে চাইছি, কোন এক বিশেষ প্রজাতি এককভাবে গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণহল ভারসাম্য, আর সবকিছু মিলে সেই ভারসাম্য। তাই সকলেরই ভারসাম্য মূলক সহ অবস্থান থাকা জরুরী। কোন একটি বেশি হয়ে গেলে যেমন ভারসাম্য নষ্ট হয়, কোন একটি কমে গেলেও তেমন ভারসাম্য নষ্ট হয়। পঞ্চাশ বছর পূর্বের চেয়ে চট্টগ্রাম শহরে এখন কাকের সংখ্যা বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ শকুন, হাড়গিলা মোটেই নেই। সবার সমন্বয়ে আমরা ভারসাম্যপূর্ণ একটি সুন্দর নিরাপদ পৃথিবী চাই।

লেখক : কলামিস্ট