কল্যাণ রাষ্ট্র , অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি

98


সমাজের অসহায়, অক্ষম, নিগৃহীত ও বিপন্ন মানুষ কারা ? ভাবছি তাদের কথা। তারাও দেশের নাগরিক। তাদেরও আছে অধিকার। অপুষ্টি, অপচিকিৎসা, প্রতিবন্ধিতা, দরিদ্রতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিসহ বিবিধ কারণে অসহায়ত্বের শিকার হয় দেশের মানুষ। বিশ্বায়ন ও পুঁজিবাদের প্রভাবে দেশের মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক কারণে মানুষের অধিকার আজ বিপন্ন। কিন্তু প্রত্যেক মানুষ অধিকার নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা মূলত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার অনন্য মাধ্যম। দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনৈতিক নেতাগণ অসহায় মানুষের কষ্ট, দুঃখ ও দুর্দশা উপলব্ধি করতে পারে। তারাই বিপন্ন মানুষের কল্যাণে উপযোগী কর্মসূচি গ্রহণে উদ্যোগী হন।
ভাবছি তাদের কথা, যাদের জীবনমান প্রান্তিক পর্যায়ের। মানব জীবনে যারা অবহেলিত। এ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কারা ? তারা হলেন- দুস্থ, এতিম, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ। আরো আছে- দরিদ্র প্রবীণ, অসহায় বিধবা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত নিঃস্ব মানুষ, হিজড়া, বেদে, মুচি, কামার, কুমার, মেথড়, ধোপাসহ নানান দলিত শ্রেণীর মানুষ। একজন পেশাদার সমাজকর্মী হিসেবে তাদের জীবন চিত্র প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। মানুষ হিসেবে তারা শিক্ষা, চিকিৎসা, আবাসন, পয়ঃনিষ্কাশন, বিশুদ্ধ পানি, বিনোদন সুবিধাসহ নানান মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত তারা। তাদের আয়-উপার্জন সীমিত এবং জীবনমান অতি নিচু। দেশের অসহায় মানুষগুলো মানব মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারছেনা। আবার তারা প্রতিবাদও করতে পারে না। এখানে কেউ প্রতিবন্ধিতার কারণে অ-প্রতিবাদী অথবা মানসিক দন্যতায় প্রতিবাদের ভাষা হারিয়েছে। বিরাজমান সামাজিক অবস্থায় একজন অক্ষম বা অবহেলিত মানুষ অধিকারহীন জীবনকেই মেনে নিচ্ছে স্বেচ্ছায়।
মানুষের ‘অধিকার’ কি ? ‘অধিকার’ অর্থ হলো নাগরিকের ন্যায্য পাওনা, ন্যায্য দাবি বা বৈধ ক্ষমতা। দেশের মানুষকে মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হলে তার সামাজিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার ও কল্যাণমূলক অধিকারের নিশ্চয়তা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের নাগরিকের দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, লৈঙ্গিক পরিচয় ও নৃতাত্বিক পরিচয় নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অনেক অধিকার আছে। কোন প্রকার বৈষম্য ছাড়াই মানুষ তার প্রাপ্য অধিকারসমূহ ভোগ করতে চায়। তবে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মৌলিক হাতিয়ার হচ্ছে দেশের ধর্মীয় মূল্যবোধ, সংবিধান, প্রচলিত আইন, বিধি-বিধান বা রাজনৈতিক ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব। যোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই অসহায় মানুষের বেদনার ডাক শুনতে পান। তাদের তরে যারা নিবেদিত হয়েছেন তারাই আজ মহান। এ মহত্বের গুণে একজন নেতা স্ব-জাতির কাছে অমরত্ব লাভ করে।
জনকল্যাণমুখী প্রচেষ্টা সরকারের অন্যতম রাজনৈতিক দর্শন। মাননীয় প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের ভিশন ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা। জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধনই কল্যাণ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। কল্যাণ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নাগরিকের সন্তোষজনক জীবনমান বজায় রাখা, সম্পদের সুষম বন্টন, জাতীয় আয় ও জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা বিধান ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রণয়নে প্রচেষ্টা চালানো হয়। এখানে প্রত্যেকের আহার, বাসস্থান ও চিকিৎসার সুযোগ নিশ্চিত হবে এবং বেকারত্ব, অসুস্থতা, অক্ষমতা, বৈধব্য অথবা অন্য কোন কারণে সমস্যাগ্রস্ত মানুষের সুযোগের নিশ্চয়তা থাকবে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেশের প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়ন চলছে। তাছাড়া সরকার ‘জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল-২০১৫’ প্রণয়ন করেছে। যাতে জীবনচক্রের প্রতি ধাপে দেশের মানুষের সকল প্রকার সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
বাংলাদেশের সংবিধান মানবাধিকারের এক অনন্য দলিল। এ সংবিধানে দেশের শ্রেণী ভেদে মানুষের সকল প্রকার অধিকার ও নিরাপত্তার বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে “সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃ-পিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনতি কিংবা অনুরূপ আয়ত্বাতীত পরিস্থিতি জনিত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার”। আবার ইতিহাস পরিক্রমায় দেখা যায় ব্রিটিশ-পাক শাসন আমলেও এ দেশের অসহায় মানুষের কল্যাণে বিশেষ কোন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়নি। ঐতিহ্যগতভাবে এ উপমহাদেশের কল্যাণকামী স্থানীয় হিতৈষী মানুষেরাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে মানবসেবামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। ইহা সমাজকর্মে আমাদের গর্বিত ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটিশ শাসনের শেষ ভাগে ব্রিটেনে অর্থনৈতিক মন্দাভাব পরিলক্ষিত হয়। এ প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ‘স্যার উইলিয়াম বিভারিজ’ এর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠিত হয়। বিভারিজ কমিশন প্রতিবেদনে ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট রূপরেখা ঘোষণা করা হয়। বিভারিজ রিপোর্ট হলো আধুনিক বিশ্বে ‘সামাজিক নিরাপত্তার’ এক অনন্য মডেল।
স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘকাল এ দেশের ভাগ্যাহত মানুষের কল্যাণে বিশেষ কোন উদ্যোগ বা কোন উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯০(নব্বই) দশকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলে দেশের ভাগ্যাহত মানুষের কল্যাণ নবদিগন্তের সূচনা হয়। তিনি দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বৃহত্তর পরিসরে বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৯৮ সালে প্রবীণ কল্যাণে প্রবর্তন করেন ‘বয়স্ক ভাতা’ কর্মসূচি। এটি দেশের বর্তমানে বৃহত্তম নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হলেন দেশের বৃহত্তর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রবর্তক। এ যুগে আমাদের স্যার উইলিয়াম বিভারিজ। এ ধারাবাহিকতায় দেশে চালু হয়েছে বিধবা ও স্বামী নিগৃহিতা ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, আশ্রয়ণ প্রকল্প, শিক্ষা উপবৃত্তি, প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি, হিজড়া ভাতা, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বিশেষ ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ সহ দেশে বর্তমানে ১৫২টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বর্তমান সরকার ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দের সংস্থান করেছে। যা মোট বাজেটের ১৪.২১ শতাংশ ও জিডিপির ২.৫৮ শতাংশ। বর্তমানে দেশের প্রায় ১(এক) কোটি মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে সম্পৃক্ত। যা অসহায় ও বিপন্ন মানুষের কল্যাণে এক মহান প্রচেষ্টা।
মানবকল্যাণ দর্শনে যারা অনন্য, তাঁরাই অসহায় মানুষের হৃদয়ের রাজা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সামাজিক নিরাপত্তা’ কর্মসূচি প্রবর্তনের মাধ্যমে নিঃস্ব মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। তিনি নিগৃহীত মানুষের হৃদয়ে তারা বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলো সমাজের সক্ষম মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু সহায়তা একটু সহানুভূতির প্রত্যাশায়। সমাজের বিপন্ন মানুষের তরে বেঁচে থাকার মাঝেই আছে স্বর্গীয় প্রশান্তি। এ প্রচেষ্টাই হলো ¯্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের অনন্য উপায়। মানবকল্যাণ হোক আমাদের সকলের মহান ব্রত।
লেখক : সহকারী পরিচালক
সমাজসেবা অধিদফতর
বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম