কর্মস্থল ফটিকছড়ি হলেও নিয়ন্ত্রণে ছিল এলএ শাখা

174

ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় সারপ্রাইজ ভিজিটে গিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তিন কর্মচারীকে তাৎক্ষণিক বদলির আদেশ দেন ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। এই তিনজনের একজন গত বৃহস্পতিবার দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া চেইনম্যান নজরুল ইসলাম। সেসময় নজরুলকে ফটিকছড়িতে বদলি করা হয়। তবে বদলি হলেও ফটিকছড়ির কর্মস্থলে না থেকে নিয়মিত চট্টগ্রাম শহরে ভূমি অধিগ্রহণ শাখার নিয়ন্ত্রণ করতেন নজরুল। আর এসব কর্মকান্ডের পুরোটাই পরিচালনা হতো শপিং কমপ্লেক্সে থাকা নজরুলের ‘আনুকা’ নামক কাপড়ের দোকান থেকেই।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এল এ) মো. আমিরুল কায়ছার পূর্বদেশকে বলেন, ‘নজরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল বলেই তাকে ফটিকছড়িতে বদলি করা হয়েছিল। সেখানে থেকে তিনি কি করেছেন তা আমাদের জানার কথা নয়। দুদকের মামলার কাগজপত্র হাতে পেলেই তার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া নথিপত্রগুলো এল এ শাখার কিনা জানা যাবে। এরপরেও যেহেতু অভিযোগ উঠেছে এল এ শাখার কারো সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা খতিয়ে দেখা হবে। তবে কারো ব্যক্তিগত দায় আমরা নিব না। কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পেলে ছাড় দিব না।’
অভিযোগ আছে, নজরুলের কর্মস্থল ফটিকছড়ি হলেও সেখানে উপস্থিত থাকতেন কম। মাঝেমধ্যে গিয়েই দাপ্তরিক কাজ সেরে পুনরায় শপিং কমপ্লেক্সের দোকানে বসতেন। এল এ শাখার কয়েকজন কর্মচারীর সাথে নজরুলের ভালো সখ্যতা। এরমধ্যে এলএমজি গ্যাস লাইন, দোহাজারী-ঘুনধুম রেললাইনসহ বড় বড় কয়েকটি প্রকল্পের সাথে যুক্ত থাকা চারজন চেইনম্যান ও পাঁচজন সার্ভেয়ার নজরুলের কাছে নিয়মিত গ্রাহক পাঠাতেন। এল এ শাখার অফিস সহকারী সায়েম, পাঁচলাইশের দালাল আবদুল্লাহ গ্রাহকদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণে নজরুলের সহায়তা নিতেন। সবার সহযোগিতা নিয়ে নজরুলই গ্রাহকের কাছ থেকে চেক ও নগদে ঘুষ নিতেন।
ফটিকছড়ি উপজেলা সদরের এক বাসিন্দা বলেন, ‘নজরুল ইসলাম কখনো ফটিকছড়িতে কর্মরত ছিলেন না। শুধুমাত্র দুর্নীতির দায়ে শাস্তিমূলক বদলি হয়ে দাপ্তরিক আদেশে সে ফটিকছড়িতে নামে ছিলেন। তার হয়ে এক পিয়ন উপস্থিতির স্বাক্ষর করতেন। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনের অনেকের জানা আছে।’
ফটিকছড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সায়েদুল আরেফিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘নজরুল আমাদের অফিসে চিঠি আনা-নেওয়ার কাজ করতেন। নিচের সারির কর্মচারীদের সাথে আমাদের তেমন দেখা হয় না। যতটুকু জেনেছি তিনি সকালে এসেছিলেন। ছুটি নিয়েছে বলে জানিয়েছে আমার অফিসের একজন। সন্ধ্যার পরেই বিষয়টি আমি জেনেছি। এমনো হয় চিঠি আনা নেয়ায় কর্মরত থাকেন ৩-৪জন। তারা কারো না কারো মাধ্যমে চিঠি পৌঁছে দেন। কারণ, একার পক্ষে তো আর পুরো উপজেলায় চিঠি পৌঁছে দেয়া সম্ভব না।’
সূত্রগুলো জানায়, এল এ শাখার দালাল তাড়াতে জেলা প্রশাসন তৎপর হওয়ার পর থেকেই কৌশল পাল্টে নেন সার্ভেয়ার ও চেইনম্যানরা। গ্রাহকদের কাছে ইস্যু করা প্রতিটি চেকের বিপরীতে মোটা অংকের ঘুষ গ্রহণেও পরিবর্তন আনা হয়। যেখানেই বড় প্রকল্পের কাজ চলছে সেসব উপজেলায় সার্ভেয়ার ও চেইনম্যানদের ঘনিষ্ট দালাল আছে। তারাই মূলত সার্ভেয়ার ও চেইনম্যানদের হয়ে গ্রাহকের ফাইলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরে মোটা অংকের লেনদেনের বিনিময়ে চেক পাইয়ে দিতে সহায়তা করেন। যার বেশিরভাগই নজরুলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো।
দুদক সমন্বিত জেলা-২ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রতন কুমার দাশ পূর্বদেশকে বলেন, ‘নজরুল ও তসলিমের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আরো কেউ জড়িত আছে কিনা তদন্ত হচ্ছে। তদন্তকালে কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
অনুসন্ধানে ও বিভিন্ন অভিযোগে জানা যায়, হাটহাজারীর মগেরহাট এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বাবুল। তার নামে নগরী ও গ্রামের বিভিন্ন স্থানে অঢেল সম্পদ আছে। ষোলশহর শপিং কমপ্লেক্সে ২২২নং দোকান আনুকা, নিচ তলায় ১২৭নং ফ্যামেলি ফেয়ার ও ১৫৯নং দোকান আছে নজরুলের। এছাড়াও ৩৩নং দোকানটিও তার স্ত্রীর নামে। রেয়াজউদ্দিন বাজারে তার স্ত্রী ও শ্বশুরের নামে মার্কেট আছে। প্রবাসে থাকা তার ভাইয়ের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করেন নজরুল। হাটহাজারীর গুয়ামর্দ্দনে কিনেছেন জমি। ২০১৫-১৬ সালেই নজরুল বিপুল অর্থের মালিক হন। হাটহাজারীর গ্রামের বাড়িতে বানিয়েছেন কোটি টাকার বাড়ি। সেসময় ফিডার রোড, সিডিএ’র বিভিন্ন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ থেকে মোটা অংকের টাকা ভাগিয়ে নিতেন নজরুল। সেসময় যেসব ক্ষতিগ্রস্ত লোক এল এ চেক গ্রহণ করেছেন তাদের অধিকাংশের একাউন্ট ছিল রূপালী ব্যাংক লালদীঘি শাখায়। চেইনম্যান করিম, নজরুল ও আবদুল্লাহর সিন্ডিকেট তখন এল এ শাখার আলোচনায় আসে। ও আর নিজাম রোডে তার যে ফ্ল্যাট আছে সেটিতে অভিযান চালিয়েছে দুদক। যা তার স্ত্রীর নামে বলে স্বীকার করেছেন নজরুল। খুলশীতেও তার প্লট আছে। নজরুলের মতো তার সহযোগীরাও এখন কোটি টাকার মালিক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এল এ শাখার এক কর্মচারী জানান, ‘নজরুলের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তাকে হাটহাজারীতে বদলি করা হয়েছিল। পরে আবারো নানা কৌশলে এল এ শাখায় ফিরে আসেন নজরুল। এরপর সর্বশেষ ২০১৭ সালে দুর্নীতির দায়ে করিম, নজরুল ও হানিফকে বদলি করে দেন ভূমিমন্ত্রী। এরপর থেকে এল এ শাখায় দেখা যেতো না তাদের। শুনেছি বাইরে তারা কিছু কাজকর্ম করেন।’
বরখাস্ত হচ্ছেন নজরুল ও তসলিম : দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া নজরুল ও তসলিমের বিরুদ্ধে সাপ্তাহিক ও ঈদে মিলাদুন্নবীর ছুটি শেষে প্রথম কর্মদিবসেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন ইতোমধ্যে কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানের কথাও জানিয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। আগামী সোমবার নজরুল ও তসলিমের বরখাস্তের আদেশ হতে পারে। জেলা প্রশাসনের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।