কর্মস্থলে নেই উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা রাঙ্গুনিয়ায় কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেনা কৃষক

176

রাঙ্গুনিয়ায় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ে না থাকার অভিযোগ উঠেছে। কৃষকরা প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন তাদের বিরুদ্ধে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে কাজ করার কথা থাকলেও অধিকাংশ কৃষি কর্মকর্তারাই সপ্তাহে দুই একবার মাঠে যান বলে জানা যায়। এরমধ্যে কেউ কেউ এই চাকুরীর বাইরেও নিজস্ব ব্যবসায় সহ অন্যান্য কাজ চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে কৃষক বঞ্চিত হচ্ছেন নিয়মিত পরামর্শ থেকে। অথচ রাঙ্গুনিয়া একটি কৃষি নির্ভর এলাকা। এতদ অঞ্চলের কৃষিজাত পণ্যের যোগান চলে যায় সারা বাংলাদেশে। উপসহকারীদের এমন খামখেয়ালীতে কৃষকদের ফলন বিপর্যয়ের আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি এই অভিযোগের ভিত্তিকে এক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকেও বদলি করা হয়েছে বলে জানা যায়। অন্যদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক।
জানা যায়, সরকার কৃষক ও কৃষির উন্নয়নে রোগ-বালাই প্রতিরোধসহ কৃষকদের কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলার ওয়ার্ড পর্যায়ে ব্লক সৃষ্টি করে প্রতিটি ব্লকে একজন করে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছেন। যারা প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট পাক্ষিক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কৃষকদের নানা পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করবেন। একটি ব্লকে রয়েছে ১২টা দল।
প্রতি দলে কৃষক রয়েছে ৩০ জন। উপসহকারীগণ প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত একটি দল এবং ১২টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত অন্য একটি দলের কৃষকদের মাঠ পর্যায়ে থেকে পরামর্শ দেবেন। এরপর ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ইউনিয়ন ভিত্তিক স্থাপিত কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র থেকে সহায়তা করবেন। এভাবে প্রতিদিন পাক্ষিক কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করবেন একজন উপসহকারী এবং প্রতি ১৫ দিন অন্তর কাজের অগ্রগতির একটি প্রতিবেদন জমা দেবেন স্থানীয় কৃষি অফিসে। এসব কর্মকর্তা প্রতি মাসে পাচ্ছেন সরকারি তহবিল থেকে মোটা অংকের বেতন, বাসা ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, সন্তানদের জন্য শিক্ষা ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা। এসব উপসহকারী কর্মকর্তারা মাঠে না থেেেক অফিসে বেশীর ভাগ সময় নিজেদের নানা তদবীর নিয়ে ব্যাস্ত থাকতে দেখা যায়। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে তেমন পাত্তা দেযনা। অফিসিয়াল কোন নির্দেশ তারা মানেনা। তাদেও এসব কর্মকান্ডে উপজেলা কৃষি অফিস তাদেও কাছে জিম্মি হয়ে আছে। কিছু করতে গেলে উপ সহকারীরা তাদের এসোসিয়েশনের প্রভাব বিস্তার করার নানা চেষ্টা করে। তাদের দলাদলিতে ঋপজেলার কৃষি কাজ মুখ তুবড়ে পড়ে আছে। শত শত কৃষক তাদের থেকে প্রকৃত সেবা না পেয়ে নানা ভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। সুত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ১৫টি ইউনিয়নকে ৩টি করে ৪৫টি ব্লক ও পৌরসভাকে ১টি ব্লক করে সর্বমোট ৪৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ব্লকে ১ জন করে ৪৬ জন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ৩৯ জন। এদের মধ্যে কয়েকজনকে বিভিন্ন ব্লকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে ব্লকের কাজ করা হচ্ছে।
সরেজমিনে রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন ব্লক ঘুরে দেখা যায়, মাঠ পর্যায়ে এই কার্যক্রম চলছে অত্যন্ত সীমিত আকারে। নিয়মিত যাওয়া তো দূরে থাক কোন কোন কর্মকর্তা সপ্তাহেও একবার আসেন না বলে জানান কৃষকরা।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষকদের সমস্যা, কৃষির নানা বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণের জন্য রাঙ্গুনিয়ায় কর্মরত উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে খুঁজে পান না এলাকার কৃষকরা। এমন অভিযোগ উপজেলার অধিকাংশ এলাকার কৃষকের। কাগজে-কলমে এসব কর্মকর্তা ব্লকে কর্মরত থেকে কর্মস্থলে না এসেই নিয়মিত বেতন-ভাতা তুলে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। এ উপজেলায় কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই রাঙ্গুনিয়ায় বাড়ি হওয়ায় এলাকার প্রভাব কাটিয়ে তারা যেনতেন ভাবে চাকুরী চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব কর্মকর্তা একে অপরের সঙ্গে যোগসাজশ করে (সিন্ডিকেট) প্রতিদিন একজন ৩-৪ জনের বøক ঘুরে দেখেন। এভাবেই চলে ব্লক কর্মকর্তাদের সপ্তাহের দায়িত্ব পালন।
রাঙ্গুনিয়ায় নিয়োজিত ৩৯ জন উপসহকারীর মধ্যে ২৫ জনেরও বেশির বাড়ি রাঙ্গুনিয়া। এই সুযোগে তারা যেনতেন ভাবে নিজেদের চাকুরী করে যাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে গেলে তারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের মাধ্যমে তা ম্যানেজ করে দিনের পর দিন চাকুরী করে যাচ্ছেন। এরফলে প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে উপজেলার দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের সোনারগাঁও ব্লকে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এম.এম. মামুনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনুপস্থিতির বিষয়ে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে তিনি উপজেলা কৃষি অফিসে এসেছেন জানিয়েছেন। দেখা করার কথা বললে কয়েক দিন পর পারবেন বলে জানান তিনি। স্থানীয়দের অভিযোগ, তার নিজস্ব মুদির দোকান রয়েছে। চাকুরীর থেকেও তিনি ওই দোকানে বেশি সময় দেন। তবে সপ্তাহে দুই একবার মাঝে মধ্যে আসেন বলে জানান স্থানীয় কৃষকরা।
অন্যদিকে পদুয়া ইউনিয়নের সুখবিলাস ব্লকে কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিটন দাশকেও এদিন পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনিও জরুরী কাজে বাইরে আছেন বলে জানায়।
পদুয়া ইউনিয়নের মো. করিম বলেন, ‘ঠিক সময়ে কৃষি কর্মকর্তাদের পাওয়া যায় না, তাই পরামর্শও নিতে পারেন না। তবে মুঠোফোনে ছবি তুলে পাঠালে তারা ফোনেই পরামর্শ দিয়ে কাজ সারেন বলে জানান তিনি।’ সোনারগাঁও এলাকার কৃষক আবদুল গণি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মাঠে কৃষি কাজ করছি। কাগজে কলমে কর্মকর্তারা থাকলেও তাদের পাওয়া যায় খুব কম। তাই তাদের থেকে সেবা পাওয়ার আশা আমরা করি না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কারিমা আক্তার বলেন, কর্মস্থলে নিয়মিত আসার জন্য সব কর্মকর্তাকে নিয়মিত মনিটরিং করা হয়। তবে সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সহ বেশ কয়েকটি পদ খালি থাকায় অফিসিয়াল কাজের চাপে মাঠে বেশি সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে কর্মস্থলে ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়। সম্প্রতি এই অভিযোগে এক কর্মকর্তাকে বদলি করাও হয়েছে বলে জানান তিনি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে প্রতিদিন হাজিরা দেয়ার জন্য আমরা একটি নিয়ম করার পদক্ষেপ নিচ্ছি।
জানা যায়, একসময় কৃষির চারণভূমি হিসেবে খ্যাতি রয়েছে রাঙ্গুনিয়ার। এই উপজেলায় রয়েছে চট্টগ্রামের শস্য ভান্ডার খ্যাত গুমাই বিল, তলয় ভাঙ্গা বিল, বগাবিল সহ বিভিন্ন প্রশিদ্ধ উর্ভর ভূমি। এই উপজেলার উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি হয় দেশের বিভিন্ন বাজারে। তবে দিন দিন কৃষি কর্মকর্তাদের দায়িত্বের অবহেলার কারণে রাঙ্গুনিয়ার এই ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে। বিশেষ করে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা মাটির উর্বরতা নষ্ট এবং নানা পোকা-মাকড়ের আক্রমণ সহ বিভিন্ন কারণে ভালো ফলন না হওয়ায় কৃষকরা সোনালি ফসলের চাষে ক্রমে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।