কর্ণফুলী ঘিরে মহাপরিকল্পনা

142

কর্ণফুলী তীর ঘিরে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। পরিবেশ দূষণরোধে এ পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। উচ্ছেদ অভিযান শেষ হওয়ার পরই শুরু হবে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ। আগামী ১৪ মার্চ উচ্চ পর্যায়ের কমিটিতে এ মহাপরিকল্পনা অনুমোদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে থমকে গেছে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। এ নিয়ে অনিশ্চয়তাও দেখা দিয়েছে। তবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, এটা সাময়িক বিরতি। ১৪ মার্চের পর আবারও অভিযান শুরু হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কর্ণফুলী তীরকে ঘিরে প্রায় দেড় বছর আগেই মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার। বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে জানিয়ে একটি মাস্টাপ্ল্যান তৈরির নির্দেশনাও দেয়া হয় উচ্চ পর্যায় থেকে। তারই প্রেক্ষিতে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, সিডিএ, ওয়াসা, বিভাগীয় কমিশনারের অফিস ও জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি দফায় দফায় সভা করে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করে। এতে কর্ণফুলীর দূষণরোধে ও তীর রক্ষায় নানা পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। বিনোদন কেন্দ্র করা, জেটি টাইপের কিছু করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশগুপ্তা জানান, বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। উচ্চ পর্যায়ের এ কমিটি কয়েক বার বৈঠক করে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে। বিশেষ করে কর্ণফুলী নদীকে দূষণমুক্ত করা এবং তীরকে রক্ষা করে কী করা যায়, সেটাই চিন্তা করা হয়েছে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পর এ মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।
সূত্র জানায়, সরকারও মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে মন্ত্রী পর্যায়ের একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটিও সকল নদী রক্ষায় করণীয় নিয়ে কাজ করে চলেছে। এরই মধ্যে একাধিক দফায় বৈঠক করেছে। মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করা হয়েছে।
জানা যায়, আগামী ১৪ মার্চ ঢাকায় উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন এ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় মহাপরিকল্পনা অনুমোদন দেয়া হতে পারে। এরপরই শুরু হবে বাস্তবায়নের কাজ।
এদিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে কর্ণফুলীর তীর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হলেও প্রথম পর্যায়ের পর তা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। মহাপরিকল্পনা তৈরি কাজ শুরু হওয়ায় এবং বাজেট না থাকায় তা বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। ফের অভিযান শুরু হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নদীর তীর রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শুরু হওয়ায় উচ্ছেদ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মূলত তিনটি কারণে অভিযান বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে মূল কারণ হচ্ছে, বাজেট বরাদ্দ না থাকা। এছাড়া উচ্ছেদের আওতায় থাকা নদীর তীরের অধিকাংশ জায়গার মালিক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের জায়গা বন্দর উদ্ধার করবে, এমন চিন্তাভাবনা থেকে জেলা প্রশাসন পিছিয়ে গেছে। এরপর স¤প্রতি নদীর তীরবর্তী একটি বস্তিতে অগ্নিকান্ডে ৮ জনের মৃত্যুর ঘটনার পর জনবসতি উচ্ছেদে সময় নেওয়ার কৌশল নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
অপর একটি সূত্র জানায়, নদী তীরে বেশকিছু জমি লিজ দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরঅ এ কারণে আইনি জটিলতা দেখা দিয়েছে। লিজ দেয়া ভূমি উচ্ছেদে জটিলতার কারণে পিছিয়ে গেছে জেলা প্রশাসন। তবে ১৯০৮ সালের পোর্ট অ্যাক্টে বলা আছে, নদীর তীর থেকে ১৫০ ফুট পর্যন্ত পোর্ট (বন্দর) এলাকায় কোন জমি সাবলিজ দেওয়া যাবে না। এছাড়া জেলা প্রশাসনও এসব জমি লিজ দিতে পারে না।
সম্প্রতি এক রায়ে হাইকোর্ট নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়েছে, ‘সরকার কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে এ সম্পদ লিজ দিতে পারবে না। সংবিধান অনুযায়ী, সরকার বা রাষ্ট্র জনগণের সম্পদ রক্ষা করবে। এর বাইরে যদি কাউকে লিজ দেয়, তবে তা বাতিল হিসেবে গণ্য হবে’। গত ৩ ফেব্রুয়ারি দেওয়া ওই রায়ে বলা হয়, ‘ভুলের কারণে যদি নদ-নদীর জায়গা ব্যক্তির নামে নামজারি হয়েও থাকে, তবে আজ থেকে তা বাতিল হয়ে গেল।’
জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, উচ্ছেদের পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণ না করলেও আবারও বেদখল হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ে চট্টগ্রাম বন্দর, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে বৈঠক হয়েছিল। সেখানে উচ্ছেদ ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেটি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আমরা উচ্ছেদ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি কর্ণফুলীর তীরে নগরীর সদরঘাট থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়। টানা পাঁচদিন অভিযান চালিয়ে ২৩০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের মাধ্যমে ১০ কিলোমিটারেরও বেশি ভূমি দখলমুক্ত করা হয়।
জানা যায়, উচ্ছেদ অভিযানের জন্য জেলা প্রশাসন এক কোটি ২০ লাখ টাকা বাজেট চেয়েছিল ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে। মন্ত্রণালয় থেকে সেই টাকা দেওয়ার আশ্বাস এসেছিল। তবে প্রথম পর্যায়ের উচ্ছেদ শুরুর পরও টাকা দেওয়া হয়নি। উচ্ছেদ শেষের আরও অন্তত ১৫ দিন পর এসেছে মাত্র ২০ লাখ টাকা। উচ্ছেদ এবং রক্ষণাবেক্ষণ একসঙ্গে করতে হলে টাকার প্রয়োজন। কিন্তু বাজেটের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না জেলা প্রশাসন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হয়নি, কিছুটা বিরতি চলছে। গতকাল শনিবার দুপুরে মাঝিরঘাটে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে দখলমুক্ত করা ভূমি পরিদর্শনে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের একথা জানান।
তিনি বলেন, কর্ণফুলী নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোন ধরনের ক¤েপ্রামাইজ (সমঝোতা) করা হবে না। থেমে থাকা উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কৌশলগত কারণে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ কার্যক্রমে বিরতি চলছে। কর্ণফুলী নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে কারও সঙ্গে সমঝোতা করা হয়নি। উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হয়নি, কৌশলগত কারণে কিছুটা বিরতি দেওয়া হয়েছে।
নদীর তীরে উচ্ছেদ করা জায়গায় হাঁটার পথ এবং বনায়ন করার চিন্তা আছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, উদ্ধার করা জায়গা যাতে দখল না হয় সেজন্য এই কাজগুলো করা হবে। প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। শুধু কর্ণফুলী নয়, তুরাগ, বুড়িগঙ্গাসহ দেশের সব নদী দখল-দূষণ থেকে রক্ষা করতে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
পরিদর্শনকালে মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান, সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন, জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাহমিলুর রহমান মুক্ত।
এর আগে গতকাল শনিবার সকালে সার্কিট হাউসে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন ও চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ড’ বিষয়ক মতবিনিময় সভায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, মহাপরিকল্পনা অনুমোদনের পর কর্ণফুলী তীরে উচ্ছেদ শুরু হবে। কর্ণফুলী নদীসহ আশপাশের ৫৭টি খালের দূষণ ও নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়েছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের সবগুলো নদী দূষণমুক্ত করা ও দখলমুক্ত করার জন্য কাজ করছি। এজন্য প্রধানমন্ত্রী একটি কমিটি করে দিয়েছেন। কমিটি কাজ শুরু করেছে। একটি মাস্টারপ্ল্যান করা হচ্ছে। আগামী ১৪ তারিখে সভায় মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন করব। করার পর কর্ণফুলী নদীর আশেপাশে অবৈধ দখল যে সমস্ত, তা উচ্ছেদ করা হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, উচ্ছেদের জন্য অর্থ বরাদ্দে কোন সংকট নেই। অর্থ বরাদ্দ চলমান রয়েছে। এটা পাওয়া যাবে।