কর্ণফুলী ঘিরে আশার আলো

74

কর্ণফুলী নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদের ঘোষণা চারদিন আগেই দেয়া হয়। পরিস্থিতি বুঝে অনেকেই আগেভাগে স্থাপনা সরিয়ে নেয়। যে সমস্ত স্থাপনা রয়ে গেছে সেগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন।
গতকাল সোমবার সকাল থেকে শুরু হওয়া অভিযানের প্রথমদিনেই প্রায় ৫০টির মতো স্থাপনা উচ্ছেদ করার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান ও তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিআইডবিøউটিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর, বন্দর কর্তৃপক্ষ, কর্ণফুলী গ্যাস, পুলিশ, র‌্যাব, বিটিসিএল, বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিস যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করেন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ১৫০ জন পুলিশ, ১০০ র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস’র ২০জন ও শ্রমিক ১০০জনসহ চসিক ও সিডিএর বুলডোজার, পে-লোডার, ট্রাক নিয়ে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতিতে ভাঙন কার্যক্রম শুরু হয়। লাইটারেজ জেটিতে অভিযানে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়ার পরেই উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়।
এ সময় পতেঙ্গা সার্কেল ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাহমিলুর রহমান বলেন, কর্ণফুলী দখল উচ্ছেদ অভিযানে সব ধরনের মানুষ যুক্ত আছে। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজটা করতে চাই। তালিকায় সরকারি- বেসরকারি সব ধরনের স্থাপনা আছে। আমাদের কাছে কে বড়, কে ছোট সেটা গুরুত্বপূর্ণ না, অবৈধ এটাই বেশি। সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত জোনেই ২০০ স্থাপনা আছে। উচ্ছেদ শেষ হলে প্রায় দশ একর জায়গা উদ্ধার করতে সক্ষম হবো আমরা। আজকে (গতকাল) থেকে শেষ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে। উদ্ধারকৃত জায়গায় সীমানা পিলার স্থাপন ও সাইনবোর্ড বসানো ছাড়াও সবুজ বনায়ন করার পরিকল্পনা আছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল ১০টা ১০ মিনিট। দুই ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বরিশাল ঘাটে উচ্ছেদকারী দল। প্রথমেই টিনের ছাউনি ও কাঠবোর্ড দিয়ে বানানো সদরঘাট সাম্পান চালক সমবায় সমিতি লিমিটেডের অফিসটি গুঁড়িয়ে দিতে তৎপরতা। অফিসের ভেতর থেকে সোফা, গ্লাসের দরজা, আলমিরা নিয়ে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে আসেন কয়েকজন। মুহূর্তেই বুলডোজারের আঘাত। এরপর একই ঘাটে যাত্রীদের জন্য নির্মিত যাত্রী ছাউনিটিও ভেঙে দেয়া হয়। পাশে থাকা বিআইডব্লিউটিএর একটি দেয়াল ভাঙা হয়। সেখানের তিনটি স্থাপনা উচ্ছেদ শেষে ১০টা ৫৫ মিনিটে বসানো হয় সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড।
দ্বিতীয়ধাপে ডিপ সি পোর্ট (ডিএসপি) ঘাটে অভিযান। সেখানে দুটি টিনের ঝুপড়ি ঘর ভেঙে দেয়া হয়। এরপর তৃতীয় ধাপে কর্ণফুলী ঘাটে শিল্পপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. রশিদের মালিকানাধীন কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের মৎস্য হিমাগার ভাঙতে যায় উচ্ছেদকারী দল। সেখানে থাকা হিমাগার কর্তৃপক্ষের লোকজন ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা সেখানে প্রচুর মাছ রয়েছে জানিয়ে প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রসহ দুই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেন। এরমধ্যেই বুলডোজার উঁচু ভবনের পশ্চিম অংশে টিনের স্থাপনা ও দুটি পাকা দেয়াল ভেঙে দেয়। তবে এ ভবনটি জেলা প্রশাসনের পক্ষে লাগানো লাল দাগ মোতাবেক না ভাঙায় অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলেন উপস্থিত অনেকেই। অল্পক্ষণ পরেই কর্ণফুলী ঘাটে উচ্ছেদ অভিযান পরিদর্শনে যান জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন।
উচ্ছেদ অভিযান পরিদর্শন করে সেখানে একটি সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড স্থাপন করেন জেলা প্রশাসক। পরে উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, কর্ণফুলীর দখল উচ্ছেদে কোনো প্রভাবশালীর কাছে মাথানত করবো না। অলরেডি বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে হুমকি-ধমকি এসেছে। উচ্ছেদকারী ম্যাজিস্ট্রেট যারা, তাদেরকেও হুমকি দিয়েছে। আমরা সেই হুমকিতে বিচলিত নই। আমরা আইরে প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমাদের নদী বাঁচাতে হবে, দেশকে বাঁচাতে হবে। যে যতই প্রভাবশালী ব্যক্তি হোক না কেন, আমরা কোনোমতেই কাউকে ছাড় দেবো না।
কিছু স্থাপনা ভাঙা হচ্ছে না বলে এমন অভিযোগের বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, আরএস জরিপ অনুযায়ী সব অবৈধ স্থাপনা ভাঙা হবে। পরবর্তীতে যদি কোন স্থাপনা বাদ পড়ে আমরা আবারো রিভাইস করবো। যে কোন সময় আবারো ভাঙা হবে। আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে সে ক্ষমতা আমার আছে। আমার উচ্ছেদ চালাতে কোনো সমস্যা নাই।
বন্দর সদস্য (ইঞ্জিনিয়ার) কমডোর খন্দকার আখতার হোসেন বলেন, কর্ণফুলী হচ্ছে বন্দরের প্রাণ। কর্ণফুলী বাঁচলে চট্টগ্রাম বাঁচবে। অবৈধ যে সমস্ত স্থাপনা আছে সেগুলো যারই হোক আমরা উচ্ছেদ করবো। একযোগে এ কাজের সাথে জড়িত সবাই। কর্ণফুলী নদীর দুই তীর অবমুক্ত করা হলে যে কোন ধরনের জাহাজ ভিড়বে। নিয়ম ও আইনের মধ্যে থেকে আমরা উচ্ছেদে সবধরনের কাজ করবো। নিজেদের ম্যাজিস্ট্রেট থাকার পরেও কেন হাইকোর্টের রায়ের অপেক্ষায় ছিলেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা সবসময় উচ্ছেদ অভিযান করি। অবৈধ দখল যেখানেই দেখি আমরা উচ্ছেদ চালাই।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) আবদুর রউফ বলেন, সদরঘাট এলাকাটি শ্রমিক অধ্যুষিত। সেখানে থাকা অবৈধ স্থাপনাগুলো সরিয়ে নিতে আমরা আগেভাগেই নির্দেশ দিয়েছিলাম। অনেকেই সরিয়ে নিয়েছেন।
চসিক কাউন্সিলর গোলাম সরোয়ার জোবায়ের বলেন, বন্দর যেখানে সেখানে লিজ দিয়েছে। আমরা অনেকেই জানতাম মাঝিরঘাটের লবন মিলগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন। এখন জানলাম এগুলো বন্দরের জায়গা লীজ নিয়ে গড়ে উঠেছে। বন্দর অতি উদারতার কারণেই অবৈধ দখল বেশি হয়েছে।
দুপুরের বিরতির পর আদম ঘাটসহ আরো কিছু এলাকায় অভিযান চালানো হয়। গতকাল রাতে উচ্ছেদ অভিযানে সর্বশেষ পরিস্থিতি বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, প্রথমদিনে ৫০টির মতো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। দখলদাররা ৩০টির মতো স্থাপনা নিজেরাই সরিয়ে নিয়েছেন। আগামীকাল (আজ) একই সময়ে আবারো উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হবে।