কর্ণফুলীর ড্রেজিংয়ে বড় বাধা প্লাস্টিক বর্জ্য

228

চট্টগ্রাম বন্দর তথা দেশের অর্থনীতির প্রাণ প্রবাহ কর্ণফুলী নদীর গভীরতা বাড়াতে চলছে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ। বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন আধুনিক ড্রেজার মেশিনের সাহায্যে নদীর তলদেশ খননের কাজ করছে। ড্রেজিংয়ের সময় নদীর তলদেশ থেকে মাটি-বালুর চেয়েও বেশি উঠছে অপচনশীল ‘প্লাস্টিক বর্জ্য’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্লাস্টিক বর্র্জ্য এখন ড্রেজিংয়ে ‘বড় বাধা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। এ ধরনের কঠিন বর্জ্যরে কারণে টানা বিশ মিনিটও ড্রেজার সচল রাখা যাচ্ছে না।
নগরীর বিভিন্ন খাল হয়ে প্রতিদিন সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে নানা ধরনের গৃহস্থালী ও শিল্পবর্জ্য। এসব খাল দিয়ে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টন ময়লা নদীর তলদেশে জমা হচ্ছে। এতে করে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পলিথিনের বিশাল এক আস্তরণ তৈরি হয়েছে। নিত্যদিনের কাজকর্ম ও জীবনযাত্রায় পলিথিন-প্লাস্টিক জাতীয় পণ্যের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় নদীকে গিলে খাচ্ছে এসব বর্জ্য। প্লাস্টিক, পলিথিন-জাতীয় বর্জ্য কর্ণফুলীর বিশাল জায়গা দখল করে আছে। এসব বর্জের মধ্যে রয়েছে, পলিথিন ব্যাগ, খাদ্য ও শিল্পের বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক, শিল্পপণ্য, অচল ইলেকট্রনিক্স পণ্য, নির্মাণসামগ্রী, তৈজসপত্র, আসবাব ও চিকিৎসা সরঞ্জাম।
চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার এম আরিফুর রহমান বলেন, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ ইতোমধ্যে ১৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। নদীর তিন জায়গায় পুরোদমে এক সাথে কাজ চলছে। আগামী মে মাসের মধ্যে মূল ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হবে।
তিনি বলেন, কর্ণফুলী নদীতে ড্রেজিং করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য। এসব বর্জ্যরে কারণে নদী থেকে মাটি উঠাতে গিয়ে চরম সমস্যা হচ্ছে। শুধু ময়লা, পলিথিন, রাবার জাতীয় জিনিসগুলো পাওয়া যাচ্ছে। ২০ মিনিটের বেশি একটানা মেশিন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। একটু পর পর মেশিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার পরিষ্কার করে আবার চালাতে হচ্ছে। এতো বেশি প্লাস্টিক-পলিথিন না দেখলে বুঝানো সম্ভব হবে না।
চট্টগ্রাম শহরের সব ধরনের আবর্জনা সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে উল্লেখ করে আরিফুর রহমান বলেন, নদীর সাথে সংযুক্ত খালগুলোর মুখে কোনও কিছু না থাকাতে সব ময়লা নদীতে এসে পড়ছে।
ক্যাপিটাল ড্রেজিং শেষ হলে কি ধরনের সুফল পাওয়া যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ৪০০ মিটারের একটি জেটি সচল হবে। বন্দরের মূল জেটিগুলোতে পলি জমা বন্ধ হবে। খালগুলো পরিষ্কার থাকায় চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা কিছুটা কমবে বলে আশা করি।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্যাপিটাল ড্রেজিং পূর্ণাঙ্গভাবে শেষে হলে বড় জাহাজ জেটিতে ভিড়তে পারবে, ছোট ছোট জাহাজ বেশি পরিমাণে নদীতে নোঙর করতে পারবে, নদীর তীরে সদরঘাট এলাকায় চারটি লাইটার জেটি চালু হবে। এতে করে বহির্নোঙর থেকে আনা আমদানিকৃত পণ্য জেটিতে নামানো অনেক সহজ হবে। সেই সাথে পণ্য খালাসের খরচও কমবে। একইভাবে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। বর্ষাকালে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা কমবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়াল এডমিরাল জুলফিকার আজিজ বলেন, বন্দরের জেটিগুলোতে পলি জমে থাকায় জাহাজ ভিড়তে পারছে না। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হলে এ সমস্যাটা নিরসন হবে। নির্বিঘ্নে জাহাজ জেটিতে ভিড়তে পারবে। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পেলে লাইটারেজ জাহাজ চলাচল এবং বন্দরের অন্যান্য কার্যক্রমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। আগামী মে মাসের মধ্যে ক্যাপিটাল ড্রেজিং শেষ হেব বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার চওড়া এলাকায় ড্রেজিং করা হবে। এখান থেকে ৪২ লাখ ঘনমিটার মাটি তোলা হবে। প্রতি ঘনমিটার মাটি উত্তোলনে খরচ হবে ৩৭৩ টাকা। আর পুরো প্রকল্প সম্পন্ন করতে খরচ হবে প্রায় ১৬৮ কোটি টাকা। শুধু ড্রেজিংই নয়, পরবর্তী তিন বছর নদীকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। ড্রেজিং প্রকল্পের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সর্বমোট ২৪২ কোটি টাকা খরচ করবে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ড্রেজিংয়ের মূল কাজ শুরু হয়।

প্লাস্টিক দূষণের
বিস্ময়কর তথ্য

দূষণে বিশ্বে দশম বাংলাদেশ

প্লাস্টিক আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অপরিহার্য অংশগুলোর একটি এবং এর একক ব্যবহার বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। স্থায়িত্ব, কম খরচ এবং বিভিন্ন আকার ও এর সহজলভ্যতার কারণে প্লাস্টিক ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। ভোক্তা সমাজ ও উৎপাদনকারীদের মানসিকতা এবং আচরণ এর জন্য দায়ী। একক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত প্লাস্টিক সামগ্রী যেমন পানির বোতল, স্ট্র, প্লাস্টিকের চামচ ইত্যাদি একবার ব্যবহার করার পর ফেলে দেওয়া হয় এবং এসব দ্রব্যের চূড়ান্ত গন্তব্য হয় আমাদের নদী বা সমুদ্রে। বাংলাদেশে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে আরও বাড়বে যদি এর লাগাম টেনে ধরা না হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্লাস্টিক দ্রব্যাদির বাজার প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার, যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৪ হাজার প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে প্রায় ২০ লাখের বেশি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।
এখানে প্রতিবছর মাথাপিছু প্রায় পাঁচ কেজি প্লাস্টিক দ্রব্যাদি ব্যবহৃত করা হয় এবং জিডিপিতে এর পরিমাণ প্রায় ১ শতাংশ। ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিব্যাগ পরিত্যক্ত হচ্ছে আর তা জলাধার, নদী ও মহাসাগরে গিয়ে জমা হচ্ছে। জীববৈচিত্র্যের ওপর ফেলছে মারাত্মক প্রভাব। শহরের পয়ো:নিষ্কাশন-ব্যবস্থায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। সাম্প্রতিক সময়ে আর্থ-ডে নেটওয়ার্কে প্রকাশিত তথ্যমতে, ২০১৮ সালে বিশ্বের সর্বাধিক ২০ টি প্লাস্টিক দূষণকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চীন ও ইন্দোনেশিয়া। দেশের বর্জ্যরে প্রায় ৮ শতাংশ হলো প্লাস্টিক। এর চার ভাগের এক ভাগ গিয়ে পড়ে সাগরে ও নদীতে। এসব কারণে ব্যবহার-পরবর্তী প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে।
সাম্প্রতিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক প্রতিবছর সাগরে পতিত হওয়ার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে সাগরে মাছের তুলনায় প্লাস্টিকের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবীব্যাপী প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিক বোতল সাগরে পতিত হয়, যা জলজ প্রাণীর জন্য হুমকি। ব্যবহৃত প্লাস্টিকের অধিকাংশ মাটির সঙ্গে মিশে যায় না এবং কিছু কিছু মিশলেও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
জলবায়ু পরিবর্তনে প্লাস্টিকের কুপ্রভাব :
দেশে প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহার দরকার, কারণ এটি মানুষ, প্রাণী এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। পয়ো:নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বন্যার কারণ হিসেবে দেখা দেয়; সাগর ও নদীর তলদেশে জমার কারণে মাটি, পানি, প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং সামুদ্রিক জীবের ক্ষতি করে এবং যেসব প্লাস্টিক পূণরায় ব্যবহারের অনুপযোগী, তা মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করে; মাটিতে প্লাস্টিকযুক্ত হওয়ার কারণে বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা আরও ব্যয়বহুল হয়। প্লাস্টিক ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি করে এবং প্রজনন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে, শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধা এবং ক্যানসারের কারণ হিসেবে দেখা দেয়।
প্লাস্টিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতিবছর প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ব্যবহার করা হয়। এক কেজি প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রায় দুই থেকে তিন কেজি পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, যা বৈশ্বিক উঞ্চায়নে ভূমিকা রাখে।
প্লাস্টিকের দূষণে বছরে মারা যায় ১০ কোটি সামুদ্রিক প্রাণী :
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য নদী-নালা, খাল-বিল ও উন্মুক্ত স্থানে ফেলা হচ্ছে। এরমধ্যে আবার এক কোটি ৩০ লাখ টন প্লাস্টিক আবর্জনা সমুদ্রে পড়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। এতে প্রতিবছর ১০ কোটি সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে। জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক ব্যবহার হয় প্যাকেজিংয়ে। এ খাতে প্রায় ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে ২২ দশমিক ৪ শতাংশ, বিল্ডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনে ব্যবহার হয় ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ, অটোমোবাইলে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ইলেকট্রনিক্সে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কৃষিতে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। বছরে বিশ্বে ৫০ হাজার কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপাদন করা হয়। দুনিয়াজুড়ে প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিকের বোতল বিক্রি হয়। প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে প্রতিবছর এক কোটি ৭০ লাখ ব্যারেল তেল ব্যবহার করা হয়।
পরিবেশ অধিদফতর জানিয়েছে, বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক কাঁচামাল আমদানি করে। এ থেকে প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার টন বর্র্জ্য তৈরি হয়। এরমধ্যে ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ প্লাস্টিক, যার পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৭০০ টন। বাংলাদেশে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ৫০ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়।
প্লাস্টিক ব্যাগের কারণে দূষণের মাত্রা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এই ব্যাগ কখনও মাটিতে মিশে যায় না। আর যত্রতত্র ফেলে দেওয়ার ফলে এটি তৈরি করে জলাবদ্ধতা। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসেবে শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন দুই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। এগুলো দিয়ে ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়ছে।
বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ৩৫ লাখের বেশি টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। এসব ব্যাগ পলিথিনের হলেও কাপড়ের ব্যাগ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শপিং মল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, কাপড়ের দোকান, জুতার দোকান, ফ্যাশন হাউস, বিভিন্ন কোম্পানিসহ সারাদেশের বাণিজ্যিক বিতানগুলো টিস্যু ব্যাগ ব্যবহার করছে। নিষিদ্ধ পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ফলে কাগজ, পাট ও কাপড়ের ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এতে হাজার হাজার ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। লাখ লাখ শ্রমিক, বিশেষ করে নারী-শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে।