কর্ণফুলীতে পাথর নিয়ে ডুবে গেছে লাইটারেজ

50

বৈরী আবহাওয়ার কারণে কর্ণফুলী নদীতে ৯৫০ টন পাথর নিয়ে এমভি সী ক্রাউন নামের একটি লাইটারেজ জাহাজ তলা ফেটে ডুবে গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে কর্ণফুলীর নদীর ব্রিজঘাট এলাকায় মোবারক ঘাটে ডুবে যায় এই জাহাজটি। তবে ডুবে যাওয়া এই জাহাজে থাকা ১৩ জন নাবিক নিরাপদে তীরে উঠতে সক্ষম হয়েছেন।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিসি) উপ-পরিচালক গিয়াস উদ্দিন জানান, রাতে কর্ণফুলী নদীর ফিরিঙ্গিবাজার ব্রিজঘাট এলাকায় সী-ক্রাউন নামে একটি লাইটার জাহাজ আসে। এ জাহাজটি শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণ পাশে তীরের কাছাকাছি নোঙর করে পাথর খালাস করছিল। কিন্তু জাহাজটি সকালের দিকে তলা ফেটে ডুবে গেছে। জাহাজটিতে নাবিক-শ্রমিক সবাই নিরাপদে তীরে উঠেছেন সক্ষম হয়েছেন বলেন জানান তিনি।
জাহাজটির মাস্টার মোশাররফ হোসেন বলেন, গত বুধবার বিকালে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত এমভি ব্র্যাভো ট্রেডার নামে লাইটারেজ জাহাজ থেকে ১১০০ মেট্রিক টন পাথর নিয়ে কর্ণফুলী নদীর মোবারক ঘাটে আসে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে বুধবার গভীর রাতে কর্ণফুলী নদীর মোবারক ঘাটের পাশে তীরে জাহাজটির পেছনের অংশ উঠে যায়। রাতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে জাহাজটিকে পানিতে নামানো সম্ভব হয়নি। টানাটানিতে জাহাজটি কিছুটা পানিতে নামে, তবে তার একপর্যায়ে জাহাজটির তলা ফেটে যায়। এ অবস্থায় রাতেই জাহাজ থেকে বেশ কিছু পাথর নামানো হয়। পরে সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে জাহাজটি পুরোপুরি পানিতে ডুবে যায়। জাহাজটি ডুবে যাওয়ার সময় ৯৫০ টনের মতো পাথর ছিল। পাথরগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছিল। ডুবে যাওয়া জাহাজের মালিক মমতা ট্রেডিং এজেন্সি। জাহাজ মালিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় কর্ণফুলী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে যে স্থানে ওই জাহাজ নোঙর করা হয়েছিল সেখানে বন্দরের অনুমোদিত কোন ঘাট এবং বা জাহাজ নোঙর করার অনুমোদন নেই বলে জানা গেছে। স্থানীয় এক সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৫-৫৬ সালে অধিগ্রহণ করা ব্রিজঘাট এলাকায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রায় শত কোটি টাকার একটি জমি দখল করে এই জায়গায় কয়লা ও পাঁথরের ডিপো গড়ে উঠে। ওই ডিপোয় মালামাল আনলোডের জন্য বাঁশের তৈরি একটি সাঁকো তৈরি করা হয়। গত কয়েক বছর ধরে সিডিএ’র শত কোটি টাকার জমিটি বেহাত হয়ে থাকলেও কর্তৃপক্ষ অনেকটা নিরব দর্শক।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ডুবে যাওয়া জাহাজটি শিকলবাহার কাছাকাছি কর্ণফুলী নদীর তীরে আংশিক ডুবেছে। এ জন্য আমাদের জাহাজ চলাচলে কোনো সমস্যা নেই।

তাপদাহ বিদায়
সপ্তাহজুড়ে হতে
পরে বৃষ্টি

তুষার দেব
বিদায়ী বৈশাখের একেবারে গোড়া থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার তাপদাহ। উত্তরসূরীর কাছ থেকে পাওয়া সেই তাপদাহ নিয়ে খরতাপে শুরু হয় জ্যৈষ্ঠর যাত্রা। ক্রিকেটের ব্যাকরণ ও বনেদি সংস্করণ হিসেবে পরিচিত টেস্টের মতই এবার বেশ লম্বা ইনিংসই খেলে যাচ্ছিল অস্বস্তির তাপদাহ। জ্যৈষ্ঠের প্রথম প্রান্তিকের শেষদিকে এসে সেই খরতাপে জল ঢেলে দিল বৃষ্টিবলয়। আর তাতেই স্বস্তিভাব সমস্ত প্রাণীকূলে। আগামী কয়েকদিন মানে চলতি মে মাসের শেষ অবধি প্রকৃতি কমবেশি বৃষ্টিবলয়ের দখলেই থাকতে পারে। গত বুধবার দিবাগত রাত থেকেই তাপদাহকে আউট করে দেশের আবহাওয়ার পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বৃষ্টিবলয়।
এর আগে গত ১৮ মে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী বিভিন্ন ওয়েবসাইটের পূর্বাভাসের তথ্য মিলিয়ে চলতি মে মাসের শেষ সপ্তাহজুড়ে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বজ্র-ঝড়ের ঘনঘটা খবর প্রকাশ করেছিল দৈনিক পূর্বদেশ। ওই পূর্বাভাসকে মেনেই ২৩ মে দিবাগত রাত থেকে শুরু হল বৃষ্টিপাত। সারাদেশ থেকে বিদায় নিয়েছে তাপদাহ। এখন বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণও তুলনামূলকভাবে খানিকটা কমে এসেছে। আশির ঘর থেকে নেমে বাতাসে আর্দ্রতার হার সত্তর থেকে ৭৫ শতাংশে উঠানামা করছে। অস্বস্তির গরম থেকে মুক্তি মিলেছৈ। অবশ্য এই সময়ে বঙ্গোপসাগরে নি¤œচাপ সৃষ্টির আলামতও দেখছেন আবহাওয়াবিদরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের বৈশাখ শুরু থেকেই তাপদাহে তার ঝাঁঝ বুঝিয়ে দিচ্ছে। অস্বস্তির গরমে কাবু প্রাণীকূল। অসহনীয় তাপ আগুনের হল্কা হয়েই যেন বিঁধছে শরীরে। বাতাসে জলীয় বাষ্প কম থাকায় গরম অনুভূত হচ্ছে বেশি। ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র বিদায়ের পর বাতাসে আর্দ্রতার উপস্থিতি বেশি থাকায় সারা দেশেই অনুভূত হচ্ছে অস্বস্তির গরম। ঘরে বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসও খুব বেশি শীতল পরিবেশ এনে দিতে পারছে না। দিনভর প্রখর সূর্যের কিরণের সাথে আসা অতিবেগুনী রশ্মি ঘরের দেয়াল আর ছাদেও যেন উষ্ণতা জমিয়ে দিচ্ছে। সূর্য ডোবার পর দেয়াল ও ছাদে জমা উষ্ণতা বাতাসে মিশছে। সামর্থ্যবানদের ঘরে ও কর্মস্থলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালু থেকেছে হরদম। নিম্নবিত্তদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে বেশি। আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত খুলনায় দেশের সর্বোচ্চ ৬২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। আর দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে দিনাজপুরে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সর্বোচ্চ ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে সীতাকুন্ডে। তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করেছে। এর মধ্যে নগরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ছয় মিলিমিটার।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ আশরাফুল আলম পূর্বদেশকে বলেন, ‘গ্রীষ্ম মৌসুমে অঞ্চলভেদে মৃদু বা মাঝারি মাত্রার তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে, এবার তাপদাহ ছাড়াও কোনও কোনও অঞ্চলে গরম অনুভূত হচ্ছে বেশি। অসহনীয় গরম অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এটা বাতাসে জলীয় বাষ্পের স্বল্পতার কারণে। এখন তাপদাহ আপাত বিদায় নিয়েছে। মাসের শেষ সপ্তাহজুড়ে ঝড়-বাদলই থাকবে।
অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ী দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানতঃ শুষ্ক থাকতে পারে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, বাংলাদেশের উষ্ণতম মাস হল এপ্রিল-মে। বাংলা বর্ষপঞ্জির ঋতু পরিক্রমায় গ্রীষ্মের হামাগুড়ির সময়। বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম পক্ষের বিদায়ে যাত্রা শুরু হয় মে মাসের। ২০১৭ সালের মে মাসে টানা ১৯ দিনের তাপদাহে বিপর্যস্ত হয়েছিল সারাদেশ। ওইবছর ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জেলায় দিনের তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁইছুঁই। রাজশাহীতে তাপমাত্রার পারদ মৌসুমের সর্বোচ্চ ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে ছিল। কিন্তু, গত বছর মানে ২০১৮ সালের মে মাস ছিল উল্টো বৃষ্টিমুখর। ওই বছর মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে দেশে গড় বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। অধিদপ্তরের গবেষণার তথ্য বলছে, ১৯৮১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা ৩০ বছর গ্রীষ্ম ঋতুতে গড় বৃষ্টিপাত ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে কিছু কম। কিন্তু জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতির খেয়ালী আচরণের ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সাল থেকে গ্রীষ্ম ঋতুতে আবহাওয়া পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ওই বছর থেকে গ্রীষ্ম ঋতুতে অতিবৃষ্টি, দীর্ঘ সময় ধরে কালবৈশাখী, অত্যধিক বজ্রপাতের প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এর আগে অধিদপ্তরের মে মাসের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, পুরো মে মাসজুড়েই দেশের অধিকাংশ এলাকায় কমবেশি দাপট থাকবে তাপদাহের। আবার সাগরও কমবেশি উত্তাল থাকতে পারে। মাসের শেষের দিকে দেশের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে একটি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যান্য স্থানে এক থেকে দুটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টির আলামত রয়েছে, যার একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। উল্লেখ্য, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের আবহাওয়াবিদরা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি এবং ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু তাপপ্রবাহ হিসেবে গণনা করেন।