করোনা সংক্রামণরোধে সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠার উদ্যোগ জরুরি

34

বৈশ্বিক মহামারী করোনার আগ্রাসী থাবা দিনদিন বেড়েই চলছে। আমাদের প্রিয় এদেশও এ ভাইরাস থেকে মুক্ত নয়। গত মাস ধরে নানা পর্যবেক্ষণে যে আশঙ্কার কথা বিশেষজ্ঞমহল ও সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হচ্ছিল তা সম্ভবত সত্য হতে চরছে। গত সপ্তাহেজুড়ে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর হার দেখে এ অনুমান অমূলক নয় যে, এদেশ এখন কোভিড-১৯ -এর চূড়ান্ত আগ্রাসনে আছে। দেশে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিয়মিত ব্রিফে উল্লেখ করা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫জন করোনায় সংক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছেন। দেশে এটিই সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। এনিয়ে গত প্রাপয় দেড়মাসে করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ৭৫জন। তবে গত কয়েকদিনে করোনার লক্ষণ নিয়ে আরও বেশ ক’জনের মৃত্যু হওয়ায় ধারণা করা যায় পর্যাপ্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলে করোনাভাইরাসে মৃতের প্রকৃত সংখ্যাটা আরও বড় হতো হয়ত। দুর্ভাগ্যজনক, করোনার নমুনা পরীক্ষা ও এ রোগে সংক্রমিত রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে এখনও মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। শুরুতে একটিমাত্র স্থানে পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে সে সুযোগ বিভাগীয় শহরসহ প্রায় ৩০ জেলায় সম্প্রসারণ করা হলেও বলতে দ্বিধা নেই, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়ার জন্য নমুনা পরীক্ষা করা এখনও দেশে কঠিন কাজগুলোর একটি। এ জন্য অনেককে নানা আটঘাট পুড়ে টেস্ট করতে হচ্ছে, আবার অনেকে করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকলেও কোনরকম চিকিৎসা বা পরীক্ষা না করে লোকানোর চেষ্টা করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ সমস্যার পাশাপাশি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাব্যবস্থাও সন্তোষজনক নয়। চিকিৎসক ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নানা অসঙ্গতি ও সমন্বয়হীনতাও প্রকাশ পাচ্ছে-যা এ মুহূর্তে কারো কাম্য নয়। আমরা জানি, সরকার প্রধান করোনাভাইরাসরোধে নানা উদ্যোগ নিলেও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্র আশাব্যঞ্জক নয়। অনেক হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট নেই। নেই ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা। প্রকৃতপক্ষে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় হযবরল অবস্থা চলছে। একদিকে করোনার চিকিৎসা নিয়ে দুর্ভোগ, অন্যদিকে করোনার চিকিৎসা করতে গিয়ে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা হচ্ছে না ঠিকমতো।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, করোনা ছাড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, চিকিৎসাসেবা না পেয়ে তারা হাসপাতাল ছাড়ছেন। এমনকি অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বন্ধ রেখেছেন প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখা। অনেক রোগী এ হাসপাতাল, সে হাসপাতাল ঘুরে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করছেন বলেও খবর রয়েছে। বস্তুত করোনা আতঙ্কে চিকিৎসক ও নার্সদের একটি বড় অংশ সব ধরনের চিকিৎসাসেবা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) স্বল্পতা এবং সাধারণ রোগীরা যে করোনা আক্রান্ত নন, সে বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়ার কারণেই মূলত চিকিৎসাব্যবস্থায় এ সংকট দেখা দিয়েছে বলে অনেক চিকিৎসকের অভিযোগ। বিশেষকরে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মঈন উদ্দীনের দুঃখজনক মৃত্যু চিকিৎসার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার দিকটি উন্মোচিত হয়েছে। করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় চিকিৎসক ও নার্সদের যথাযথ প্রশিক্ষণেরও অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, হাসপাতালে রোগীদের কাছে কেন চিকিৎসক-নার্স যাচ্ছেন না, ভয় পাচ্ছেন কেন সেটা বের করতে হবে। ডাক্তার-নার্সদের ভালো করে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা রোগীর সেবা করতে পারেন। হাসপাতালে রোগী ও চিকিৎসকদের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা রাখতে হবে। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি দেশের সকল চিকিৎসকের জন্য পিপিইসহ অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে। একইসাথে চিকিৎসক ও নার্সদের ট্রেনিংও দেয়া হচ্ছে।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, বস্তুত শুরু থেকে করোনা রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা স্বাস্থ্য অধিদফতরের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকলে, দিকনির্দেশনা থাকলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। একটিমাত্র জায়গায় করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকায় বহু কোভিড-১৯ রোগীকে সময়মতো শনাক্ত করা যায়নি। ফলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা রয়েছেন মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। উপযুক্ত পিপিই সব করোনা রোগীর সেবকদের কাছে থাকা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া করোনার পরীক্ষা থেকে শুরু করে চিকিৎসা পর্যন্ত কার্যক্রমে যে সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পাচ্ছে, তাও দূর করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতর এসব সীমাবদ্ধতা দ্রæত কাটিয়ে উঠতে না পারলে দেশে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা মনে করি, সরকার যে উদ্দেশ্যে করোনা মোকাবেলায় বিশাল প্রণোদনাসহ নানা উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিয়েছে এর মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা অন্যতম প্রধান। তবে এসব বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।