করোনা যোদ্ধা করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি পরিবারের ওপর হয়রানি কাম্য নয়

112

এমরান চৌধুরী

প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস কাউকে করুণা করে না। কারণ এই নোবেল করোনা ভাইরাস কভিড-১৯ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ধনী নির্ধন, অস্পৃশ্যা, অশুচি কাউকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে দংশন করে না। তার হাত থেকে মাসুম শিশু থেকে অশীতিপরবৃদ্ধ কেউ রেহাই পায়নি। আজ হয়েছে আপনার প্রতিবেশির, কাল যে আপনার হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবে না কেউ। এটি এমন একটি অদৃশ্য ঘাতক কখন আপনার শরীরে বীজ ছড়িয়ে দিল বুঝতেই পারবেন না। তাই ঐ বাড়ির অমুক আক্রান্ত হয়েছে, তাদের বাড়িটি লকডাউন করে রাখা হয়েছে, এই নিয়ে খুশি হবার কোনো কারণ নেই। ঘোর শত্রুর বিপদেও সহযোগিতার হাত বাড়ানো একজন মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্য। যিনি ইতিপূর্বে শরীরের সামান্য অসুখে-বিসুখের চেকআপের জন্য চলে যেতেন সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে তাঁদের এখন সেখানে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস কোটিপতি আর দিনমজুরকে একই কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে। সবাই এই ভাইরাসের কাছে এতই অসহায় যে, যিনি জীবনে কোনোদিন সৃষ্টিকর্তার নাম নেননি, তিনি প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করছেন। এখন এই ভাইরাসের কাছে দিল্লিপিন্ডি, ওয়াশিংটন, বেইজিং, মস্কো, লন্ডন, ফিলিস্তিন সবাই সমান।
চন্দনাইশের উপজেলার আবিদ নামে দশ মাস বয়সী একটি শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। সেই তো মাসুম। সে কী জানত করোনার মতো প্রাণঘাতি ভাইরাস তার মতো শিশুকে পেয়ে বসবে?
সাতকানিয়ার ৬৯ বয়সী যে লোক মারা গেছেন তিনি কি জানতেন তাঁর শরীরে করোনা বাসা বেঁধেছে। জানতেন না। তাঁর মৃত্যুর পর করোনা শনাক্ত হয়। সঙ্গত কারণে তাঁর জানাজায় যাঁরা অংশগ্রহণ গ্রহণ করেছেন, তাঁরা তা না জেনেই করছেন। এখন যদি তাঁদের জানাজায় যাওয়া নিয়ে খোঁচানো হয়, সেই খোঁচাটা সকল করোনা রোগীর গায়ে না লেগে পারে না।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সমাজের কিছু লোক উঠেপড়ে লেগেছে করোনা আক্রান্ত রোগী এবং তার পরিবারকে নানাভাবে নাজেহালের। যেখানে তাদের দুর্দিনে সমবেদনা জানাবে, সমব্যথী হবে, সাহস যোগাবে, সেখানে উল্টো মানসিক চাপ সৃষ্টি করে তাঁদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে মৃত্যুর দিকে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। শুধু তাই নয় করোনা রোগীদের সেবায় বা হাসপাতালে কর্মরত স্বাস্থ্য কর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে হাসপাতালে চাকুরি করে কিংবা করোনা রোগীদের সেবাকর্মে নিয়োজিত আছে এরকম খবরের ভিত্তিতে অনেককে বাসা খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে অনেক বাড়িওয়ালা। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তা কিছুটা বন্ধ হয়। পুরো পৃথিবী যখন মানবিক বিপর্যয়ের শিকার, যেকোনো মুহূর্তে নিভে যেতে পারে নিজের বা প্রিয়জনের প্রাণের সলতে। সেখানে কিছু মানুষ ধরে নিয়েছেন তারা মরবেন না, তারা অমরণি পাতা সেবন করেছেন। আর তাই চাচ্ছেন হাসপাতালে কর্মরত বা করোনা আক্রান্ত রোগীদের পরিবারকে এক ঘরে করতে। করুন আপত্তি নেই। তার আগে একটা কাজ, শুধু একটা কাজ করে দেখান। আপনাদের বাহাদুরির দৌড় কদ্দুর একটু দেখে নেই। যারা গরিবের রিলিফ চুরি করে। ঘরের মধ্যে গর্ত করে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখে তাদের একঘরে করুন। পারবেন। মনে হয় না। আপনারা শুধু দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ওপর, এতিম আর দুর্বলের ওপর ছড়ি ঘোরাতে সেয়ানা, অন্যসবক্ষেত্রে একশ ভাগ অকার্যকর, কাপুরুষ।
স¤প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন সংস্করনে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ঢাকার ইমপালস হাসপাতালে চাকরি করতেন এক স্বাস্থ্যকর্মী। করোনা ভাইরাসের কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের ছুটি দিলে ২১ বছর বয়স্ক এই মহিলা গত ২১ এপ্রিল গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার সাদুল্লাপুর ইউনিয়নের লগন্ডা নামক নিজ গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়ি ফেরার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের নির্দেশে এলাকাবাসী ওই স্বাস্থ্যকর্মীকে কোয়ারেন্টাইনের নামে তার বাড়ি থেকে ৪০০ মিটার দূরে এক নির্জন স্থানে পুকুরের মধ্যে গোলপাতা দিয়ে ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে দিয়ে সেখানে তাঁকে থাকতে বাধ্য করেন। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তিনি রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে সেখানে অবস্থান করেন। ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেয়েটিকে উদ্ধার করে তার নিজের বাড়িতে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার ব্যবস্থা করেন। জানা যায়, এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে (দৈনিক যুগান্তর, অনলাইন সংস্করন, ২৮/০৪/২০২৯) এখন সচেতন মানুষ মাত্রই প্রশ্ন তুলতে পারেন, যে সরকার ক্ষমতায়, সে দলের স্থানীয় একজন নেতা কোন আইনে কোন খুঁটির বলে এই মেয়েটিকে কোয়ারেন্টাইনের নামে নির্বাসনে রাখলেন। এ রকম একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনার সময় স্থানীয় মেম্বার, চেয়ারম্যান কোথায় ছিলেন? জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের কী কোনো দায়িত্ব ছিল না মেয়েটিকে রক্ষার?
মানুষের অসুখে বিসুখে সবচেয়ে বড় নির্ভরতার স্থান ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী। একজন রোগী যখন হাসপাতালে তাঁদের সেবায় সুস্থ হয়ে ওঠেন তখন রোগীর মুখে ফুটে ওঠে অনাবিল হাসি। আর রোগী ও তার অভিভাবকের অন্তর থেকে উৎসারিত হয় সেবাকারীদের প্রতি আশীর্বাদ। এ কারণে ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীদের সেকেন্ড মাদার বলা যেতে পারে। মা যেমন তাঁর সন্তানের যেকোনো অসুখে আহার নিদ্রা ভুলে বিনিদ্র রজনী জেগে সেবা করেন চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীরাও প্রকৃত অর্থে তাই করে থাকেন। আর বর্তমানে একজন চিকিৎসক, একজন স্বাস্থ্যকর্মী জীবনের কত বড় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যেকোনো একজন চিকিৎসক, একজন কর্মী করোনা আক্রান্ত হতে পারেন। এই ভাইরাস এতই ভয়ংকর যে একটুখানি অসতর্কতায় একজন করোনা আক্রান্ত রোগীর হাতের স্পর্শে এটা যেকোনো মানুষের শরীরে বাসা বাঁধতে পারে।
তাই করোনার মতো প্রাণঘাতি রোগের সময় এক একজন স্বাস্থ্যকর্মী এক একজন যোদ্ধা। যুদ্ধক্ষেত্রে একজন সৈনিক যুদ্ধ করে দৃশ্যমান শত্রুর বিরুদ্ধে। এতে করে আত্মরক্ষার কোনো না কোনো উপায় খুঁজে নেওয়ার সুযোগ থাকে। এখানে শত্রু যেমন অদৃশ, তেমনি আত্মরক্ষার সরঞ্জামও সীমিত। ফলে প্রতিটা মুহূর্তে ধীর, স্থির ও সতর্কতার মাধ্যমে কাজ করে যেতে হয়। এ পর্যন্ত করোনা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন দুজন স্বনামধন্য চিকিৎসক ও একজন চিকিৎসা সহকারী। করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন শত শত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। পুলিশ বাহিনীর একজন এস আইসহ তিনজন পুলিশ সদস্য ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন ও সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি এন্ড রাইটসের হিসাব অনুযায়ী, দেশে এ পর্যন্ত ৩৯২ জন চিকিৎসক, ২১১ জন নার্স ও ২৯৮ জন অন্য স্বাস্থ্যকর্মীসহ মোট ১০০১ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন (দৈনিক আজাদী, ০১/০৪/২০২০, অনলাইন)। এর আগে বিএমএ এর সাধারণ সম্পাদক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী গত ২৮ এপ্রিল এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, এ পর্যন্ত সারাদেশে ৩১৪ জন চিকিৎসক, ১৫২ জন নার্সসহ ২৬৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন (বাংলাদেশ প্রতিদিন, তাং ২৯/০৪/২০২০)। এ ছাড়া আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক পদস্থ কর্মকর্তা, সৈনিক ও ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য এরা সবাই করোনা রণাঙ্গনের প্রথম সারির সৈনিক। তাঁদের প্রত্যকের প্রতি আমাদের আচরণ হতে হবে অত্যন্ত মানবিক। তা না হয়ে যদি নারায়ণগঞ্জের মতো ঘটনা ঘটে তাহলে আমাদের কপালে কোন দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে একমাত্র আল্লাহ পাকই জানেন। গত ২৮ এপ্রিল চিকিৎসক পরিবারের ১৮ জন করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় স্থানীয়রা তাদের বাড়িতে ইট নিক্ষেপ করে। শুধু তাই নয় স্থানীয় লোকজন পরিবারটিকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা চালায়। অথচ পরিবারটিও স্থানীয় এবং পরিবারের অভিভাবক নারায়ণগঞ্জ সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একজন মেডিকের অফিসার। অথচ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এদেশের সাধারণ মানুষ নিজে উপোস থেকে নিজের পাতের ভাত মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়ে মানবতার ঝাÐাকে ঊর্ধ্বে তুলে তাঁদের মনে অফুরান সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। আজকের এই মানবিক বিপর্যয়ে, মানুষের জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে একাত্তরের মতোই প্রত্যেকে নিজের জীবন বাঁচতে, নিজের পরিবারকে বাঁচাতে করোনা যোদ্ধাদের যোগাতে হবে নিরন্তর সাহস ও প্রেরণা । মনে রাখতে হবে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যসেবাকর্মী, আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সদস্যবৃন্দের ওপর এখন বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষের ভালো থাকা অনেকখানি নির্ভর করছে। এজন্য সরকারকে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারিদের নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য যাতে কোন বৈরী পরিবেশের মুখোমুখি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক