করোনা যুদ্ধে নারী চিকিৎসক ডা. আফরোজা আমাদের প্রেরনার বাতিঘর

70

জিয়া হাবীব আহ্সান

স্বার্থপর এ-পৃথিবীতে জীবিকার চেয়ে জীবন বড় প্রশ্ন তুলে যখন মানবতার সেবকরা আত্মসমর্পণ করে ঠিক সে মুহূর্তে করোনা যুদ্ধের ফ্রন্ট ফাইটার কিছু চিকিৎসক মানব সেবায় নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয়। তাঁদের প্রতি দেশ ও জাতির বিনম্র শ্রদ্ধা। আজ এমন এক চিকিৎসা সৈনিক নিয়ে লিখছি, যখন করোনা বা কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সংকট চরমে, যখন তারা নানা অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার তখন নিজের ও দুগ্ধ পোষ্য শিশু সন্তানের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন যে নারী চিকিৎসক তিনি আমাদের প্রেরনার বাতিঘর। সদ্য প্রসূতি জননী ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি বাতিলের আবেদন করেন ঐ চিকিৎসক। চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতালের ঐ মানবতাবাদী দুঃসাহসী চিকিৎসক যোদ্ধার নাম ডা. মাহমুদা সুলতানা আফরোজা। ডা. আফরোজার স্বামী আমার অত্যন্ত স্নেহধন্য ‘মা ও শিশু হাসপাতালের’ আজীবন সদস্য কর্মবীর লায়ন এম. মাহমুদুর রহমান শাওন। সিদ্ধান্তটি তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত হলেও তাঁর সহযোদ্ধা স্বামীর সমর্থনও তাঁর জন্যে বিশাল মানসিক শক্তি হিসেবে কাজ করে। ডা. আফরোজা দম্পতি আমাদের সমাজের জন্য ইতিহাসের পাতায় প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে চিরকাল। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু মানুষ গড়ার কারিগর আদর্শ শিক্ষক মানবাধিকারকর্মী রিদোয়ানুল বারীর মেয়ে ও আমার তালতো ভাই মরহুম আকতার আহম্মদ মাস্টারের পুত্রবধূ ডা. মাহমুদা সুলতানা আফরোজা। একজন মানবিক চিকিৎসক ও একজন দুগ্ধধাত্রী মা। সদ্য প্রসূত মাত্র সাড়ে চার মাস বয়সী একটি ফুটফুটে ছেলে আছে তাঁর। ছেলেকে পর্যাপ্ত সময় দিতে মাতৃকালীন ছুটিতে ছিলেন এ চিকিৎসক।
২০১৬ সালে এমবিবিএস পাস করা মেয়েটা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের জেনারেল সার্জারি বিভাগে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীতে আসে তার কোলজুড়ে একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান। বেশকিছু মাতৃত্বকালীন শারীরিক অসুস্থতা ও অতিরিক্ত রক্তচাপের কারণে নির্দিষ্ট সময়ের দুই মাস আগেই অর্থাৎ ৭ মাসেই শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়। মাত্র ১২০০ গ্রাম ওজনে জন্ম নেওয়া শিশুটি জন্মের পর ১৫ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল এবং মা ডা. আফরোজাও ৫ দিন আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। এত কষ্টের জীবন যুদ্ধের পর মা হিসেবে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছেন এই নারী চিকিৎসক। এবার করোনা-যোদ্ধা হিসেবেও নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিলেন ডা. আফরোজা। মায়ের আদর স্নেহ ও ভালবাসায় দেখতে দেখতে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটির বয়স এখন চার মাস পেরিয়ে গেছে। এরপরও সময়টা মায়ের বুকের দুধই একমাত্র সন্তানের খাবার। আর বেড়ে উঠতে প্রতিমুহ‚র্ত্বে চাই মায়ের মমতা, আদর আর পরশ।
তবে সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে একজন মা হিসেবে নয় বরং একজন চিকিৎসক হিসেবে একাধিক মায়ের প্রাণ রক্ষার্থে ছুটে যেতে চান তিনি নিজ পেশায়। বৈশ্বিক মহামারির এই দুঃসময়ে নিজের দুদ্ধপোষ্য শিশু সন্তানের কথা ভুলে গিয়ে নিজের মাতৃত্বকালীন ছুটি বাতিল চেয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন ডা. আফরোজা। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম দিকে শিশু সন্তানের কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ ইতস্ততায় থাকলেও পরবর্তিতে তার প্রবল আগ্রহে অনুমতি দেয়। গত ১৮ জুন ২০২০ইং থেকে নিজের দুধের শিশুকে পরিবারে রেখে এসে হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত হলেন তিনি।
গণমাধ্যমে দেওয়া তার সাহসী এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘মহামারির এই ক্রন্তিকালে ঘরে বসে থাকা একজন চিকিৎসকের কাজ নয়। চিকিৎসা পেশাটাই মানবাধিকার ভরপুর। যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তারাও কারো না কারো মা-বাবা, কারো সন্তান। এটি সবসময় মাথায় রেখে রোগীর সেবা করি। আমি চাই না বিনা চিকিৎসায় একটি প্রাণও ঝরে পড়ুক, এতে নিজের বিবেকের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে। অনেক চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
বর্তমানে চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। যারা সুস্থ রয়েছেন তারাও যদি গা ছেড়ে দেন, তাহলে রোগীরা যাবে কোথায়? তাই আমি নিজেই মাতৃত্বকালীন ছুটি বাতিল করে এই কঠিন ঝুঁকিময় সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ এরকম প্রজ্বলিত বক্তব্যগুলো আমাদের বর্তমান সমাজের জন্য আলোর দিশা, আলোকবর্তিকা। এরই মধ্যে আমরা হারিয়েছি চট্টগ্রামের করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. সমিরুল ইসলাম, ডা. জাফর হোসেন রুমিসহ কয়েকজন মানবিক চিকিৎসককে, ওঁনাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। সাথে সাথে শ্রদ্ধা জানাই করোনা যুদ্ধে শাহাদাৎ বরণকারী বাংলাদেশে প্রথম চিকিৎসক যোদ্ধা সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দীন এর প্রতি।
সবসময় মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন-বিএইচআরএফ এর অনুরোধে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের মধ্যে ল্যাব এইডের মেডিসিন ও কার্ডিও বিশেষজ্ঞ মাহবুবুর রহমান, চট্টগ্রামের শ্রদ্ধেয় কার্ডিওলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ নুরুল আমীন চৌধুরী, ডা. কোহিনূর আক্তার, মাউন্ট হসপিটালের ডা. ইকবাল করিম মুরাদ, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এ.জে.এম সাদেক, বাল্য বন্ধূ ডা. রকিবুল্লাহ, আমার বেহাই ন্যাশন্যাল হাসপাতালের এম ডি ডা. মোহাম্মাদ ইউসুফ, আমার ভগ্নীপতি রংপুর মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. আব্দুল কাদের জিলানী, আমার ছোটবোন ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস হাসি (এনেস্থেটিক রংপুর মেডিকেল কলেজে), আরেক ছোটবোন ঢাকা শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্মরত জান্নাতুল মাওয়া রুজি এবং আমার শ্যালিকা লায়ন্সের চক্ষু চিকিৎসক আসমা খানম প্রমুখের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তাঁরা আমাদের অনুরোধে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন প্রতি নিয়ত। আলহামদুলিল্লাহ্ ডা. আফরোজা গত ১৮ জুন হতে ১০ দিন করোনা রোগীর চিকিৎসা প্রদান শেষে কোভিড-১৯ টেস্ট দিয়ে এখন হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন। আল্লাহ পাক ওনার শিশু সন্তান সহ তাঁর পরিবার পরিজনকে হেফাজত করুন। আমি চিকিৎকার করে বলতে চাই, মানবতার জয় হোক। বাংলার ভাগ্যাকাশে হাজার হাজার মানবদরদী চিকিৎসকের জন্ম হোক, আমিন।

লেখক : মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী