করোনা ভাইরাসে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এখনই রোধ করার উদ্যোগ প্রয়োজন

22

শাহাবুদ্দিন খালেদ চৌধুরী

সারাবিশ্বে করোনাভাইরাস যে ভয়াবহতা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে আক্রান্ত প্রত্যেকটা দেশের সরকার এবং সাধারণ মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। সত্যি বলতে কি এই ভয়াবহ ভাইরাস মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশের সত্যিকার অর্থে কোনো প্রস্তুতি না থাকলেও, এই পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের আক্রমণের ফলে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তা অন্যান্য দেশের তুলনায় বিধাতার ইচ্ছায় অনেক কমই বলতে হবে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাওয়া এই ব্যাধি নিয়ে নিজেদের প্রাণবাজি রেখে রাতদিন ডাক্তার, নার্স এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অমানুষিক পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটা দেশের মানুষ কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ রাখবেন। এই ভাইরাসের ফলে সারা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে বিভিন্ন দেশ অনবরত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, কী প্রকারে এই অসহনীয় অর্থনৈতিক সমস্যাবলীর সমাধান করা যায়? জাতিসংঘের The United Nations conference on Trade And Development (UNCTAD) নামীয় সংস্থাটির প্রাথমিক হিসাবমতে সর্বমোট বৈষয়িক আয়ের ২ ট্রিলিয়ন ডলার কমে যাবে। সব দেশের আয় ধস নামার কারণে বৈশ্বিক বাৎসরিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২.৫ শতাংশ থেকে কমে যাবে। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবির হিসাব মতে ও কোভিড ১৯ ভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক বাৎসরিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২.৫ শতাংশ থেকে কমে যাবে এবং বিশ্ব তার জিডিপির ০.০৮৯ শতাংশ হতে ০.৪০৪ শতাংশ হারাতে পারে। বিশ্বের অর্থনৈতিক পতনের আঘাতটার দুই-তৃতীয়াংশ সইতে হবে চীনের অর্থনীতিকে। কেননা বিশ্বের জিডিপির ১৯ শতাংশের মালিকানা হচ্ছে চীনের। কাজেই চীনের অর্থনীতির উপর যে কোনো আঘাত বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। চীন বিশ্বের সব চাইতে বড় রপ্তানিকারক, সারা বিশ্বের রপ্তানির ১৩% শতাংশ চীন নিজেই করে থাকে। আবার আমদানির ব্যাপারেও চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ, সারা বিশ্বের সর্বমোট আমদানির ১১শতাংশ চীনই করে থাকে।
চীন যখন বিশ্বের সব চাইতে বড় উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারক, কাজেই কিছু সময় ধরে যদি চীনের শিল্প কারখানাগুলিতে উৎপাদন বন্ধ থাকে তাহলে সারা বিশ্বের অন্তত ১০০ টি দেশ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে । চীনের অর্থনীতি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। কাজেই চীন যে কোন দ্রব্য অন্য দেশ থেকে রপ্তানিবা আমদানি করুক এর বিশ্ব বাণিজ্যে বিরাট একটা প্রতিক্রিয়া হবেই, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চীনের যদি কোনো কারণে তেলের চাহিদা কমে যায়, তাহলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাবে প্রায় ৩০ শতাংশ। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বাংলাদেশ-চীনের উপরে ভীষণভাবে নির্ভরশীল। চীন বর্তমানে বাংলাদেশের সবচাইতে বড় রপ্তানিকারক। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পগুলির কাঁচামালের জন্য চীনের উপর নির্ভরশীল এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঔষধ ও চীন থেকে বাংলাদেশকে আমদানি করতে হয়। চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় ভিত্তির উপর অনেক বৎসর ধরে গড়ে উঠেছে। চীন আমাদের পরিবহন, জ্বালানিসহ বহুগুরুত্বপূর্ণ খাতে উল্লেখযোগ্য পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। করোনাভাইরাসের দুর্ভোগ শুরু হওয়ার পরপরই চীনের বড় বড় নির্মাণ কোম্পানি কাজ বন্ধ করে দেশে চলে গেছে। চীন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যবসায়িক অংশীদার। বাংলাদেশের কাঁচামালের বর্তমানে বড় উৎস হল চীন। বাংলাদেশের এক পঞ্চমাংশ আমদানি চীন থেকে আসে। ২০১৮-১৯ সালে চীন থেকে এসব মালের আমদানি মূল্য ছিল পাঁচ হাজার ছয়শত কোটি ডলার। করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের দেশে চীনের যেসব অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলির কাজ চলছিল তা বন্ধ হয়ে রয়েছে, চীনের যেসব নাগরিকরা ঐসব প্রকল্পে কাজ করতেন তারাও আপাতত চীনে ফিরে গেছেন। এই পরিস্থিতির ফলে চীনের এসব প্রকল্পগুলির বাস্তবায়নে খরচ অনেক বেড়ে যাবে ফলে আমাদের আবার নতুন ঋণ সংগ্রহের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের শুধু চামড়া খাতে ক্ষতি হবে ১৫ মিলিয়ন ডলার।
এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের প্রথমে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী যদি ছয় মাস করোনা ভাইরাসের আক্রমণ অব্যাহত থাকে বাংলাদেশের জিডিপির ১.১ শতাংশ কমে যাবে তার অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল্যমান ৩.০২ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ কমে যাবে এবং আরও সন্দেহ করা হচ্ছে যে এর ফলে বাংলাদেশের আট লক্ষ চুরানব্বই হাজার নয়শ ত্রিশ এর সম সংখ্যক চাকরী কমে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনীতির ওপর এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক সর্বশেষ যে গবেষণালব্ধ রিপোর্ট দিয়েছে তা অনেক ভয়াবহ। এডিবি এর সর্বশেষ রিপোর্ট হলো বাংলাদেশের অর্থনীতি করোনা ভাইরাসের ফলে ১৩.৩ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার অর্থ দাঁড়ায় আমাদের gross domestic product 4.9 percent কমে যাবে। অর্থাৎ আগে এডিবি বলেছিল আমাদের জিডিপি ১.১ শতাংশ কমবে এবং তাদের মতে ১.৪ মিলিয়ন থেকে ৩.৭ মিলিয়ন চাকরী কমে যাবে। এডিবি আরও বলছে যে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির ফলে বাংলাদেশের তিন দিক থেকে ক্ষতি হবে, দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কমে যাবে, রপ্তানি বাণিজ্য দ্রুত কমে যাবে এবং বৈদেশিক রেমিট্যান্সও কমে যাবে। এখন প্রশ্ন হলো আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের তিনটাই ছিল আসল চালিকাশক্তি। যাইহোক, আমাদের বাজেটের জন্য বাংলাদেশ এডিবির কাছ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছেন, এ প্রসঙ্গেই উপরোক্ত পরিসংখ্যানগুলো এডিবি উল্লেখ করেছে।বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় ৩৮.২৪ শতাংশ উন্মুক্ত এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য (বিশেষ করে গার্মেন্সসামগ্রী) ক্রেতা, বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্যের প্রায় সিংহভাগই উপরোক্ত দেশগুলি আমদানি করে থাকে।
মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস। বলতে গেলে বাংলাদেশের যে সব মানুষ বিদেশে চাকরী করে তার ৯৫ শতাংশ লোকই উপরোক্ত অঞ্চলের দেশগুলোতে চাকরী করে। উপরোক্ত দেশগুলিতে করোনা ভাইরাসের ফলে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সে ক্ষতির ফলে বাংলাদেশ ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশকে করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে যা যা করা দরকার তা করতেই হবে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমাদের যতটুকু উন্নত ব্যবস্থা থাকা দরকার তা বর্তমানে আমাদের নেই কাজেই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় উন্নয়ন অচিরেই সম্পন্ন করতে হবে।
আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামালের জন্য আমরা ভীষণভাবে চীনের উপর নির্ভরশীল। এখন আমাদের কাঁচামালের বিকল্প ব্যবস্থা ও অতি দ্রুত করতে হবে। যে সব প্রয়োজনীয় শিল্পের কাঁচামালের জন্য শুধু চীনের উপর নির্ভর না করে বিকল্প ব্যবস্থাও করতে হবে। চীনের থেকে বিভিন্ন ঔষধ আমদানির ক্ষেত্রে ও ইহা প্রযোজ্য। আসলে বিশ্বের প্রায় দেশের আমদানির ব্যাপারে চীনের উপর নির্ভরতা বেড়ে গেছে। এর মূল কারণ হলো বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকে চীনা পণ্যই সবচাইতে সস্তা এবং গুনে গ্রহণযোগ্য। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের থেকে আমদানি পণ্যের উপর শুল্ক বাড়িয়ে চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমঝোতায় আসতে আমেরিকা বাধ্য হলো। করোনা ভাইরাসের ফলে যে সব শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়েছে তাদের দিকে সরকারের লক্ষ্য রাখতে হবে। তাদের জন্য যদি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না যায় তাহলে তাদের জন্য ক্ষুদ্র আকারে ব্যবসা করার জন্য পুঁজির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা যতক্ষণ ঠিক করা যাবে না এবং ঋণ খেলাপিদের থেকে ব্যাংকিং ব্যবস্থা মুক্ত করা যাবে না ততক্ষণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা দেশের উন্নয়নে ব্যবহার করা কষ্টকর হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক