করোনা পরবর্তী পরিবেশ এবং আমাদের করণীয়

149

রাফিউল ওমর খান

করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী নেমে এসেছে স্থবিরতা, হাসপাতালগুলোতে চলছে মৃত্যুর মিছিল। চারদিকে স্বজন হারানোর আর্তনাদ। সেই সাথে বাড়ছে অর্থনৈতিক মন্দার আশংকা, বেকারত্ব, অপরাধ প্রবণতা ইত্যাদির ঝুঁকি।
কিন্তু বিপরীত চিত্রে প্রকৃতি তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। নগরায়ন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে পরিবেশ দূষণের কারণে প্রকৃতি যে রূপ হারিয়েছিলো তা ধীরে ধীরে ফিরে পেতে শুরু করেছে। দূষণের তালিকার শীর্ষে থাকা বড় বড় শহরগুলো নিজেদের মধ্যে যে বিশাল প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তো আজ তা কমে এসেছে। যার ফলে পরিবেশ সুন্দর হতে শুরু করেছে। নিউইয়র্কের মতো শহরে কার্বন মনো-অক্সাইড নিঃসরণ ৫০ শতাংশ কমে এসেছে। ভারতের বড় শহরগুলোতে দূষণের পরিমাণ কমেছে ২৫ শতাংশ। পৃথিবীর ৩০০ টিরও অধিক শহরে ভালো মানের বাতাসের পরিমাণ বেড়েছে ১১.৪ শতাংশ। লকডাউনের কারণে বায়ু দূষণজনিত মৃত্যু, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, বায়ু ও পানিবাহিত রোগে মৃত্যুসহ, শিশুদের মধ্যে এজমা জাতীয় রোগে সংক্রমণের হার অনেকাংশে কমে এসেছে।
সারাবিশ্বের বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণ থেকে শুরু করে সকল ধরনের দূষণ কমে আসায় জলজ ও বনজ পরিবেশে এসেছে নতুন প্রাণ। ওজোন হোল ধীরে ধীরে আয়তনে কমতে শুরু করেছে। বাতাসে অক্সিজেনের ঘনত্ব বাড়ছে। পৃথিবীর সকল বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য ফিরে আসছে। সামুদ্রিক এবং বনজ পরিবেশের প্রাণীদের স্বাধীন বিচরণে পরিবেশ অনিন্দ্য সুন্দর রূপ ধারণ করেছে।
অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে এখন যেমন বড় নেতারা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন, ঠিক তেমনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই পৃথিবীর সকল দেশ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নেমে পড়বে। তখন পরিবেশ দূষণের মাত্রা অনেকাংশে স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বেশী হয়ে যেতে পারে। যেখানে গ্রীন হাউজ ইফেক্ট বা কার্বন নিঃসরণের ব্যাপারটি নিয়ে আর কেউ চিন্তা করবে না। ছয়মাসের অর্থনৈতিক মন্দা একমাসে কাটিয়ে উঠার নেশায় মেতে ওঠবে বিশ্বের বড়বড় দেশগুলো।
অর্থনীতি বাঁচানোর দোহাই দিয়েই পরিবশ এবং জলবায়ুকে ধ্বংস করে দেয়া হবে। আমাদের অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ দূষণের কারণেই আমরা মহাদুর্যোগের কবলে পড়ি। এসব কথা জানা থাকার পরও আমরা অচিরেই পরিবেশের এই উন্নয়নকে আবারও ধ্বংস করে দিবো।
আমরা চাইলেই আমাদের সুন্দর পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য করে রাখতে পারি। এই কোভিড-১৯ কিন্তু আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা মোকাবেলায় অনেকাংশে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সচেতনতাকে আমাদের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। সংক্রমণরোধে এখন যেমন ব্যবহৃত মাস্ক, গ্লাভস কিংবা পিপিইগুলোকে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপানার আওতায় আনার চেষ্টা চলছে ঠিক তেমনি করোণা পরবর্তী সময়ে আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে সুষ্ঠু অবকাঠামো দান করতে হবে। এতে করে অনেকাংশে জলাবদ্ধতাসহ অন্যান্য সমস্যা লাঘব হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের বিভিন্ন খাতের অবকাঠামোগত নানান সমস্যা এবং অব্যবস্থাপনা বের হয়ে আসছে।এর ফলে আমাদের ওই সকল খাতের সমস্যাগুলো চিহ্নিতকরণ এবং উন্নয়ন সম্ভব হবে। এতে মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়বে।
আমরা চাইলেই ঘরে বসে কাজ করতে পারি, অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে পরিবহন খাতের জ্বালানীর কম ব্যবহার করা যাবে। ঘরেবসে কাজ করলে অফিসগুলোতে আর আলাদা করে এসি, ফ্যান কিংবা লাইটের পিছনে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ করতে হবে না। ফলে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের জন্য জ্বালানীর ব্যবহার এবং পরিবেশ দূষণ দুটোই কমে আসবে।
একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে পরিবেশ দূষণের ফলেই কৃষিজ উৎপাদন কমে এসেছে। লকডাউন পরবর্তী সময়ে আমরা অচিরেই কৃষিজ উৎপাদন বাড়িয়ে একই সাথে অর্থনীতি এবং পরিবেশ দুটোই বাঁচিয়ে রাখতে পারি। নিম্নবিত্ত এবং দরিদ্র শ্রেণীর মানুষদেরকে নিয়ে সরকারিভাবে আলাদা পরিকল্পনা করা যেতে পারে। যাতে করে অদূর ভবিষ্যতে এই ধরণের পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদেরকে আর সরকারের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে সাহায্যের চিন্তা করতে নাহয়। সকল শ্রেণীর মানুষের মাঝে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনয়ন যদিও সম্ভব নয়, তাও সহনশীল পর্যায়ের ভারসাম্য আনা গেলে অর্থনীতিও চাঙ্গা হওয়ার আশা করা যায়।
এছাড়াও বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে সুস্বাস্থ্য অর্জন এবং নিয়ন্ত্রণের সাথে জড়িত সকল খাতেই উন্নতি ঘটতে পারে।
সর্বোপরি করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, বাজার, চাহিদা, অভিবাসনসহ প্রায় সকল পর্যায়ে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে সকল চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক