করোনা পরবর্তী অর্থনীতি পুনঃগঠনে এখনই মনোযোগী হতে হবে

49

শাহাবুদ্দীন খালেদ চৌধুরী

গত মার্চের ২৫ তারিখ থেকে সারা বাংলাদেশে লকডাউন চলছে। ভাইরাস রোগের সব বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে একমত যে করোনা ভাইরাসের কবল থেকে বাঁচতে হলে এবং এর সক্রমণ ঠেকাতে হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বিশেষভাবে প্রয়োজন, সে জন্যে লকডাউনের কোন বিকল্প নেই। লক ডাউন বা একা থাকার হুকুমটা মানুষের বিশেষ করে আড্ডা প্রিয় বাঙালিদের স্বভাবের জাতিক্রম হওয়াতে এটি মানতে কষ্ট হচ্ছে, সে জন্য নানা উসিলায় ঘর থেকে বের হয়ে মানুষ অহেতুক ঘোরাফেরা করছে। পরিস্থিতি ভয়াবহতার মাঝেও মানুষকে ঘরে রাখা দায় হয়ে পড়েছে। আমাদের ছোট দেশ হিসাবে একদিকে মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি, অপরদিকে বেকারত্ব, খাদ্য সংকট ও চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল। ফলে লকডাউন পুরোপুরি বাস্তবায়িত করা প্রশাসনের পক্ষে কষ্টসাধ্য বিসয়ে পরিণত হয়েছে। দেশ নানা দিক থেকে চাপের মুখে। পণ্য সরবারাহের প্রবাহ অনেকটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কৃষকের অনেক উৎপাদিত পণ্য রাস্তায়, পথে-ঘাটে ফেলে দিতে হচ্ছে অথবা নাম মাত্র মূল্যে বিক্রয় করে দিতে হচ্ছে। গত কয়েক বছরের তুলনায়, এই বছর কৃষকদের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন বেশ ভালই হয়েছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাবের ফলে তারা এগুলো বিক্রয় করতে পারেন নাই। লকডাউনের পর থেকে অদ্যাবধি এদেশে যত দিনমজুর আছে তারা একেবারেই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া আমাদের দেশে প্রায় ৮৫ শতাংশ লোক চাকরি নিয়োজিত। কাজেই লকডাউনের পর প্রায় ঐ পরিমাণ লোকই বেকার হয়ে পড়েছে। এ সব লোকের সঞ্চয় বলতে কিছুই নাই বল্লেই চলে। কাজেই কর্মহীন হওয়ার সাথে সাথেই তাদের উপবাস করা ছাড়া কিই বা করার আছে? আমাদের দেশে যেসব শ্রেণীর লোক কর্মচ্যুত হওয়ার পরেই উপবাস যাপন শুরু করতে হয়, তাদের তালিকা দীর্ঘ। এদের মধ্যে রয়েছে চাষাবাদে নিয়োজিত দিন মজুর, নির্মাণ শ্রমিক, রিক্সা চালক ও ভ্যান চালকেরা, ট্রেক্সি চালক, দোকান কর্মচারী ইত্যাদি। আবার লক্ষ লক্ষ মানুষ আমাদের দেশে এমনও রয়েছে যাদের কোন পেশা বলতে কিছু নেই। যেমন ভিক্ষুক শ্রেণি, রাস্তার টোকাই শ্রেণি, শারীরিকভাবে অক্ষম হাজার হাজার পুরুষ ও নারী। উপরোক্ত শ্রেণীর লোকদের উপর লকডাউন অতি প্রয়োজনীয় হলেও কিন্তু এটি তাদের দুঃখ, দুর্দশা, অনাহারের এবং অর্ধহারের যাতনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ লকডাউনের কারণে করোনাভাইরাসের আক্রমণের আশংকা থেকে কিছুটা নিশ্চয়তা দিলেও অনাহারের এবং অর্ধাহারের থেকে বাঁচার নিশ্চয়তা লক ডাউনে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ এদেশে উন্নয়নের বড় বড় স্বপ্ন যতই দেখানো হউক না কেন, এ দেশের ২০% শতাংশ মানুষ এখনও হতদরিদ্র এবং করোনা ভাইরাসের আক্রমণের পর এ সংখ্যা হঠাৎ করে ৪০% শতাংশে দাঁড়িয়েছে। চীন, জার্মানী, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি দেশে লকডাউন সফল হয়েছে কারণ ঐ সব দেশে নি¤œ আয়ের মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন সুনিশ্চিত করতে পেরেছে।
এখন আমরা দু’টি জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। প্রথম হলো চলমান করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে মানুষকে বাঁচানো, দ্বিতীয় হলো অনাহার এবং অর্ধাহারের করুন অবস্থা থেকে ভ‚ক্ত ভোগীদের রক্ষা করা। এখন লকডাউনের সময় যতই বাড়ানো হচ্ছে ততই দেশের সার্বিক অর্থনীতির অবষর্ণনীয় ক্ষতি হচ্ছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কপর্দক শূণ্য হয়ে পড়েছে। তার অর্থ দাঁড়ায় বর্তমানের দেশের ৪০ শতাংশ স্থায়ী হতদরিদ্রের সাথে নুতনভাবে আরো কয়েকলক্ষ হতদরিদ্র যোগ হচ্ছে। এই অবস্থাটা বাংলাদেশের অর্থনীতি কতসময় পর্যন্ত সইতে পারবে তার অবশ্যই একটা সীমাবদ্ধতা আছে। এর বাইরে গেলে সমগ্র অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অনেক বৎসর ধরে এদেশের মানুষ বহু সংগ্রাম, ত্যাগ, তিতিক্ষা, অর্ধাহারের মধ্যে চলতে হয়েছে এবং এদেশের মানুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বলে এখনও চলছে। দু:খের বিষয় স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন মহলের সহযোগীতায় একটি ভুঁইপোড় শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে যারা অসৎ উপায়ে কোটি কোটি টাকা আয় করেছে এবং হাজার কোটি টাকা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে খেলাপী হয়ে, ঋণের টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। সর্বমহলে ডাটাসহ এবং কিছু পুংখানুপুংখরূপে জানা থাকলেও এদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নাই। এসব কারণে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দেশের উপর আসা বিভিন্ন বড় বড় দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য পূর্বে যে অটুট ঐক্য গড়ে উঠত তা ইতিহাস হয়ে গেছে। যাইহউক, এখন যেহেতু করোনা ভাইরাসের পর মানুষের দরিদ্রতা অনেক গুণ বেড়ে গেছে এবং লকডাউনের কারণে প্রায় সমস্ত বন্ধ বলা চলে। এই পরিস্থিতিতে, বিরাট আকারের সরকারী সাহায্য এবং বিভিন্ন অনুদান দেওয়া ছাড়া অন্যকোন উপায় নেই। সবচাইতে উত্তম হবে দুস্থদের নগদ সাহায্য দিয়ে দেয়া।
এতে স্বাধীনভাবে দুস্থ মানুষ তাদের প্রয়োজন মেটাতে খরচ করতে পারবে। সরকারও রিলিপের বিভিন্ন দ্রব্যাদি খরিদ করার ঝামেলা থেকে অব্যাহতি পাবে এবং এগুলি কিন্তে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সত্যতা মিথ্যা, অভিযোগ গুলি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে এবং সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো এ মালামাল গুলি দেওয়ার সময় মানুষের যে সমাবেশ হবে তা কোন অবস্থারই এড়ানো যাবে না, তাতে লকডাউনের মারাত্মক ক্ষতি হবে।
যাইহউক, এখন প্রশ্ন হলো একটা কিভাবে এবং কোথা থেকে সংগ্রহ করবে। জাতীয় রেভিনিউ বোর্ডের সাহাযে বাজেটের মাধ্যমে দেশের মানুষের উপর ট্যাক্স আরোপ করে এই টাকা সংগ্রহ করা খুব একটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে সরকার বাজেটে ঘোষিত দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে যে টাকা নেওয়ার কথা ছিল, তা অনেক আগেই নিয়ে নেওয়া হয়েছে, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাও বড় বড় ঋণখেলাপীদের কারণে প্রায় পঙ্গু অবস্থায় চলেছে। ইতোমধ্যে কিছু লোক নুতন টাকা ছাপানোর কথা সুপারিশ করেছেন। বর্তমানে টাকা ছাপানোর প্রস্তাব হাস্যস্পদ এবং টাকা ছাপিয়ে যদি টাকার সম্যার সমাধান করা যেতো তাহলে বিশ্বে টাকা সংক্রান্ত প্রায় সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। জার্মানীতে মহাযুদ্ধের পর টাকার সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, তারা টাকা ছাপিয়ে – এ সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল এবং তারা নুতন টাকা চাপিয়েছিল, এর ফলে জার্মানীর অর্থনীতিতে কি হাস্যস্পদ ও নাজুক পরিস্থিতিতির সৃষ্টি হয়েছিল তা বিশ্বের অর্থনীতির ছাত্রসহ সবার জানা। জার্মানীতে তখন বাজার করতে বস্তাভরে জার্মানীর মুদ্রা নিয়ে যেত হত। যাই হউক বর্তমান সরকারের হাতে পুঁজি সংগ্রহের খুব বেশি সুযোগ নেই। তারপরও সরকারকেই এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। বর্তমান যে সব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে তার মধ্যে যে গুলির কাজ স্থগিত রাখলে কারও চাকরী যাবে না বা অন্য কোন ঝুঁকিপূর্ণ অসুবিধা হবে না, সে ক্ষেত্রে আপতঃ সে প্রকল্প সমূহ কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা যায়। বিভিন্ন দেশের বড় বড় পুঁজিপতিরা তাঁদের দেশের এই দুর্দিনে এগিয়ে এসেছেন এবং বিলিয়ন ডলার তাঁরা বিলিয়ে দিচ্ছেন যাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলি অর্থনৈতিক সংকট কেটে উঠতে পারে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের ধনকুবেরাও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে দেশ মাতৃকার রক্ষার্থে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় লক্ষ কোটি টাকা আমাদের শিল্পপতি ঋণ খেলাপীরা হাতিয়ে নিলেও তাদের বিবেক এখনও ধ্বংশন করছে বলে মনে হয় না। আল্লাহ্র নাম স্মরণ করে একটিবার ভাবতে চেষ্টা করুন আজকে জাতির এই দুর্দিনে আমাদের টাকা বিদেশী দেশের কাজে লাগবে, আমরা উপবাস করব! আপনাদের এই জঘন্যতম কাজের জওয়াব স্রষ্টার কাছে কি দিবেন? ভেবে দেখেছেন কি? এর জবাব না দিয়ে পালানোর কোন উপায় নেই।
যে বিষয়টি এখন আমাদের জোর দিতে হবে, তা হলো, করোনা ভাইরাসের ফলে বাংলাদেশসহ বেশ কিছু স্বল্পোন্নত দেশ সঠিক ব্যবস্থা নিতে না পারলে খাদ্য নিরাপত্তাজনিত দিকদিয়ে দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা করতে হবে। সব মিলিয়ে এক মহামন্দার দিকে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। এসব দেশে সহিংসতা, নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিরতা বাড়তে আরম্ভ করছে। আমেরিকার একটি গবেষণায় উঠে এসেছে বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি বলে উঠে এসেছে আমেরিকার এক গবেষণায়। প্রায় দেশে করোনা আক্রান্তের যে সংখ্যা দেওয়া হয়েছে তার চাইতে যে অনেক বেশি লোক এই ভাইরাসে আক্রান্ত এ কথা প্রায় সু-নিশ্চিত।
লেখক : কলামিস্ট