করোনা ও প্রাসঙ্গিক কথা

89

মুশফিক হোসাইন

বিশ্বজুড়ে এক আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস। যা এখন সমগ্র বিশ্বে মহামারী আকারে আবির্ভূত। এই ভাইরাসের প্রাণ নেই, তবে বাহকের সংস্পর্শে আসার পর এক পর্যায়ে জীবনের ঝুঁকি হিসাবে দেখা দেয়। এ পর্যন্ত এই ভাইরাস আটবার তার চরিত্র বদল করেছে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই হলো এই ভাইরাস ছড়ানো হ্রাসের একমাত্র উপায়। আজ পর্যন্ত বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা ৭- হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ইউরোপের উন্নত দেশগুলো। আমেকিার অবস্থাও অত্যন্ত ভয়াবহ। আমেরিকায় এক দিনে মৃত্যুর রেকর্ড তিন হাজারের বেশি। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত পাকিস্তানে, তারপর ভারতে। ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোদিজি জনতার কার্ফু, হাতালি এবং সর্বশেষ নয় এপ্রিল ৯ মিনিটের জন্য সারা দেশব্যাপী বাতি নিভিয়ে মোমবাতি, কুপি বা স্মার্টফোনের আলো জ্বালিয়ে করোনা প্রতিরোধের জন্য জনগণকে একাট্টা হতে আহবান জানিয়েছেন। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় যে, ইটালিতে করোনা সনাক্ত হওয়ার ৪৫ দিনে, স্পেনে ৫০তম দিনে যুক্তরাষ্ট্রে ৬৫ দিনে মহামারী রূপ নেয়। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সনাক্ত হওয়ার ২৮তম দিন শেষ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২৪তম দিনে রোগী ছিলো ১১ জন। আর বাংলাদেশে ৬০ জন, মৃত্যুবরণ করেন ৮ জন। অনেকে মনে করেন, এই ভাইরাস সনাক্ত হতে ৮ থেকে ১০ দিন সময় লাগে। আমাদের দেশের জনগণের সামাজিক নিরাপত্তার নিয়ম মেনে চলার আগ্রহ খুব দেখা যাচ্ছে না। আমরা কেন সাবধান হচ্ছি না, যেখানে বিশ্বের ২৩০টি দেশের মধ্যে ২০৫ ইতিমধ্যে করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। আমরা কবে সচেতন হবো, সতর্ক হবো। আমরা জানি বাঙালি হুজুগে জাতি। এরা যুক্তি তর্কের ঊর্ধ্বে থেকে আবেগ দ্বারা তাড়িত হন। সামাজিক মাধ্যমে একজন রসিকতা করে স্টেটার্স দিয়েছেন, ‘বাঙালি বেহেস্ত গেলেও বিকেলে দোযখটা দেখার জন্য ঘুরতে বের হবে’। যদিও রসিকতা, কিন্তু এটাই বাঙালির ক্ষেত্রে বাস্তব।
লকডাউন অবস্থায় শহরে ও গ্রামে হাটবাজার বন্ধ থাকার কথা কেবল ওষুধ, খাদ্যপণ্যের দোকানগুলো ছাড়া। সরকার খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গতকাল ঘোষণা দিয়েছে কৃষি উপকরণ, কীটনাশক, সার প্রভৃতির দোকান খোলা রাখতে।
শহর ও গ্রামে নিম্ন আয়ের বিশেষ করে যারা দিনে এনে দিনে খায় তারা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। কাজ না থাকলে যা হওয়ার কথা। তাদের তো কাড়ি কাড়ি টাকা নেই যে, খাদ্য মওজুত করবে। তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থায়। এহেন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও দানশীল ব্যক্তিবর্গ খাদ্য সহায়তার নামে করোনা ছড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। যা অতি লজ্জাকর। দেখা গেছে, তারা খাবার নিয়ে যাওয়া মাত্র শত শত মানুষ খাদ্যের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আবার এমনও দেখা গেছে একটি সাবান দেওয়ার জন্য পাঁচজন দাঁড়িয়ে ফটোসেশন করছে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এ ধরনের ফটোসেশনের ছবি ভাইরাল হচ্ছে। অন্যদিকে, টিসিবির নায্যমূল্যে খাদ্যদ্রব্য কেনার জন্য শত শত মানুষের ভিড়। এসব ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্বের বালাই নাই। কবি আকতার একটি স্টেটার্সে লিখেন যে, তিনি যেখানে থাকেন তার পাশের গলিতে শত শত রিক্সার ভিড়। খবর নিয়ে জানলেন, কেউ একজন গাড়ি থেকে নেমে কয়েক প্যাকেট খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফটোসেশন করে গেছেন। এই খবর রটে যায়, ব্যস যায় কোথায়, শত শত রিকশা ড্রাইভার জমায়েত হতে শুরু করে। সামাজিক মাধ্যমে আরও দেখেছি দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ খাদ্য সহায়তার জন্য রাস্তায় ভিড় করছেন। দলে দলে খাদ্য উৎসের খোঁজে বের হয়েছেন। এখানেও সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকছে না। অনেকে আবার এটাকে পেশা হিসাবে নিচ্ছেন বলে মনে হয়। অথচ ইউরোপীয় দেশের রাস্তার মোড়ে মোড়ে খাদ্যপণ্য রাখা আছে, যা যেটা প্রয়োজন সেটা নিয়ে যাচ্ছেন। আর আমাদের চিত্র ভিন্ন, এখানে হুড়োহুড়ি, মারামারি চলছে শুধু খাদ্য নেওয়ার জন্য। অথচ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ প্রতি ইউনিয়নে গিয়ে তালিকা প্রস্তুত করে বাড়ি বাড়ি খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দেয়া। কে শুনছে কার কথা। সরকারের কাছে বিভিন্ন কর্মসূচি বাবদ এলাকাভিত্তিক তালিকা আছে। শেখ হাসিনা সে সকল কর্মসূচির কথা তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন। তারপরও তিনি প্রতি ইউনিয়নে গিয়ে তালিকা প্রস্তুত করে খাদ্য বিলির কথা বলেন। বাস্তবে তা হচ্ছে না। সরকারের এই মুহূর্তে ঘোষণা দেয়া উচিত যারাই সহায়তা করবেন জেলার জেলায় প্রধানমন্ত্রী তহবিলে জেলা প্রশাসককে দান করবেন। সরকার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রতি ইউনিয়নের তালিকা অনুযায়ী বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিতরণ করবেন। এক্ষেতে সরকার/জেলা প্রশাসক সেনাবাহিনীর সহায়তা নিলে খাদ্য সহায়তায় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। অন্যথায় করোনা আরও মহামারী আকারে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। হয়ত এমনও হতে পারে (আল্লাহ না করুন) ৪২ এর মন্বন্তরের মতো ঘটনা হতে পারে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী সে দেশের জন্য কয়েক হাজার কোটি ডলালের ফুড ব্যাংক গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সেখান থেকে কানাডার জনগণকে খাদ্য সহায়তা দেবার কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের খাদ্যের অভাব হবে না। সরকারের কাছে, কৃষকের কাছে এবং মিল মালিকদের কাছে পর্যাপ্ত খাবার মওজুত আছে। সামনে বোরো মওসুম। তারপরও শঙ্কা থেকে যায়। কানাডা বিশ্বে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। তারা যদি জনগণের কথা বিবেচনা করে খাদ্য ব্যাংক গড়ার চিন্তা করে তাহলে আমাদের সরকার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন। কথায় আছে সাবধানের মার নেই। বাংলাদেশ একটি দুর্যোগ সম্ভাবনার দেশ। ভূ-আঞ্চলিক গঠনের কারণে এখানে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি লেগেই থাকে। অতএব সরকারের উচিত হবে কঠোর হস্তে খাদ্য ব্যবস্থাপনাকে নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখা। বিশ্ব অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন বিশ্ব অর্থনীতিতে মারাত্মক মন্দা দেখা দিতে পারে।
এছাড়া করোনা মহামারীর কারণে বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা। তাই সময় থাকতে সরকারের উচিত হবে খাদ্য ব্যবস্থাপনা তথা উৎপাদন, গুদামজাতকরণ ও বিতরণ সর্বক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে চলে যাওয়া। কারণ সমগ্র বিশ্ব এখন মন্দা ও মহামারীতে আক্রান্ত।
আমাদের পোশাক শিল্পে নতুন এক সম্ভাবনা বিরাজ করছে। জানা যায়, দেশে মাস্ক, পিপিই প্রস্তুতের প্রচুর কাঁচামাল মওজত আছে। এগুলো রপ্তানি করে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার সুযোগ আল্লাহতায়ালা করে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে ৫ এপ্রিল থেকে পোশাক শিল্পের কারখানা খোলার কথা জানা যায়। অবশ্য এ ব্যাপারে কোন সরকারি প্রজ্ঞাপন দেখা যায় নি। এ সংবাদের ভিত্তিতে দেশের দূর-দূরান্তের জেলাসমূহ থেকে পোষাক মিল্পের কর্মীরা পায়ে হেটে (শত শত মাই) ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে এ জনস্রোতের দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। এটা মর্মান্তিক, যারা দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য কাজ করবেন, তারা সামাজিক দূরত্বের কথা ভুলে রুটিরুজির জন্য ভিড় করছেন। গার্মেন্টস শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে আগাম ঘোষণা দিয়ে সরকারের সহায়তা তাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বা অন্য ব্যবস্থা রোগ প্রতিরোধ) নিয়ে ঢাকার কর্মস্থলে আনা কী দূরুহ ছিলো? মোটকথা সরকারের করোনা প্রতিরোধের সদিচ্ছা থাকা সত্তে¡ও যথাযথ পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবে লেজেগোবরে হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের অবিবেচনাপ্রসূত কাজ করেছেন, তাদের বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। সরকারের উচিত হবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, খাদ্য সহায়তা, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, খাদ্য উৎপাদন এবং সর্বোপরী অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, প্রশাসনের সমন্বয়ে একটি আপদকালীন সেল গঠন করা, যারা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে এই আপদকালীন সহায়তা করবেন। এছাড়া ফটোসেশনের মাধ্যমে নিজেকে জাহির করা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা জরুরি। এখন মানুষ মানুষের তরে। দেখানো জন্য নয়। আসুন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি। গুজব না ছড়াই। রাজনীতি না করি। সকলের সকলে দেশের সেবা করি।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)