করোনা আতঙ্কে রোহিঙ্গা শিবিরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা

33

বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী অধ্যুষিত জনপদ কক্সবাজার। এ জেলায় বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে গাদাগাদি করে আশ্রয় নেয়া ১১ লাখ মানুষের বেশিরভাগই অসচেতন। ফলে বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের খবরে এসব রোহিঙ্গারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন। তাছাড়া অনেক বিদেশফেরত রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত নাগরিক ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে’ না গিয়ে শিবিরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতে ঝুঁকি বাড়ছে কক্সবাজারে।
করোনার কবল থেকে রক্ষা পেতে গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর মসজিদে দোয়া করা হয়। উখিয়ার কুতুপালং, লম্বাশিয়া, সীমান্তের শূন্যরেখা, টেকনাফের শালবন, নয়াপাড়া, জাদিমুরা, লেদাসহ বেশকিছু ক্যাম্পের মসজিদে এ বিশেষ দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে শত শত রোহিঙ্গা নাগরিক অংশ নিয়েছেন।
বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী অধ্যুষিত বসতি হওয়ায় টেকনাফ হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী তার এলাকাকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, এখানে আশ্রিত রোহিঙ্গারা মাঝেমধ্যে মিয়ানমার যাওয়া-আসা করে থাকেন। তাছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে করোনাভাইরাসের জন্মস্থান চীনের সীমান্ত রয়েছে, আর রোহিঙ্গারা চোরাইপথে মিয়ানমারে আসা-যাওয়া করেন। সেজন্য আমাদের ঝুঁকিটা অনেক বেশি। তাই আমার দাবি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংশ্লিষ্টদের বেশি নজর দেওয়া।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান জানান, এখন পর্যন্ত শিবিরে কোন করোনাভাইরাসের ল²ণ পাওয়া যায়নি। তবে যদি কোন রোহিঙ্গার উপসর্গ দেখা যায় তার রক্ত সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের আলাদা করে রাখার জন্য শরণার্থী শিবিরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ইতোমধ্যে ৪৭টি এবং রামু ও চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একশ শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে।
শরণার্থী রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের নেতা সৈয়দ উল্লাহ বলেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের খবরে তাদের মাঝে ভয়টা বেড়েছে। কারণ যেহেতু এখানে ঘিঞ্জি বসতি, তাই ঝুঁকিটাও বেশি।
তিনি বলেন, সা¤প্রতিক সময়ে তার শিবিরে এক বিদেশি রোহিঙ্গা নারী এসেছেন। সে এলাকায় ঘোরাঘুরি করলেও তার কোন পরীক্ষা হয়নি। এখন পর্যন্ত সরকার ও এনজিও সংস্থার পক্ষ থেকে করোনা সংক্রান্ত কোন কার্যক্রম হয়নি। কিভাবে এই ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়, সেটি অনেকে জানেন না।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি ও টেকনাফ নিবন্ধিত নয়াপাড়া ও লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের কর্মকর্তা আবদুল হান্নান বলেন, রোহিঙ্গারা এই ভাইরাস থেকে কিভাবে নিজেকে রক্ষা করবে সেটি বলছেন চিকিৎসকরা। যদি কোন মানুষের সন্দেহজনক জ্বর, সর্দি ও কাশি দেখা যায় সঙ্গে সঙ্গে শিবিরের স্বাস্থ্য বিভাগে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
রোহিঙ্গা শিবিরে করোনা ভাইরাস রোধে সচেতন করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করে টেকনাফ লেদা শরণার্থী শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলম বলেন, করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষায় হাত ধোয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম করতে বলা হচ্ছে। পাশাপাশি শিবিরে যাতে কোন লোক সমাগম না হয় সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। তাছাড়া দুইদিন আগে তার শিবিরে এক এনজিও সংস্থার পক্ষ থেকে কিছু রোহিঙ্গার থার্মাল প্লাস দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল। পাশাপাশি শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে প্রত্যেক মসজিদে বিশেষ দোয়া করা হয়েছে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. টিটু চন্দ্র শীল বলেন, রোহিঙ্গারা অবৈধপথে মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে পারাপার করে থাকেন। সীমান্ত ও উপকূল দিয়ে এসব রোহিঙ্গা এখানে ঢুকে পড়লে ঝুঁকিটা অনেক বেড়ে যাবে। তাই অবৈধভাবে কেউ যেন ঢুকতে না পারে সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। তাছাড়া যেহেতু করোনা ছোঁয়াচে আর শরণার্থী শিবিরগুলো ঘনবসতিপূর্ণ, তাই রোহিঙ্গা শিবিরে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘আইসোলেশান ইউনিট’ হিসাবে দেড়শ শয্যা প্রস্তুতের কাজ চলছে। সংক্রমণ মোকাবিলায় বিভিন্ন সংস্থার ২৮০ জন ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, শরণার্থীদের স্বাস্থ্য ও ভালো থাকার বিষয়টি আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকি, যদিও শিবিরগুলোতে এখনো কোভিড-১৯ সম্পর্কিত কোনো সন্দেহজনক ঘটনা পাওয়া যায়নি। তবুও এই পরিস্থিতিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ইউএনএইচসিআর। পাশাপাশি সংক্রমণ ঠেকাতে বিদেশি পরিদর্শকদের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। নতুন করে আসা বিদেশিদের ক্যাম্পে প্রবেশ একদম বন্ধ করা রয়েছে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, বিদেশফেরত এক রোহিঙ্গা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পে স্বজনের কাছে চলে আসেন। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। তাছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইসোলেট সেন্টার রয়েছে। বিদেশ ফেরত কেউ ক্যাম্পে আশ্রয় নিলে প্রশাসনকে অবহিত করতে বলা হয়েছে ক্যাম্পের মাঝিদের।
এদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা করোনা নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দা চিলড্রেনের ওয়েবসাইটে বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে সতর্ক করা হয়েছে।