করোনায় পরিবেশ ও সামাজিকদূষণ

280

মো. হাবিবুর রহমান

বিশ্বব্যাপী একটাই স্লোগান- ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন। কিন্তু ঘরে মানুষ কতদিন থাকবে? জীবন বাঁচাতে ও জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হতেই হয়। করোনাভাইরাস চীন থেকে শুরু হয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ঘুরে আজ আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। অদৃশ্য হলেও এ ভাইরাস পৃথিবীর সমগ্র ভূখÐ দখল করে আমাদের মনের ঘরেও বাসা বেঁধেছে। তাই তো আমরা অনেকেই শারিরীকভাবে ভাল থাকলেও মানসিকভাবে ভাল নেই। যারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের কস্ট অবর্ণনীয় ও সীমাহীন। জরুরী প্রয়োজনে ঘর থেকে বাইরে বের হয়েছেন, কিন্তু সাবধান। আপনার আশেপাশেই হয়ত ওতপেঁতে আছে এ মরণঘাতি ভাইরাস। যা মুহ‚র্তেই আপনিসহ আপনার পরিবারের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাস দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল রাষ্ট্র বিশেষ করে ভারত, পাকিস্থান, বাংলাদেশে এখনও ব্যাপক তান্ডব চালাচ্ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। বাংলাদেশে ৮ মার্চ ২০২০ তারিখে প্রথম সনাক্তের পর ১০৪তম দিন শেষে আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষাধিক ছাড়িয়েছে আর মৃত্যুর সংখ্যা ১৩৮৮ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ কে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণা করে ১১ মার্চ ২০২০ যা বর্তমানে ২১৩ টি দেশ ও অঞ্চলে বিস্তৃত হয়েছে। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতে মেগাসিটি ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরগুলোতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। পানি নিষ্কাশনের লাইনগুলো ময়লা-আবর্জনার স্তূপে এমনিতেই সারা বছর সরু ও বøক হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা থাকায় এর ব্যবহারও বহুলাংশে বেড়েছে। রাস্তায় বের হলেই দেখা যায় জনসাধারণ মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, ফেস-শিল্ড, হেড-ক্যাপ, পিপিই পরিহিত আছেন। ব্যবহৃত এসব সুরক্ষা সামগ্রীটেস্টিং ল্যাব, হাসপাতালের আশেপাশে, রাস্তাঘাট, ডাস্টবিন, নর্দমা ও খালের পানিতে ফেলা হচ্ছে। এগুলো আবারবিভিন্ন নদীপথে প্রবাহিত হয়ে সাগরে পৌঁছে যাচ্ছে। সমুদ্রে ভেসে থাকা এসব সুরক্ষা সামগ্রী আগামী ৪৫০ বছর ধরে সমুদ্রে দূষণ ছড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা সত্তে¡ও কিছু মানুষ কিছুতেই সতর্ক হয়নি। লকডাউনের ফলে পরিবেশ অনেকটাই দূষণমুক্ত ও বিশুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু এরমধ্যেই আবার কিছু মানুষের গাফলতিতে নতুন করে পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনছে। এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন সংস্থার এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাকালে ২৬শে মার্চ থেকে ২৫শে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দেশে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদিত হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০ টন যার বেশিরভাগই করোনাভাইরাস সুরক্ষা সামগ্রী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব পণ্য একবার ব্যবহার উপযোগী। ঘ৯৫, কঘ৯৫ সহ বিভিন্ন ধরনের সার্জিক্যাল মাস্ক, গ্লাভস, ফেস-শিল্ড, হেড-ক্যাপ, পিপিই, স্যানিটাইজার বোতল ইত্যাদি পণ্যের মূল উপাদান প্লাস্টিক সামগ্রী বা পলিপ্রোপাইলিন যা পরিবেশ বান্ধব নয়। প্লাস্টিকের মতোই বছরের পর বছর ধরে এসব সুরক্ষা সামগ্রী পরিবেশে দূষণ ছড়াবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর সারা বিশ্বে চিকিৎসকদের জন্য আট কোটি গ্লাভস, ষোল লক্ষ মেডিকেল গগলস এবং নয় কোটি মেডিকেল মাস্ক প্রয়োজন হয়।করোনা থেকে বাঁচতে বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষও প্রচুর পরিমাণে এসব সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করছেন। আর তারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বুঝে না বুঝে যেখানে সেখানে ব্যবহৃত এসব সামগ্রী ফেলছেন।কিছু ক্ষেত্রে ডাস্টবিন থেকে সংগৃহীত সুরক্ষা সামগ্রী পরিষ্কার করে আবার বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। আবর্জনা সংগ্রহকারীদের সুরক্ষার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দৃষ্টান্ত আমাদের নেই।
মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নিয়মানুযায়ী এসব পণ্য আলাদাভাবে প্রক্রিয়াকরণের বিধান থাকলেও আমরা তা মানছি না। রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রি পর্যন্ত এসব সামগ্রী পৌঁছাচ্ছে না। বাইরে থেকে ফিরে এসে বা বাসায় রোগীদের চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত এসব বর্জ্য সাধারণ ময়লা-আবর্জনার সাথেই মেশানো হচ্ছে। আবার ব্যবহৃত সুরক্ষা সামগ্রী নির্দিষ্ট স্থানে না ফেলে যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। আবার সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাকে অহেতুক গালমন্দ করা হচ্ছে। এসব দূষণ প্রতিহত করতে নিজেকে আগে দায়িত্বশীল ও সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। বাংলাদেশে নমুনা পরীক্ষা ও আক্রান্তের হার পর্যালোচনায় দেখা যায় ২০% পজিটিভ রোগী। অর্থ্যাৎ করোনা পরীক্ষা করতে আসা প্রতি ৫ জনে ১ জন করোনা পজিটিভ সনাক্ত হচ্ছেন। করোনা পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্ট দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করায় অনেকেই আক্রান্তের ঝুঁকিতে পড়ছেন। এসব স্থানে সামাজিক দূরত্ব প্রতিপালিত হচ্ছে না বরং আক্রান্তের খুব কাছাকাছি দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করতে হচ্ছে। অনেকেই টেস্ট করার পরপরই তার ব্যবহৃত গ্লাভস, মাস্ক যত্রতত্র ফেলছেন। পজিটিভ রোগীর এসব ফেলে দেওয়া গ্লাভস, মাস্ক, পিপিই অন্যের জন্য ভয়াবহতা ডেকে আনছে এবং মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। আবার টেস্টের নমুনা দেওয়ার পর কোয়ারেন্টাইনে না গিয়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছে। টেস্ট রিপোর্ট হাতে পেতে অনেক ক্ষেত্রেই বিলম্ব হচ্ছে। এই ফাঁকে পজিটিভ রোগী না জেনেই পরিবারের সদস্যসহ অনেকের সাথে মিশে আক্রান্তের হার বাড়াচ্ছে। হোম আইসোলেশনে না গিয়ে এমন খাম খেয়ালিপনার জন্য এ ভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া টেস্টবিহীন, অজানা ও উপসর্গবিহীন করোনা রোগীতো আমাদের সাথে নীরবেই মিশে আছে। ফলে করোনার অবস্থানকাল ও আক্রান্তের সংখ্যা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
করোনার ফলে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি সামাজিক দূষণও কম নয়। সরকারিভাবে করোনা পরীক্ষা বিনামূল্যে করা হচ্ছে। এর বাইরে বিভিন্ন উদ্যোগে বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ, দ্রুত সময়ে রিপোর্ট প্রদান ইত্যাদির সুযোগে অনেকেই বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। অসাধু চক্রের কারসাজিতে ভুয়া পজিটিভ-নেগেটিভ সার্টিফিকেট বিক্রির তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে মানহীন ও নকল গ্লাভস, মাস্ক, পিপিই, জীবাণুনাশক হ্যান্ড স্যানিটাইজার বাজারজাত করে ফায়দা লুটছে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দৃশ্যমান হচ্ছে। এসব নানাবিধ সামাজিক দূষণের কবলে পড়ে আমাদেরকে চড়ামূল্য দিতে হচ্ছে। করোনা আক্রান্তের প্রতি অযত্ন, অবহেলা, সামাজিক নিগৃহ বাড়ছে। এজন্য করোনা আক্রান্ত রোগীরা অনেকেই লোকচক্ষুর অন্তরালে গিয়ে গোপনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আবার অনেক করোনা রোগী ভয় পেয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে বার বার বলা হচ্ছে, মৃত ব্যক্তির দেহে সর্বোচ্চ তিন ঘন্টাকাল এ ভাইরাস অবস্থান করে এবং মৃত ব্যক্তির মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়ানোর কোন তথ্য প্রমাণ নেই। তারপরেও মৃত ব্যক্তির প্রতি আমাদের অবহেলা, দাফন বা সৎকারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ফলে সামাজিক দূষণ বাড়ছে।
পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন,হাজার হাজার বন্ধু বান্ধব ও শুভাকাক্সক্ষী থাকতে বেওয়ারিশ লাশ হতে হচ্ছে- যা মোটেই কাম্য নয়। আজকে যেটা অন্যের পরিস্থিতি, কালকে তা নিজের জন্য হবে না তার গ্যারান্টি নেই। আর করোনার জন্য ব্যক্তিগতভাবে কাউকে দোষারোপ করা যায় না। তাই পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা, সমব্যাথি আর মানবিক আচরণ করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক গোল্ডেন জিপিএ দ্বারা এসব শেখা যায় না বরং পারিবারিক ও সামাজিক পাঠশালায় এসবের শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়।
মহামারী সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ২৪৩ নং আয়াতে বর্ণিত আছে, বনি ইসরাইলের একটি দলের মাঝে মহামারী দেখা দিয়েছিল। যারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে মৃত্যু ভয়ে তারা নিজেদের আবাসভূমি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ তাদের সবাইকে একসঙ্গে মৃত্যু দেন।জানা যায়, তারা নিজেরা বাঁচার জন্য সন্তান-সন্ততি এবং অসুস্থদের পরিত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ তাদের স্বার্থপরতার জন্য এ শাস্তি দিয়েছিলেন। এ আয়াতের মূল শিক্ষা হচ্ছেবিপদের সময় ভয় না পেয়েসবার কথা ভাবতে হবে এবং মানবিক হতে হবে। সূরা রূম এর ৪১ নং আয়াতেআল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে; যার ফলে তাদের কৃতকর্মের মধ্যে কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তাদেরকে তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে’।
করোনা থেকে আমাদের কিছুই কি শেখার নেই? সবকিছুই আবার আগের মতই চলবে? অনেকেরই এ ধারণা হতে পারে। কিন্তু, না। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারে নাই। সাত মাসেরও অধিককাল ধরে করোনা তার মহামারী তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। করোনা সহসাইআমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিচ্ছে না। তাই করোনা ভয়ে ভীত না হয়ে সতর্কতার সাথে মোকাবেলা করা এবং প্রতিরোধমূলক কৌশল অবলম্বন করাই যুক্তিযুক্ত। আমাদের কৃতকর্মের ফল আমাদেরকেই আজ না হোক কাল ভোগ করতে হবে। তাই প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি যতœবান হওয়া প্রয়োজন। পরিবেশ ও সামাজিকদূষণের হাত থেকে এ ধরণীকে রক্ষায় আমাদেরকেই সোচ্চার হতে হবে। তবেই গড়ে উঠবে সুস্থ, সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী। আসুন, দায়িত্বশীল ও মানবিক আচরণ করি, দুষণমুক্ত ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ি।

লেখক: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উপসচিব