করোনায় আক্রান্ত বাংলাদেশ এবং অর্থনীতি

84

নিয়ম মানছেন না দেশে আসা ৪ লাখেরও বেশি প্রবাসী। তাই যা হবার তাই হলো। করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে দেশের মানুষ; আক্রান্ত দেশের অর্থনীতিও। প্রবাসীরাই দেশে করোনা বহন করে এনেছেন এটা অনেকটাই নিশ্চিত। গণমাধ্যমে প্রবাসীদের মাধ্যমেই করোনা আক্রান্ত হবার খবর পাচ্ছি আমরা। বিদেশ থেকে আগতদের ব্যাপারে বহু লেখালেখি আর সতর্ক করা হলেও কেউ কথা শোনেনি। প্রবাসী, প্রবাসীদের পরিবার-পরিজন এমনকি প্রশাসনের উদাসীনতায় করনে করোনা ভাইরাস ঠিকই ছড়ালো বাংলাদেশে। ইতোমধ্যে মন্ত্রী, এমপিদের করোনা বিষয়ক বক্তব্য জনমহলে বেশ সমালোচিত হচ্ছে। সতর্ক হওয়া গেলে হয়তো বাংলাদেশ করোনা মুক্ত থাকতে পারতো। প্রবাসীরা এসেছেন; অবাদে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁরা জনসমুক্ষে চলাফেরা করছেন এখনও। বিয়ে-সুন্নতেখৎনা, জন্মদিনের অনুষ্ঠান কোনটাই বাদ দিচ্ছেন না। তাই যা হবার তাইতো হয়েছে।
করোনা ভাইরাস গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। শেষ মুহ‚র্তে এসে সাধারণ ছুটিসহ দেশের কয়েকটি জেলায় লকডাউন করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, প্রবাসীদের যখন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলোনা সরকার তখন থেকেই সতর্ক হওয়া দরকার ছিলো। চীন, কোরিয়া, ইতালি, স্পেনের মতো করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে ছড়ালে দেশটির কি হবে? উন্নত বিশ্ব যেখানে সামাল দিতে পারছে না বাংলাদেশের সক্ষমতা এক্ষেত্রে কতটা আছে? বাংলাদেশ পুরোপুরি আক্রান্ত হলে থমকে যাবে দরিদ্র এদেশ। অর্থনীতির কি হবে তখন? আমাদের অর্থনীতিতে করোনা ভাইরাসের প্রভাব এখনই পরতে শুরু করেছে। চলমান শিল্প থমকে গেছে। বস্ত্রশিল্পের এমনিতেই বাজে অবস্থা। করোনার প্রভাবের ধাক্কা বস্ত্র শিল্প আদৌ সামাল দিতে পারবে কিনা তা সন্দেহ রয়েছে।
করোনা ভাইরাস আতংক কেটে যাবে একদিন। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। কিন্তু এ মুহূর্তে ঘটছে উল্টোটা। করোনা ছড়িয়েছে বিশ্বের ১৯৯ টি দেশে। বিশ্বব্যাপী মহামারী রূপ নেয়ায় আতঙ্ক শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে আক্রান্ত হয়েছে পুরো বিশ্ব অর্থনীতি। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সঙ্কট উত্তরণের পথ খুঁজছে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক ১২০০ কোটি ডলারের সুদমুক্ত ঋণ ঘোষণা দিয়েছে ইতোমধ্যে। স্বাস্থ্য উপকরণ কিনতে ৪ হাজার কোটি ডলারের জরুরি তহবিল ঘোষণাও এসেছে। লক্ষণীয় হলো, পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার শূন্যে নামিয়ে এনেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কি হবে? এদেশের ব্যাংক গুলো কি শূণ্য হারে তাদেও গ্রকদের ঋণ দিতে পারবে? অর্থনীতির ধাক্কা সামলানো এবং তা কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে বাংলাদেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে। মানবিক বিপর্যয় এড়ানোর জন্য সরকার সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে। দেশের মানুষও সতর্ক ও সচেতন। তবে বিশ্বমন্দাকালের পরিস্থিতি ভিন্ন। নিজ সম্পদ বৃদ্ধি, উৎপাদন বাড়ানো এবং কৃচ্ছ্রতাসাধন- দুঃসময়ের এসব স্মরণে রেখেই পরিকল্পনা নিতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সব মহলেরই গতি ও প্রস্তুতি আবশ্যকতা বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৬ শতাংশের বেশি হয় চীন থেকে। ইতোমধ্যে চীন থেকে আমদানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেক আমদানিকারক চীনের বিকল্প খুঁজছিলেন। এখন অন্য দেশেও ব্যাপকভাবে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। যে কারণে আমদানি ও রফতানি ব্যাপকভাবে কমার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গার্মেন্টসহ দেশের অন্তত ১৩ থেকে ১৪টি খাতে। এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিচারে। বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কার পাশাপাশি কিছু পণ্যের সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিতে পারে। একইভাবে প্রবাসী আয়ও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র বা ইতালির মতো বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে পণ্যের সাপ্লাই চেন বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে অর্থনীতি সচল রাখতে সরকারকে আগাম প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। পাশাপাশি সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত খাত চিহ্নিত করে আগামী ছয় মাসের জন্য একটি অর্থনৈতিক ঝুঁকির বাজেট করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। পরামর্শগুলো সরকার বিবেচনা করে দেখবে বলে আশা করা যায়। সরকারও বসে নেই। সম্ভাব্য পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করছে। আপাতত মানবসম্পদের সুরক্ষা বা মানুষের জীবন বাঁচানোই প্রথম বিবেচনা হলেও অর্থনীতির সম্ভাব্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঠেকাতে বাস্তবমুখী পর্যালোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে। করোনার স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হয়তো সাময়িক। দুঃসময় কেটে যাবে একদিন। কিন্তু অর্থনৈতিক বিপন্নতা বা ক্ষতি প্রলম্বিত হয়ে থাকে।
আমরা কিন্তু এ মহামারী থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারতাম। আমরা সচেতন ছিলামনা কেই। দেশের জনগণ, প্রশাসন, সরকার সবাই উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন সবাই। আমরা লক্ষ করেছি বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যাদের করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে তাদের কেউই বিদেশি নয়, প্রবাসী বাংলাদেশি। অর্থাৎ আক্রান্ত অন্য দেশ থেকে তারা করোনার জীবাণু সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। গত কয়েকদিন ধরে সংবাদ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে বিদেশফেরতদের ঔদ্ধত্যের খরব। তারা সতকর্তা মানছেন না। বিদেশ থেকে ফেরার পরে ১৪ দিনের যে কোয়ারেন্টাইনে থাকার কথা, তারা তা থাকছেন না। এতে তাদের পরিবার-পরিজন যেমন ঝুঁকিতে রয়েছেন তেমনি সারাদেশ হুমকির মুখে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৩৯ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে যে কয়জন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, যারা এর আগে আক্রান্ত এক প্রবাসীর পরিবারের সদস্য। এর আগে দ্বিতীয় দফায় ইতালি ও জার্মানি ফেরত যে দুজনের মধ্যে ভাইরাস ধরা পড়েছিল, তাদেরই একজনের মাধ্যমে তার পরিবারের ওই তিন সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। অর্থাৎ ঐ ব্যক্তি বিদেশ থেকে আক্রান্ত হয়ে ফিরে নিজের পরিবারের সদস্যদেরও ক্ষতি করেছেন। অন্যদিকে সর্বশেষ আক্রান্ত আরেকজন দেশেই ছিলেন, তবে তার বাড়িতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একজন এসেছিলেন। ওই প্রবাসীর সংস্পর্শে এসেই আক্রান্ত হয়েছেন দেশে থাকা ওই ব্যক্তি। সেই প্রবাসীর শরীরে সামান্য জ্বর ছিল, তবে তিনি রিপোর্ট করেননি। তিনি আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেছেন। এ বিষয়গুলো দুঃখজনক। ওই ব্যক্তিগুলো যদি সতর্ক থাকতেন তাহলে এরকম ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটতো না।
বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা জারি করা হয়েছে। যে কেউ বিশ্বের যেকোনও দেশ থেকে বাংলাদেশে এলে তাকে অবশ্যই ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। এজন্য ডিসি, টিএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, সিভিল সার্জন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের মেয়রদের এ বিষয়ে খোঁজ রাখতে বলা হয়েছে। বিদেশ ফেরতদের শনাক্ত করে তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। কেউ যদি এই নির্দেশ অমান্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রশ্ন হলো এদের ক’জন আইন মানছেন। আইনর আওতায়ইবা আনা হয়েছে ক’জনকে? নামমাত্র দুচারজনের খবর পাচ্ছি আমরা। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় জাতীয়, বিভাগীয়, সিটি করপোরেশন এলাকায়, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে কমিটি গঠিত হয়েছে। হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিবর্গ ১৪ দিন ঘরের বাইরে বের হবেন না এবং নিজ বাড়ির নির্ধারিত একটি কক্ষে অবস্থান করবেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্য দেশে প্রত্যাগত সদস্যের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করবেন। সরকারের গঠিত কমিটিসমূহ সমপ্রতি বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের বাড়ি চিহ্নিত করবেন এবং তাদের গৃহে সার্বক্ষণিক অবস্থানের বিষয়ে তদারকি করবেন। তবে ব্যক্তি পর্যায়ের সতর্কতা ছাড়া এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে কে কোথায় কী করছে তা সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা সম্ভব নয়। কাজেই ভয়াবহতা শুরু হবার আগে এই ভাইরাস প্রতিরোধে এখনই জনসচেতনা বৃদ্ধি করা জরুরি প্রয়োজন। ইতোমধ্যে শাস্তিমূলক ব্যাবস্থাও নেয়া হয়েছে। কিন্তু সচেতনতা ছাড়া শুধু শাস্তি দিয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তাই গুরুত্ব দিতে হবে সতকর্তায়। সবার অংশগ্রহণ ছাড়া করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
এ কথা সত্য যে, আমরা এক ভয়ঙ্কর সময় অতিক্রম করছি। আমরা বলতে গোটা বিশ্ববাসীই। এ সময় সাহস, সচেতনতা, সতর্কতাই সবচেয়ে আগে দরকার। রোগ প্রতিরোধে সর্বাত্মক আত্মনিয়োগ করা চাই। এ সময় যিনি আতঙ্ক ছড়াবেন তিনি সঠিক কাজ যে করবেন না সেটি বলাই বাহুল্য। তাই আতঙ্ক না ছড়িয়ে মানুষের মাঝে মনোবল বাড়ানোর কাজ এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। নিজে সচেতন হতে হবে, পরিবার, প্রতিবেশিদের সচেতন করতে হবে। সাহস দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় প্রতিদিন জনগনকে সাহস যোগাচ্ছেন। সর্বক্ষেত্রে খোঁজখবর নিচ্ছেন। দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। দেশবাসীকে সাহস যোগাচ্ছেন এই ভয়ঙ্কর ভাইরাস থেকে নিজেদের সুরক্ষায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে। তিনি বলেছেন, প্যানিক (আতঙ্ক) করবেন না, শক্ত থাকেন, সচেতন হোন। প্রকৃতই সচেতন না হওয়ার বিকল্প নেই। ভুল করার কোন সুযোগ নেই। সবাইকে মিলেমিশে সতর্কতার সাথে এ বিপদকালীন সময় পার করতে হবে। আলোচিত ভাইরাসটি দেশের সীমানার বাইরে থেকে আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। তাই বিদেশফেরতদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিজ ঘরে একা অর্থাৎ সঙ্গরোধ বা কোয়ারেন্টাইন অবস্থায় থাকতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তা সকলকে মানতে হবে। কারো মধ্যে লক্ষণ দেখা দিলে জরুরী চিকিৎসা নিতে হবে। রোগ হলে রোগ লুকিয়ে রাখার মতো বোকামি করা চলবে না। পরিবার তথা সমাজের অন্যকে সুস্থ রখার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। এই সচেতনতাটুকু সবার মধ্যে থাকা চাই।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ানোর বিকল্প নাই। অন্যকে সহযোগিতা করা ও সচেতন করে তোলার দ্বায়িত্ব আমাদেও সকলের। এদিকে কেউ স্বেচ্ছায় করোনা ভাইরাস বিষয়ে সচেতন না হলে আইন প্রয়োগের বিকল্প নেই। প্রশাসন ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে। তবে এ ধরনের ব্যবস্থা যাতে সমাজে আতঙ্ক না ছড়ায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট