করোনার আগে ক্ষুধায় মরে যাওয়ার শঙ্কায় তারা

66

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে ২১ দিনের জন্য ভারত লকডাউন করা হয়েছে। মানুষজনকে ঘরের ভিতরে থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু যাদের দৈনিক আয়ের ওপর ভিত্তি করে জীবন চালাতে হয় তারা পড়েছেন বিপদে। উপার্জনের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় তাদের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। লকডাউন ঘোষণার পর এমন কিছু মানুষের চিন্তার কথাই উঠে এসেছে বিবিসির প্রতিবেদনে।
দিল্লির শহরতলি নয়দায় প্রতিদিনই শত শত নির্মাণ শ্রমিক কাজের জন্য ভিড় করেন। দিন হিসেবে শ্রমিক ভাড়া করতে বিভিন্ন কোম্পানি এখানে ছুটে আসেন।
কিন্তু দেশটিতে লকডাউন ঘোষণা দেয়ার পর রোববার থেকে গোটা এলাকা নিরব হয়ে পড়েছে। পাখির শব্দ ছাড়া পুরো এলাকাই ওইদিন চুপচাপ ছিল। পুরুষদের একটা দল কোনায় লুকিয়ে বসেছিলেন।
ওই দলের একজন উত্তর প্রদেশের বান্দা জেলা থেকে আগত রমেশ কুমার। বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, তাদেরকে ভাড়া নিতে কেউ আসবে এটা তারা জানেন। তারপরও কাজের একটা সুযোগের জন্য তারা ওখানে জড়ো হয়েছেন।
রমেশ বলেন, ‘আমি প্রতিদিন ৬০০ রুপি উপার্জন করি । এই টাকা দিয়ে আমাদের পাঁচ সদস্যের পরিবার চলে। আমি করোনাভাইরাসের ঝুঁকির কথা জানি। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েদের না খেয়ে থাকা দেখতে পারি না। ’
লকডাউনে রাস্তার দোকানিরা পড়েছেন বিপদে : রমেশের মতো একই অবস্থা দেশটির হাজারো দিনমজুরের। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘোষণা অনুযায়ী মঙ্গলবার থেকে দেশটিতে লকডাউন শুরু হয়েছে। সেক্ষেত্রে আগামী তিন সপ্তাহ আয় না থাকা এমন দিনমজুররা বিপদে পড়তে যাচ্ছেন। আয়ের ব্যবস্থা না থাকায় এসব পরিবারে খাদ্য সংকট দেখা দেবে বলে মত অনেকের।আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা জানিয়েছে, ভারতের কমপক্ষে ৯০ ভাগ শ্রমশক্তি অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত।এর মধ্যে সিকিউরিটি গার্ড, ক্লিনার, রিকশাচালক, রাস্তার দোকানি, আবর্জনা সংগ্রহকারী এবং গৃহকর্মী উল্লেখযোগ্য।
এদের বেশিরভাগেরই পেনশন, অসুস্থ অবস্থায় ছুটি, বেতনভুক্ত ছুটি বা কোনও ধরনের বীমা নেই। অনেকেরই তাদের প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে নগদ টাকার ওপর নির্ভর করে। তাদের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টও নেই।
এছাড়া রয়েছেন প্রচুর পরিমাণে অভিবাসী শ্রমিক। যারা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে যান। আবার দেশটিতে ভাসমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও কম নয়। এরাও কাজের প্রয়োজনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছোটেন।
উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব এই চ্যালেঞ্জগুলো স্বীকার করে বলেছেন, ‘কোনও সরকার এর আগে এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন কারণ পরিস্থিতি প্রতিদিনই পরিবর্তিত হচ্ছে।’ তার মতে, এলাকায় এলাকায় রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে। অভাবী লোকদের খাবার পৌছে দিতে হবে। তিনি বলেন, যে যেই রাজ্য থেকে আসুক না কেন তাদের নগদ টাকা, চাল, গম দেওয়া দরকার।
প্রাক্তন এই মুখ্যমন্ত্রী ভারতের সবচেয়ে জনবহুল এই রাজ্য নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন আছেন।
তিনি বলেন, ‘কমিউনিটি পর্যায়ে সংক্রমণ এড়াতে মানুষজনকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া বন্ধ করতে হবে। এর মধ্যে একটি উপায় হলো খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কারণ সঙ্কটের সময় মানুষজন তাদের গ্রামে ছুটে যান।’
উত্তরের শহর এলাহাবাদের এক রিকশা চালক কিশন লাল জানান, গত চারদিনে তিনি কোনও অর্থ উপার্জন করেননি।
তিনি বলেন, ‘পরিবার চালানোর জন্য আমার টাকা প্রয়োজন। শুনেছি সরকার আমাদের খাবার কেনার জন্য টাকা দেবে। কিন্তু আমি এখনও জানি না, কবে, কোথায় এই টাকা দেয়া হবে।
তিনি জানান, যে দোকান থেকে তিনি বাকীতে খাবার কেনেন দু’দিন আগে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি দোকানের টাকা পরিশোধ করেননি। দোকানটি কখন খুলবে তাও তিনি জানেন না। কিশন লাল বলেন, ‘আমি খুব ভয় পেয়েছি । আমার একটি পরিবার আছে, আমি কীভাবে তাদের খাওয়াবো?’
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লাখো মানুষ রাস্তায় দোকানদারি করে অর্থ উপার্জন করেন । অনেকের ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হাজারো মানুষ কাজ করে।
দিল্লিতে পানীয় বিক্রি করার এক ছোট স্টল চালান মোহাম্মদ সাবির নামের এক ব্যক্তি। তিনি জানান, গরমের সময় ভালো ব্যবসার আশায় সম্প্রতি আরও দুজনকে তিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ’আমার কোনও টাকা নেই। গ্রামের কৃষিকাজ থেকে আমার পরিবারের কিছু আয় হয়। কিন্তু এই বছর শিলাবৃষ্টির কারণে ফসলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমার পরিবার আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ’আমি খুব অসহায় বোধ করছি। আমার মনে হচ্ছে, করোনাভাইরাসের আগে ক্ষুধা আমাদের অনেককে মেরে ফেলবে।’
এদিকে দেশটির সব পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন। রাইডারভিত্তিক যান বন্ধ হওয়াতে অনেকের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
দিল্লির এক ট্যাক্সিচালক জোগিন্দার চৌধুরী বলেন, সরকারের আমার মতো লোকদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়া দরকার।
তিনি বলেন, ‘আমি লকডাউনের গুরুত্ব বুঝতে পারি। করোনভাইরাস বিপজ্জনক এবং আমাদের নিজেদেরকে রক্ষা করা দরকার। ’ তিনি আরও বলেন, কিন্তু আমি ভাবতে পারছি না, কয়েক সপ্তাহ ঘরে থাকলে কীভাবে আমার পরিবার চালাবো।
তার মতো অনেকেই করোনভাইরাস সম্পর্কে জানেন। কিন্তু নিজেদের পরিবার চালানো নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ নেই। দিল্লির রাস্তায় পানি বিক্রি করা বিনোদ প্রজাপতি বলেন, ‘আমি করোনাভাইরাস সম্পর্কে সব কিছু জানি । এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক, পুরো বিশ্ব এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে।’ তিনি জানান, যাদের সামর্থ আছে তারা ঘরে থাকতেই পছন্দ করবেন। কিন্তু তাদের মতো মানুষের কাছে নিরাপত্তা ও ক্ষুধার মধ্যে যেকোন একটা বেছে নিতে হবে। তার প্রশ্ন, আমাদের কোনটি বেছে নেয়া উচিত হবে? খবর বার্তা সংস্থার