করোনাভাইরাস মহাশক্তিধর পরাশক্তিকেও ভয় পায় না

54

জামাল উদ্দিন

মরণরোগের ভাইরাস বনাম মানুষ, এই দাবা খেলা চলছে মানবজাতির আদিযুগ থেকে। বহু মহামারি পেরিয়ে মানুষ বেঁচে আছে কেবল তার প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিরোধশক্তি দিয়ে। আজও বিশ্বে এক হাজারের বেশি প্রজাতির ভাইরাস রয়েছে। তাদের উপস্থিতি সর্বত্র, সর্ব জীবে। তবু আমরা বেঁচে আছি। এমনকি বাইরের কোনও সহায়তা, কোনও টিকা বা ওষুধ, কোনও রকম চিকিৎসা ছাড়াই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করে আজ বেঁচে রয়েছেন অনেক মানুষ। তকে পূর্বেকার মহামারির চেয়ে কোভিট-১৯ খুবই ভয়ঙ্কর সংক্রমণ। বিশ্বের ২১১টি দেশ এখন এ মহামারিতে আক্রান্ত। অতীতে একই সাথে এত দেশ কখনো আক্রান্ত হয়নি। গত মাসের শেষ দিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে করোনাভাইরাস অতি দ্রæত সব গ্রাস করে নিচ্ছিল তা দেখে অনেকের মতো আমিও বলেছিলাম, এ যুদ্ধ সহজে থামার নয়। আসলে এটা তো যুদ্ধই বলা যায়, প্রায় একতরফা। বিশ্বের ২১১টা দেশের সরকার আর ৬০০ কোটির ওপরে মানুষ এক অদৃশ্য মহাশক্তিশালী শত্রæর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। করোনাভাইরাস এমন একটি ভাইরাস যে আমাদের মহাশক্তিধর আমেরিকা, চীন, জাপান, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশের কোনো মারণাস্ত্রকেই ভয় পায় না। পারমাণবিক অস্ত্র যা দিয়ে এক দেশ আরেক দেশকে নিশ্চিহ্ন করার ভয় দেখায় তাকেও না। ফলে হয়েছে কী, এখন নিজেদের জীবন বাঁচাতে সব দেশের মানুষ ঘরে উঠে গেছে। ঘরবন্দি হয়ে বাঁচার চাইতে প্রাণঘাতী এই করোনাভাইরাস থেকে দেখার বিষয়টি হচ্ছে, যে আমেরিকা অর্থবিত্ত আর সমরাস্ত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী বলে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ায় সেই আমেরিকাতেই করোনা আক্রমণ সবচেয়ে পর্যুদস্ত। অথচ এই শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো অস্ত্রের বলে বলিয়ান হয়ে সমগ্র পৃথিবীতে কৃত্রিম মহামারি কী সৃষ্টি করেনি? যেটাকে বলা হয় মনুষ্যসৃষ্ট মহামারি। এ সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি!
অর্থনীতিবিদ ম্যলথাসের জনসংখ্যা তত্ত¡ অনুসারে পৃথিবীর জন সংখ্যা যাতে খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বাড়তে পারে সে জন্য ইতিহাসে দুর্বল জনগোষ্ঠীর উপর নিবীর্যকরণ (স্টেরিলাইজেশন)সহ অনেক ধরনের নিষ্পেষণ চালানো হয়েছিল। ১৮৪০ সালে আয়ারল্যান্ডের দুর্ভিক্ষের সময়ে ব্রিটিশ সহকারী অর্থমন্ত্রী চার্লস ট্রেভেলিয়ান বলেছিলেন, দুর্ভিক্ষ হচ্ছে অতিরিক্ত জন সংখ্যা কমানোর প্রাকৃতিক উপায়। বিংশ শতাব্দীতে এসে ক্ষমতাধরেরা আরও ধুরন্ধর হয়েছে। হিটলার থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) ক্ষমতাধরেরা শুধু দুর্ভিক্ষের আশায় বসে না থেকে, হয় নিজেরাই পরোক্ষভাবে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছে। নয় তো নিজের ক্ষমতা দিয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অজুহাতে যুদ্ধ করে লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরেছে। সবই দুর্বলকে সংখ্যায় আরও দুর্বল করে ম্যালথাস বা ডারউইনের তত্তে¡ বিশ্বাসী সবল জাতিকে আরও শক্তিশালী করে তাদের ভবিষ্যৎ। প্রজন্মকে পৃথিবীর আধিপত্য দিয়ে রাখার পাঁয়তাড়া ছাড়া আর কিছুই নয়।
১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫। এই ২০ বছরে ভিয়েতনামে কত মানুষ মারা গিয়েছেন, জানেন? দক্ষিণ আফ্রিকার ভিয়েতনাম দূতাবাসের সুত্র মতে, শুধু সাধারণ মানুষই মরেছে ২০ লক্ষের চেয়ে বেশি। এর জন্য দায়ী কে? সেই ১৯৬৪ সাল থেকে দুর্বল প্যালেস্টাইনে চলছে লাশের শোভাযাত্রা। ১৯৭১-এর ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানি হানাদাররা বাংলাদেশে হত্যা করেছে ৩০ লক্ষ মানুষ। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষে পরাশক্তিগুলোর সামনে মানুষ মরেছে কুকুরের সঙ্গে খাবারের লড়াইয়ে। ইরান-ইরাক যুদ্ধে শুধু মাত্র নিহতই হয়েছে ৩ থেকে ৫ লাখ লোক। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকাতে ৩ হাজার প্রাণ সংহারের জের ধরে গত ১৮ বছরে চোখের সামনে দিয়ে ইরাক-আফগানিস্তানে ঝরে গেছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ। লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনে মানুষ হরদম মরছে গুলি আর বোমায়। নয় পালাতে গিয়ে মরছে জলে ডুবে। এ যেন কোন উপায়ে মারা যেতে চাও, তার লটারি! মনে আছে সেই সিরিয়ান শিশুটির ভেসে আসা মৃতদেহের কথা? একটি সূত্র মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন জাতিগত সংঘর্ষ বা যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৮০ লক্ষেরও বেশি। আমার ধারণা, এ সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। ভিটে হারানো লোকদের কথা না হয় বাদই দিলাম। এই ৮০ লক্ষ প্রাণ হারানোর দায় কার? এ সভ্য (?) মানবজাতির নিশ্চয়ই। সেই সভ্য জাতির একজন সদস্য হয়ে এর দায় থেকে তো আমি মুক্তি পেতে পারি না। পারি কি?
করোনার দাপটে বিপর্যস্ত এ বিশ্বের চট্টগ্রাম নামক একটি শহরের একটি ঘরের ভূতলে লুকিয়ে আছি আজ প্রায় দুই মাস। লুকিয়ে থেকে ভাবছি, সমুদ্রতীরে উপুড় হয়ে থাকা মৃত সিরিয়ান শিশুটির কথা। ভাবছি মৃত বাবার পিঠে রিওগ্রান্ডে ভেসে আসা দু’বছরের সালভাদরিয়ান শিশুর অসাড় দেহটির কথা। কী অবলীলায় আমরা ভুলে যাই ওদের। যেন কিছুই হচ্ছে না কোথাও। সৌদি-মার্কিন বোমায় ক্ষত-বিক্ষত ইয়েমেনির লাশ পড়ে থাকে আমার চোখের সামনে। একটু জলের জন্য হাহাকার করে মরে আহত স্বজন তার। আর আমি কমলার রসে ঠোঁট ভিজাই। তুরস্কের নিক্ষিপ্ত গোলায় কুর্দি পরিবার মিশে যায় সৃষ্টিকর্তার জমিনে। ধুলোবালি আর ধোঁয়ার বহর ওড়ে। আমি কফির মগে ধোঁয়া তুলি। ইজরায়েলি বিমান হানায় গাজায় জ্বলে দাউ দাউ আগুন। আদিম মানবের আগ্রাসী ফলায় ছিটকে পড়ে কারও হাত, কারও মাথা আর কারও উরু। আমি মুরগির রানে কামড় বসাই। আমি ধরে নিয়েছি, এসব স্বাভাবিক। আমি, আমি আর আমি। সারা দিন শুধু আমি ছুটি, আমার পিছনে। তাই এটা আমার শাস্তি। এ শাস্তি আমাকে ভোগ করতেই হবে।
আমি-আমি, আমার-আমার করতে গিয়ে এ বিশ্বকে বাসের অযোগ্য করে ফেলেছি আমরা। ভিয়েতনামে যে পরিমাণ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে তার ধংসলীলা হিরোশিমা-নাগাসাকির থেকে ৭০০ গুণ বেশি। ফাটেনি এমন বোমা নিষ্ক্রিয় করতে ওদের লাগবে ৩০০ বছর। ফসলি জমির বিনাশ হয়েছে বেশুমার। যুদ্ধবিধ্বস্ত অন্য দেশগুলো সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেন আজ শ্মশানের মতো। যেন মৃত্যুপুরীর ভাস্কর্য। মায়ানমারের আরাকানে খাঁ খাঁ করছে রোহিঙ্গা বসতিগুলো, প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ হাজার বছরের প্রাচীন জনবসতি ছেড়ে নাফনদীর তীরে বাংলাদেশের ককাসবাজারে এসে আশ্রয় নিয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত বুভুক্ষু জনগোষ্ঠী, মেডিটেরিয়ানের তীরে ভেসে আসা কৃশকায় লাশের সারি, এ সবই হচ্ছে সভ্য মানবজাতির অসভ্য লালসার ফসল। সে লালসার চূড়ান্তে পৌঁছেছে। আমরা পৃথিবীর বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছি সিএফসি, কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড। সমুদ্রের লোনা জলে হারিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি, কৃষকের ভিটে, আর জেলেদের সংসার। লাল নীল কাঁকড়ারা আজ আমাদের সৈকতে আসে না। কচ্ছপেরা হারিয়ে গেছে দূর সমুদ্রে। ঘন কুয়াশার চাদর আজ বিলীন হয়েছে ধুলোর আস্তরণে। প্রকৃতি কি এর শোধ নেবে না?
মানুষ যেমন প্রকৃতির অংশ, অন্য সৃষ্টিও তাই। করোনার প্রকোপে অন্য সৃষ্টি মেতেছে জীবনের জয়গানে। লাল নীল কাঁকড়ারা নৃত্যে মেতেছে কক্সবাজার ও পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বালুচরে। আর এখন প্রকৃতি সৃষ্ট করোনা ভাইরাস! কাবু করে ফেলেছে সমগ্র পৃথিবী। সে আমেরিকা, চীন, জাপান, ব্রিটেনের কোন মারণাস্ত্র কিংবা পারমাণবিক অস্ত্রকে ভয় পায় না। এসব দেশে আক্রান্ত আর মৃত্যের হার সবচেয়ে বেশি। এর ঠিক এখনও বলা যাচ্ছে না মৃতের সংখ্যা কোথায় গিয়ে থামবে। না, এখনো সঠিকভাবে, কোনো দেশ এত চেষ্টা আর গবেষণার পরও করোনাভাইরাস দমনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ঔষধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি। মানুষের জন্য, যারা স্রস্টার বুদ্ধি বিবেচনা ও মেনে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী বলে স্বীকৃত, এ এক অত্যন্ত লজ্ঝার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে চেষ্টার ক্রুটি নেই। আশা করা যাচ্ছে, একদিন না একদিন করোনাকে নির্মূল করার ব্যবস্থা আমরা করতে পারবো। কিন্ত্র এখানে প্রশ্ন একটাই- কবে? ভিক্টর হুগো বলেছিলেন, রাত যত ভয়াল আর অন্ধকারময় হোক না কেন, সকালে সূর্যের দেখা মিলবেই। আমিও আশাবাদী মানুষ। এ সঙ্কট এক দিন চলে যাবে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ সঙ্কটের সময়ে আমরা কী আচরণ করেছি ও কী শিক্ষা নিয়েছি, সেটাই বড় হয়ে থাকবে।
লেখক: প্রকাশক ও গবেষক