করোনাকালেও থেমে নেই খুনোখুনি

60

বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও খুনোখুনির মত অপরাধ সংঘটিত করা থেকে মানুষ নিজেদের বিরত রাখতে পারছে না। ঘটছে চুরি-ছিনতাইয়ের মত নিত্যনৈমিত্তিক অপরাধও। ব্যক্তিগত শত্রূতা, পারিবারিক কলহ আর সামাজিক অস্থিরতার জেরেই অধিকাংশ হত্যাকান্ডের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও খুনের শিকার হয়েছে কেউ কেউ। কোথাওবা স্বজনই হয়ে উঠেছে হন্তারক। ঘটনার পর অবশ্য পুলিশ বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার এবং খুনের রহস্যও উম্মোচন করেছে।
সর্বশেষ গত ১৫ জুন থেকে ১০ জুলাইয়ের মধ্যেই কেবলমাত্র নগরীর ডবলমুরিং থানা এলাকাতেই একের পর এক তিনটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দুটি হত্যাকান্ডের কারণ ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সক্ষম হলেও সুপারিওয়ালাপাড়া থেকে ইকরা নামে এক শিশুকন্যার ওড়না পেঁচানো লাশ উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে পুলিশ এখনও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না। ইকরার মৃত্যু নিয়ে নানা অভিযোগ উঠলেও পুলিশ রহস্য উন্মোচনে তার লাশের ময়না তদন্ত (পিএম) রিপোর্টের অপেক্ষায় রয়েছে। পিএম রিপোর্টে ইকরার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলে সেটাকে ভিত্তি ধরেই পুলিশের পরবর্তী আইনগত তৎপরতা পরিচালিত হবে।
হত্যাকান্ডগুলোর তদন্তে নিয়োজিত পুলিশ একাধিক কর্মকর্তা অঅরাপকালে জানিয়েছেন, অধিকাংশ খুনের ঘটনার তদন্তে নেমে ব্যক্তিগত শত্রূতা ও জায়গা-জমি নিয়ে পারিবারিক বিরোধ আর সামাজিক অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হওয়ার তথ্য-প্রমাণ উঠে আসছে। পাড়া-মহল্লায় পরস্পরের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনার জের ধরেও হত্যাকান্ডের মত ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়েছে কেউ কেউ। পরিবারে বড়দের মধ্যে কলহের জেরে আপন ভাইয়ের তিন বছর বয়সী শিশু সন্তানকে পর্যন্ত হত্যা করতে বুক কাঁপেনি চাচার। কখনওবা নির্জন পাহাড়ে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে মধ্যবয়সী নারীকে হত্যা করে ফেলে রেখে যায় খুনিরা। করোনাকালের মধ্যেও এমন খুনোখুনির ঘটনা নৈতিকতার অবক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতারই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন সমাজ ও অপরাধ-বিশ্লেষকরা।
পুলিশ জানায়, গত ১৫ জুন নগরীর ডবলমুরিংয়ের হাজীপাড়া এলাকায় নিজ বাসার পাশে পূর্বপরিচিত কয়েকজনের এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতের শিকার হন অভি মীর (২৯) নামের স্থানীয় এক যুবক। গুরুতর আহতবস্থায় চমেক হাসপাতালে টানা ১০ দিন তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়। হাসপাতাল থেকে ফিরে গত ২৫ জুন নিজ বাড়িতেই বমি করতে করতেই অভি মীরের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে হাসপাতাল থেকে ফিরে অভি নিজে বাদী হয়ে ডবলমুরিং থানায় একটি মামলা করেন। মামলার এজহারে মো. বাবু (২৫), মো. তুহিন (২২) ও মো. টিটু (৩০) নামের আপন তিন ভাইকে তাকে ছুরিকাঘাতের জন্য দায়ী করেন। গত ২ জুলাই পুলিশ নগর ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত তিনজনসহ ইব্রাহিম মুন্না (২৬) নামের তাদের আরেক ভাইকেও গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করলেও কী কারণে অভিকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। এজন্য আসামিদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা বলছে পুলিশ। এরপর গত ৭ জুলাই সন্ধ্যার দিকে ডবলমুরিং থানাধীন হাজীপাড়ার জলিল ম্যানসনে পরিবারের বড়দের মধ্যে বিরোধকে কেন্দ্র করে ঝগড়ার এক পর্যায়ে আপন ভাইয়ের তিন বছর বয়সী শিশুকন্যা মেহরাবকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্যা করেন চাচা জসিম উদ্দিন (৩২) ওরফে রাজু। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মেহরাবের জবাই করা লাশ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়না তদন্তের জন্য পাঠায়। তারপর পুলিশ হন্যে হয়ে রাজুকে খুঁজতে থাকে। ওই রাতেই ডবলমুরিং থানাধীন পাহাড়তলী ঝর্ণাপাড়া এলাকায় রাজুর অবস্থান সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত হয়ে তাকে গ্রেপ্তারের জন্য সেখানে অভিযান চালায়। পুলিশের দাবি, তাদের উপস্থিতি টের পয়ে রাজু ও তার সহযোগীরা পুলিশের উপর উপর্যুপরি গুলি ছোড়ে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। কয়েক মিনিটের গোলাগুলি থামার পর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে চিহ্নিত আসামি জসিম উদ্দিন রাজুর গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে। এসময় ঘটনাস্থল থেকে একটি এলজি, একটি কার্তুজ, একটি ছুরি এবং বেশকিছু ইয়াবা বড়িও জব্দ করার কথা জানায় পুলিশ। এর তিনদিন পর গত ১০ জুলাই ডবলমুরিং থানাধীন দেওয়ানহাট এলাকার সুপারিওয়ালাপাড়া থেকে পুলিশ খবর পেয়ে ইকরা নামের ১৩ বছর বয়সী এক শিশুকন্যার ওড়না পেঁচানো লাশ উদ্ধার করে। ময়না তদন্তের জন্য লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মর্গে পাঠানো হয়। ইকরার স্বজনদের অভিযোগ, তার সৎমা শিরিন আক্তারই ইকরাকে কৌশলে হত্যা করার পর আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে চাইছেন। ইকরার বাবার নাম উসমান ফারুক বিপলু। তার মায়ের সাথে বিচ্ছেদের পর উসমান ফারুক বিয়ে করেন শিরিন আক্তারকে। এরপর থেকে ইকরা সৎমা শিরিন আক্তার ও তার বাবার সাথেই বসবাস করে আসছিল। ইকরার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পুলিশ পিএম রিপোর্টের অপেক্ষায় রয়েছে। এর আগে গত ২৩ জুন নগরীর কোতোয়ালি থানার সিআরবি এলাকার রেলওয়ের পরিত্যক্ত বাংলো থেকে অজ্ঞাতনামা এক নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সুরতহালে হত্যাকান্ডের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযানে নামে টিম কোতোয়ালি। দুই দিনের ব্যবধানে ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর তাদের দেয়া তথ্যে ওই নারীর পরিচয়সহ হত্যাকান্ডের আদ্যোপান্ত বেরিয়ে আসে। ধর্ষণে বাধা দেয়ায় মালেকা বেগম (৪৫) নামে ভবঘুরে প্রকৃতির ওই নারীকে খুন করে দুই পাষন্ড। আর গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, মো. রুবেল ওরফে ভোলাইয়া, মো. সুমন এবং নিহত মালেকা বেগমের ব্যবহৃত মোবাইলের ক্রেতা মাইকেল বড়ুয়া। রুবেল ও সুমন মিলে মালেকাকে খুন করার পর তার মোবাইল ফোনটি মাইকেলের কাছে বিক্রি করেছিল। পুলিশ জানিয়েছে, খুন হওয়া ভবঘুরে নারী মালেকাকে ঘটনার দিন কৌশলে সিআরবি রেলওয়ের পরিত্যক্ত বাংলোতে নিয়ে যায় ভোলাইয়া ও সুমন। সেখানে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ওই নারীকে। এ সময় বাধা দিলে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। যাওয়ার সময় তারা ওই নারীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি নিয়ে যায়। মোবাইল বিক্রির টাকা দিয়ে ইয়াবা কিনে দুজনে সেবন করে। গত ২ মে নগরীর ইপিজেড থানার ফ্রি-পোর্ট এলাকা থেকে মাহাফুজুর রহমান (২৪) নামে এক হকারের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঝুলন্ত অবস্থায় লাশের মুখে টেপ মোড়ানো ছিল। পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে যে, মাহফুজুর আসলে হত্যাকাÐের শিকার হয়েছেন। হত্যার পর তার লাশ ঝুলিয়ে রেখে গেছে খুনিরা। তবে, এ ঘটনায় জড়িত কাউকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে নি।
করোনার প্রাদুর্ভাবের গোড়ার দিকে গত ২৭ এপ্রিল নগরীর ডবলমুরিং এলাকায় একটি দোকান নিয়ে একই পরিবারের দুই ভাইয়ের ঝগড়ার একপর্যায়ে একে অন্যের দিকে ইট ছুড়ে মারে। এতে আজগর আলী (৪৯) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। পুলিশ জানায়, ছোট ভাই আক্কাস আলী (৪৫) ওরফে বাচ্চুই তার বড় ভাইকে ইট ছুড়ে মেরেছিলেন। হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। গত ২৩ এপ্রিল নগরীর বাকলিয়ায় বলিরহাটে পারিবারিক কলহে অন্তঃস্বত্বা স্ত্রী জোবাইদা বেগমকে হত্যার অভিযোগে পুলিশ তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করে। গত ৫ এপ্রিল তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চান্দগাঁও এলাকায় কথা কাটাকাটির জের ধরে কামরুল নামে এক যুবক খুনের শিকার পানির কল মেরামত নিয়ে প্রতিবেশির সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হলে হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।