করোনাকালীন শিক্ষকদের দুর্দশা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা

62

বৈশ্বিক মহামারীতে বিপর্যস্ত বিশ্বের ২১৩টি দেশ এবং সাতশ কোটির অধিক জনগণ। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ করোনার অচলায়তনে পর্যুদস্ত। বিশেষ করে শিক্ষক সমাজ, যারা বেসরকারি কিংবা একেবারে নন এপিওধারী- তাদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। আর্থিক অনটন ও সামাজিক মর্যাদা দুইটির মাঝে দাড়িয়ে এ শিক্ষকসমাজ ছাল রাখি নাকি কূল রাখি-অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। সরকার ইতোমধ্যে নন এমপিও শিক্ষকদের অনুদানের জন্য তালিকা তৈর করলেও অনুদানে অর্থ সম্ভবত এখনও ছাড়া হয়নি। ছাড়া হলেও তার পরিমান পর্যাপ্ত অথবা মোটামুটি চলনসই হবে কিনা, তা নিয়েও সংশয়ে আছেন শিক্ষকরা। এরপরও সরকার মোটামুটি তাদের প্রতি কিছুটা হলেও সুদৃষ্টি দিয়েছেন তা প্রশংসাযোগ্য। তবে থোক বরাদ্দ দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আমাদের মনে হয় না, এরজন্য স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে। আর এ কাজটি সরকারকেই করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষকতা পৃথিবীর সবচেয়ে মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী পেশা। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই বাস্তব এবং গবেষণায় প্রমাণিত। ২০১৯ সালের শিক্ষক মঙ্গল সূচক অনুযায়ী ৭২ শতাংশ শিক্ষক মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করেন। ৭৮ শতাংশ শিক্ষকের মধ্যে কোনো না কোনো আচরণগত, মানসিক বা শারীরিক সমস্যা দেখা যায়। জাতি গঠনে এরূপ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষকদের প্রকৃত মর্যাদা কি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? যুক্তরাজ্যের এক সরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালে শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থের আরও অবনতি ঘটেছে, যা আমাদের শিক্ষকদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। শিক্ষক যদি ঠিক না থাকেন, তবে শিক্ষাব্যবস্থাও ঠিক থাকবে না। এ কারণে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের সা¤প্রতিক এক গবেষণায় শিক্ষকদের মানসিক অবস্থার উন্নতিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
আমরা আশা করি, এটি সরকারের নজরে এসছে, এখান থেকে যৌক্তিক বিষয়গুলো সরকার গ্রহণ করে করোনাকালীন শিক্ষকদের সমস্যার সমাধানে আরো কর্মসূচি গ্রহণ করবেন। আমরা জানি, বিগত এক দশকে, বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে শিক্ষকদের পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটতে শুরু করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদার উন্নতি ঘটেছে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সেই ধারাবাহিকতায় ছন্দপতন ঘটেছে বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে। ১৮ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে খুলবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই অনিশ্চয়তায় চার কোটি শিক্ষার্থীর পড়ালেখা একদিকে বন্ধ হয়ে গেছে, অন্যদিকে শিক্ষকদের জীবনে নেমে এসেছে ভয়াবহ অমানিশা। ফলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা পড়েছে হুমকির মুখে। সা¤প্রতিক বিভিন্ন প্রতিবেদন ও সামাজিক মাধ্যমের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী ছাড়া আর কোনো শিক্ষক-কর্মচারী ভালো নেই। কিন্ডারগার্টেন স্কুল, জাতীয়করণ না হওয়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা করোনাকালীন দুর্যোগে দুঃসহ জীবন অতিবাহিত করছেন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের বেতন-ভাতা দিয়ে চলে। করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন নিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। অধিকাংশ অভিভাবকেরই এখন বেতন দেয়ার সামর্থ্য নেই। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বিগত কয়েক মাস ধরে কোনো বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। এমনিতেই তারা স্বল্প বেতন পেতেন, সেই বেতন বন্ধ হওয়ায় এবং বাড়তি কাজ হিসেবে টিউশন ও কোচিং করিয়ে যে অর্থ আয় করতেন সেসব বন্ধ হওয়ায় তারা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হয়ে অনেকেই পেশা পরিবর্তন করছেন। অনেকে পেটের দায়ে কৃষিকাজ করছেন, ভ্যান চালাচ্ছেন, ইজিবাইক চালাচ্ছেন, ফল ও সবজি বিক্রি করছেন, ভেটেরিনারি ওষুধ বিক্রি করছেন, রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন। শহর ছেড়ে অনেকে চলে গেছেন গ্রামে। কী করে সংসার চালাবেন এই চিন্তায় দিন দিন মুষড়ে পড়ছেন বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা।
অর্থবিত্ত না থাকলেও শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা আছে। এ কারণে লজ্জায় তারা ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে বা মানুষের কাছে হাত পাততে পারছেন না। এ অবস্থায় আমরা মনে করি, শিক্ষকদের এ দুর্দশা লাঘব ছাড়া গুণগত শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না। তাই শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে সর্বাগ্রে এই শিক্ষকদের দুর্দশা লাঘব করতে হবে। সরকারের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার আগ পর্যন্ত জাতি গঠনের কারিগরদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।