করোনাকালীন মানবিকতা ও অমানবিকতা

48

মুহাম্মদ এনামুল হক মিঠু

বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারিতে সবকিছুতে পরিবর্তন এসেছে। জীবনযাত্রার অভ্যাস থেকে শুরু করে খাদ্যাভাসে এসেছে পরিবর্তন। করোনাভাইরাসের কারণে মানবজাতির সামনে যে সংকট উপস্থিত হয়েছে তা বস্তুতপক্ষে একটি শিক্ষা। মানবজাতির সামনে কোনো সংকট উপস্থিত হলে তা তারা কীভাবে মোকাবিলা করে তা নির্ণয় করার একটি পন্থা। এখন মানুষ করোনা থেকে বাঁচতে যা করছে তা এ সময়ের শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। আমরা যেমন মানবিক চিত্র দেখতে পাচ্ছি। পাশাপাশি অমানবিক চিত্রও দেখতে পাচ্ছি। মানবিক ছবিগুলো আমাদের উৎসাহ এবং ভরসা জোগালেও প্রতিদিন করোনার ফলে সৃষ্ট অমানবিক চিত্রগুলো আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। আমাদের মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিতে বাধ্য করছে। করোনা মোকাবিলায় সামনে থেকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তারাই আজ আশা ভরসা। করোনার শুরু থেকেই দেখা গেছে এটা এতটাই অমানুষ তৈরি করেছে যে বৃদ্ধ মা-বাবাকে করোনা সন্দেহে খোলা রাস্তায়, হাসপাতালের সামনে, দুর্গম চরে ফেলে দিয়ে যেতে দ্বিধাবোধ করেনি। সেই অসহায় মা-বাবার পাশে এসে দাঁড়াতে দেখেছি আরেক মা-বাবার সন্তানকে। পরম মমতায় তাদের আশ্রয় দিয়েছে। বিপরীতে আমরা দেখিনি কোনো মা-বাবা তাদের সন্তানকে করোনা সন্দেহে ফেলে দিয়ে গেছে। এটাই সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার পার্থক্য। আমরা দেখেছি চিকিৎসার অভাবে সাধারণ রোগী নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতেই তারা মারা গেছে। যখন কারো অক্সিজেন দরকার তখন তার অক্সিজেন মেলেনি। সিন্ডিকেটের চক্রে তা আটকে গেছে। এটাতো আমাদের কারোই কাম্য ছিল না। এই ঘটনাও ঘটছে।
অক্সিজেন নিয়ে ব্যবসা করছে এক শ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে সেই হতভাগ্যকে শেষ বিদায় জানাতে তার পরিবারের সদস্যরা না এগিয়ে এলেও কিছু মানুষ স্ব-উদ্যোগেই এসব মানুষকে সাহায্য করতে হাজির হচ্ছে। তারা কোনো করোনার ভয় করছে না। কত কিছুই আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছে এই করোনাভাইরাস। আপন-পর, মানবতা-স্বার্থপরতা সবকিছুর নজিরই আমরা দেখছি। নিজেকে ঘরের চার দেয়ালে রেখে এই ভাইরাসের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা মানুষের। এই ভাইরাসের কারণে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। দীর্ঘ হচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা। করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে বিশ্বে মানবিক বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। মানুষ মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসছে। এক দেশ অন্য দেশকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে। মানুষ ভুলেছে শত্রæতা। আমরা যেমন পৃথিবী প্রত্যাশা করছিলাম। করোনার কারণে সৃষ্ট মহামারি আমাদের বস্তুতপক্ষে কী শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে? করোনা কী আমাদের আবার একত্রিত করতে সক্ষম হবে? কেমন হবে করোনাপরবর্তী বিশ্ব? মানবজাতির এই মহাদুঃসময়ে মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানুষকেই। অন্যান্য সব মহামারির মতোই করোনা মহামারিও এক সময় পৃথিবী থেকে চলে যাবে। পেছনে রেখে যাবে দুর্দিনের এই ক্ষত চিহ্ন।
বহু মানুষকে আমরা হারিয়ে ফেলব। যারা আরো অনেক বছরই বেঁচে থাকার কথা ছিল। ক্ষমতার দ্ব›েদ্ব বিভক্ত এই পৃথিবীর উচিত এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া। মাত্র কিছুদিন আগেই পৃথিবীর চিত্র ছিল অন্যরকম। করোনাপূর্ববতী পৃথিবী ছিল উত্তপ্ত। অস্ত্র ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। আশ্চর্যজনকভাবে এসব অস্ত্র এখন আর মানুষের কোনো কাজেই আসছে না। অস্ত্রের খেলা শেষ, মানবিকতার খেলা শুরু। আমরা বুঝতে পেরেছি অস্ত্র কেবল প্রাণ নিতেই পারে। এতদিন পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলো রেষারেষি নিয়েই ব্যস্ত ছিল। বিশ্ব বরাবরই মানবিক হতে চেয়েছিল। হতে চেয়েছিল মানুষের নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু তা হয়নি। পৃথিবী আজ মানুষের নিরাপদ আশ্রয় নয়। এই যে আজ করোনাভাইরাস মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছে সেখানেও মানুষের দায় আছে বলে মনে করা হয়। চীন পেরিয়ে বিশ্বের দুই শতাধিক দেশে আক্রমণ করেছে করোনাভাইরাস। সেসব দেশের মানুষের আজ একটাই আশা। যে কোনোভাবে পৃথিবীকে করোনামুক্ত করা। করোনার তান্ডব শুরুর পর এসব উত্তেজনা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, রেষারেষি সবকিছু থেমে গেছে। মানুষকে মিলিয়ে দেওয়ার কি অদৃশ্য শক্তি রয়েছে এ ভাইরাসের! আজ মানুষ একতাবদ্ধ। যা অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল মানুষের। পাল্টে গেছে বিশ্বের গতি প্রকৃতি। থেমে গেছে অর্থনীতির গতি, রাজনীতির আলোচনা-সমালোচনা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, খেলাধুলা সবকিছু। মানুষকে বাঁচতে হবে এবং বাঁচাতে হবে এই এখন মূলমন্ত্র। অথচ এটাই মানুষের চিরকালের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত ছিল। আজ যখন পৃথিবী লাশের ভারে ক্লান্ত তখন মানুষ ঠিক ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আধুনিক পৃথিবীর ক্ষমতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে করোনাভাইরাস চীনের বাইরে একের পর এক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ছড়িয়েছে গ্রামেগঞ্জে, হাটবাজারে। মানুষ আজ কোথাও নিরাপদ নয়। কেবল ঘরেই সে নিরাপদ। একদিন বাইরেও নিরাপদ হবে। নতুন আলো ফুটবে। সেই পৃথিবী হবে মানবিক। করোনাভাইরাস আমাদের খুব ভালোভাবেই বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার জন্য হিংসা নয়, প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ থাকা। আগের মহামারির মতো করোনার দুঃসময়ও একদিন চলে যাবে। কিন্তু সেই পৃথিবী আমরা কি আবার অমানবিক করে তুলব? এখানে কয়েকটি বিষয় জড়িত। করোনাপরবর্তী সময়ে পৃথিবী পুনর্গঠনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। যা কোনোভাবেই একা কোনো দেশ সামাল দিতে পারবে না। প্রয়োজন হবে অন্য দেশের সাহায্যের। এর প্রথম হলো অর্থনীতির পুনর্গঠন। করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের প্রাণের পরই মূল আঘাতটা আসবে অর্থনীতির ওপর। বন্ধ হয়ে রয়েছে সব কলকারখানা, দোকানপাট। স্থবির অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরানো বেশ চ্যালেঞ্জের কাজ। অন্য একটি সমস্যা হলো বেকারত্ব।
বস্তুতপক্ষেপৃথিবীতে যখনই কোনো সংকট উপস্থিত হয়েছে তা থেকে নিষ্কৃতির পথ খুঁজতে মরিয়া হয়ে সবাই মিলে প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এখন সারা বিশ্বই আছে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে। কয়েকটি দেশ তা আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও গেছে। এক সময় করোনাভাইরাসের পৃথিবীজুড়ে এই তাÐব ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে। অন্যান্য মহামারির ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। কিন্তু বিপদের সময় কার ভূমিকা কেমন ছিল তা জানা হয়ে যাবে। মানুষ চিনবে মানুষকে।
করোনার কারণে আজ আমরা মানবিকতা এবং অমানবিকতা পাশাপাশি প্রত্যক্ষ করছি। যদিও অমানবিকতা প্রত্যক্ষ করার কথা ছিল না। মানুষ মানবিক হবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। তারপরও আমরা তা প্রত্যক্ষ করছি ,যা আমাদের অবাক করে।

লেখক : প্রাবন্ধিক