করোনাকালীন অনলাইন ক্লাশ ও আমাদের শিক্ষক সমাজ

30

অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবু তৈয়ব

শিক্ষাদান তথা কোন বিষয় বা দক্ষতা গ্রহীতার কাছে কোন মতে পাঠাতে পারলেই শিক্ষাদানে প‚র্ণতা আসে না। বাজার থেকে আনা মাছ মাংস যেমন সরাসরি কাউকে খেতে দেয়া যায় না, রান্না করে নিতে হয়,তা আবার শুধু রান্না করলে হয় না, সুস্বাদু হতে হয়, সুষম হতে হয়। সে স্বাদ ও সুষমের মাত্রাটাও আবার বয়স বা চাহিদা অনুযায়ী হতে হয়। না হয় আগ্রহ জন্মে না, খেলেও বদ হজম হয়,পরিনমনে সহায়ক হয় না। শিক্ষাদান এর বিষয়টাকেও প্রক্রিয়াজাত করে নিতে হয়। তাও আবার শিক্ষার্থীদের মানসিক উপ্যোগিতা বিবেচনা করে। যে পাচক রন্ধন শিল্পে যত পটু বা শৈল্পিক হতে পারে সে পাচক এর রান্না করা খাবার এর তত বেশি কাটতি থাকে, চাহিদা থাকে। শিক্ষকদেরকেও পাচকের মত পাঠদানের বিষয়ের উপর শুধু কারিগর না, শিল্পী হয়েও উঠতে হয়, আবার সে শিল্প কর্মকে সময়োপযোগী করে নিতে হয়। তবেই তাঁরা প্রকৃত শিক্ষক হয়ে উঠতে পারেন।
ভাবনা বা কথাগুলো ইদানিং বেশি আলোচনায় চলে আসে,চলমান পরিস্থিতে অনলাইন ক্লাশ ও পরীক্ষাগুলো দেখে।
কোভিড-১৯ এর মহামারিতে যে বিপর্যয় চলছে তাতে শিক্ষা ব্যবস্থা যে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে তা থেকে উত্তরনের সহজ কোন পথ নেই। শিক্ষাবর্ষ দীর্ঘ করা,ডিসম্বরে পরীক্ষা না নিয়ে বার্ষিক পরীক্ষা মার্চ মাসে নেওয়া, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা, পরীক্ষা সংক্ষেপ করা,সময় বিবেচনায় প্রমোটেড ধরা ইত্যাদি। সেসবে এক ধরনের ফাঁকি থেকে যায়। সেসব ফাঁকি থেকে উত্তরণের কিছুটা হলেও পথ দেখাচ্ছে, স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণের নেওয়া অনলাইনের ক্লাশগুলো, অনলাইনের পরীক্ষাগুলো। শিক্ষকদের অনলাইন ভিত্তিক সে সব ক্লাশ-পরীক্ষা দেখে উপর্যুক্ত ভাবনাগুলো এসে যায়।
অনেক শিক্ষক এই বৈরী সময়ে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও শিক্ষার্থীদের নিকট অনলাইনের মাধ্যমে পাঠদান করে যাচ্ছেন। সেসব পাঠদানের বিষয়গুলো দেখি,দেখতে হয়। এই অনলাইনের ক্লাশগুলোই শিক্ষাব্যবস্থায় কিছুটা হলেও সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখছে।
তবে এ অনলাইন ক্লাশগুলোকে কতটুকু কার্যকর করা যাচ্ছে, কতভাগ শিক্ষার্থীকে সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে সে প্রশ্ন তো অনেকের মনে উঁকি দেয়। সে উকিঁ দেয়ার বিষয়টির ব্যপারে আলোচনা পর্যালোচনা চলতে পারে। তা অন্য বিষয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের মোট শিক্ষার্থীর ২১% শিক্ষার্থীকে এখন অনলাইন ক্লাশের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
এটা তো সত্যি যে শিক্ষার লক্ষ্য তো শিক্ষার্থীদেরকে শুধু তথ্য উপাত্ত দেওয়া বা শিখানো না। শিক্ষার প্রধান ও মৌলিক লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের ভিতরের সুপ্ত প্রতিভা ও দক্ষতাগুলোর শুধু বিকাশ ঘটানো না, সময়োপযোগিতার বিবেচনাতেই সেই দক্ষতার বিকাশ ঘটানো। অর্জিত দক্ষতাগুলোতে তা না থাকলে শিক্ষা অকার্যকর হয়, সফলতা আসে না। এই সময়ে লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করা শিখলে, সা¤প্রতিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য অফিসে, গণগ্রন্থাগারে ছুটতে থাকলে পিছিয়ে থাকতে হবে। এত কষ্ট না করে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও অনলাইনে সক্রিয় থাকতে পারলে হল। এখন করোনা ভাইরাসের এই মহাদুর্যোগে আমাদের শিক্ষাকার্যক্রম সেই কথা জানান দিচ্ছে। যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডিজিটেলাইজেশনে দক্ষ সে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই করোনার সময়েও তাদের শিক্ষা কার্যক্রম সহজে চালিয়ে নিতে পারছে। আর যে সকল প্রতিষ্ঠান ডিজিটেলাইজেশনের প্রতি তেমন মনোযোগী ছিল না সেসব প্রতিষ্ঠানগুলো শুরুতে একটু অসুবিধায় পড়লেও কিছু প্রতিষ্ঠান তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে,অন্যগুলো কাটিয়ে উঠার পথে। যার জন্য অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম বিস্তার দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে।যা কোন না কোন সময়েও আমাদেরকে অর্জন করতে হতো।
যার কোন বিকল্প এখনও নেই,ভবিষ্যতেও থাকবে না। নেই বা থাকবে না এই জন্য যে এখন জাতির শিক্ষিতজনের শতকরা হারের চেয়ে অনলাইন ব্যবহারকারিদের শতকরা হারই বেশি বিবেচিত হয় জাতির অগ্রগতির স‚চক বা প্যারামিটার হিসাবে। আমাদের এই বাংলাদেশে আপাতত মনে হতে পারে যে দেশে ডিজিটেলাইজেশনের কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে,দেশে আধুনিক ব্যবস্থাপনা চলছে। তবে তা আংশিক সত্য। আংশিক সত্য এই জন্য যে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে যখন গত শতাব্দির শেষের দিকে ডিজিটেলাইজেশনের থার্ড জেনেরেশন প্রয়োগ শেষ বা পরিপ‚র্ণ কার্যকর হয়েছিল তখন আমাদের দেশে ভাল করে শুরুও করতে পারেনি। পরে আরও আধুনিক ও গতিময় জেনেরেশন তথা ফোর্থজেনেরেশন শুরু করে দিলেও তখন আমরা থার্ডজেনেরেশনের বিস্তার ঘটাতে পারিনি। বর্তমান প্রথম বিশ্বে বা উন্নত দেশে সেই ফোর্থ জেনেরেশনের প‚র্ণফল ভোগ করে পঞ্চম জেনেরেশন অতিক্রম করতে যাচ্ছে। আর আমরা এখনও ডিজিটেলাইজেশনের থার্ড জেনেরেশন থেকে গেছি, তাই ডিজিটিলাইজেশন প্রক্রিয়া দ্রæত রপ্ত না করলে পিছিয়ে পড়ে অচল হয়ে থাকতে হবে। অন্যকথায় আমাদেরকে এগিয়ে থাকতে হলে করোনাকালীনে অনলাইন ব্যবস্থাপনাকে পুরো কাজে লাগাতে হবে। আমরা অন্য সময়ে যাই করি না কেন, খোশগল্প করা, কুড়েমি করা, পরনিন্দা করা, ঈর্ষা করা, অজুহাত খোঁজা আরও কত কিছু করতে পারি। কিন্তু বিপর্যয় কালে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়, জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে আমরা জেগে উঠতে পারি,অপরের পাশে দাঁড়াতে পারি, সাহসের সাথে এগিয়ে যেতে পারি। যা বিশ্ব নন্দিত ও প্রশংসিত। এসব তো প্লাবনের সময়, যুদ্ধের সময়, মহামারির সময়, আমরা হরহামেশা দেখায়ে আসছি।এখন শিক্ষা ঝুকিতেও অনেকে জেগে উঠেছেন। মিডিয়ার কথা আলাদা। আমাদের মিডিয়া স¤প্রচারের কৌশলের সময় একটা পথেই হাটে। সেটা হল সাময়িক উত্তেজনাকে মিডিয়ার স্বার্থে কাজে লাগানো। নেতিবাচক বিষয়গুলো এমন ডামাডোল বাজিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স¤প্রচার করে যেন দেশটা চোরবাটপারে ভরে গেছে। মানবতা, সদাচার বলতে কিছুই নেই। মিডিয়াতে দৃষ্টি পড়লে তাই মনে হয়। আমরা সাধারণ নাগরিকদের আস্বস্থ করার জন্য, ভেঙে না পড়ার জন্য,উঠতি প্রজন্মদের মুল্যবোধে ধ্বস না নামার জন্য এটাই জানান দেয় না যে, সাবরিনা,সাহেদ,প্রদীপের সংখ্যা অতি নগন্য। তাদের চেয়ে লক্ষগুণ বেশি আছে ভাল মানুষ, ত্যাগী মানুষ। তাদেঁর প্রতিনিধিকে সামনে আনা উচিৎ, তাদের উপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও ধারাবাহিক পর্ব স¤প্রচার করা উচিৎ। কিন্তু তা তো তারা করে না। তাদের এডিটরিয়াল বিভাগে হয়ত সমাজ বিজ্ঞানী,মনোবিজ্ঞানীদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। ফলে এভাবে যুদ্ধের ডামাডোল বাজিয়ে নেতিবাচক নিউজগুলোকে ফলো-আপ করায় প্রজন্মদের মনন গঠনে যে সুদূর কুপ্রভাব পড়ে তা তলিয়ে দেখা হয় না।
যাক যেটি বলেছিলাম,আমরা দুর্যোগের সময় জেগে উঠতে পারি,হাত বাড়িয়ে দিতে পারি তা করোনাকালীন শিক্ষা ব্যবস্থাতেও সম্মানিত শিক্ষকরা দেখায়ে যাচ্ছেন। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যদিয়ে অনলাইনের ক্লাশে ও পরীক্ষায় তাদের দক্ষতা প্রকাশ করে যাচ্ছেন। যাঁরা আগে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হননি বা হতে পারেননি তারাও এখন রপ্ত করে নিচ্ছেন। সময়কে ধারণ করতে পারার জন্য,এগিয়ে থাকতে ও এগিয়ে রাখতে পারার জন্য।
তবে শিক্ষাদান তো শুধু বইয়ের তথ্য-উপাত্ত জানান দেয়া নয়।তার সাথে আরও কিছু লাগে। মাটিতে বিচি বুনতে গেলে বীজকে যেমন গুণগত মানের করে নিতে হয়,মাটিকেও তেমনি উপযোগী করে তৈরি করে নিতে হয়। তবেই ফলন নিশ্চিত হয়, ভাল হয়। তা তো একজন ভাল কৃষক বুঝতে পারেন। তেমনি একজন প্রকৃত শিক্ষক জানেন বা বুঝতে পারেন শুধু গোলাকার বৃত্ত আঁকলে রসগোল্লা হয় না, বড় গরুর পাশে ছোট গরু আঁকলে গরুর বাছুর আঁকা হয়ে যায় না। তা করতে হলে তো শুধু কারিগর হলে চলে না, শিল্পীও হতে হয়। শুধু কারিগর হলে চলে না। তাঁর সাথে আরও কিছু থাকে বা দিতে হয়। তা তো বুঝতে হলে শিক্ষককে জাতির শুধু কারিগর নয় শিল্পীও হয়ে উঠতে হয়। তবেই বৃত্ত হয়ে উঠে রসগোল্লা, ছোট গরু হয়ে উঠে বাছুর। একজন প্রকৃত শিক্ষকের কাছেও পাঠদানের বিষয়টা অনেকটাই তাই। তাঁরা বুঝেন পাঠদানের বিষয় বা তথ্য-উপাত্ত শিক্ষার্থীর নিকট পৌঁছানো মানে প্রকৃত শিক্ষাদান না। সে অনলাইনের পাঠদানের উপস্থাপনার কৌশলে এমন কিছু দিতে হয় যাতে তা একটা হৃদয়গ্রাহী শিল্পকর্ম হয়ে উঠে। শিক্ষার্থী যাতে বার বার শুনে ও দেখে তৃপ্তি মিটাতে না পারে। অতৃপ্ত থেকে যায়। আরও জানার বা দেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। পাঠ্য বইয়ের শক্ত বিষয়গুলো শিক্ষকের দরদিমননের উপস্থাপনায় তুলতুলে নরম খেজুরে পরিণত হয়। স¤প্রতি শিক্ষকদের অনলাইনের ক্লাশগুলো দেখার সুযোগ হয়েছে। দেখে তাই মনে হল। এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা কত ভাগ্যবান, বাটনে হাত লাগালেই শিক্ষকের প্রাণবন্ত উপস্থাপনার কন্ঠ শুনতে পায়,নানা আকর্ষণীয় শিক্ষাউপকরণে সে পাঠ সহজবোধ্য হয়ে উঠে। আর আমাদের সময় স্যারদেরকে এক এক সময় এক এক মানসিকতায় পেতাম বলে ক্লাশের মানও ভিন্ন ভিন্ন হত, যেদিন ভাল মুডে পেতাম সেদিন হয়ত ভাল ক্লাশ হত। শ্রেণিউপকরণ তেমন থাকত না।অনেক শিক্ষার্থীর মাঝে পুনরায় জানার সুযোগ হত না। প্রশ্নও তেমন করা যেত না। এখন তো অনলাইনের ক্লাশগুলো তারা ইচ্ছা মত যখন তখন দেখতে পারে শুনতে পারে।দরকার হলে না বুঝলে বারবার শুনতে পারে। অন্যদিকে অনলাইন ক্লাশে সম্পৃক্ত হতে হচ্ছে বলে অনলাইন ক্লাশের মাধ্যমে ডিজিটেলাইজেশনে হাতেখড়ি হয়ে যাচ্ছে প্রজন্মদের । স্যারগণও এই ভেবে তৃপ্তি পান যে ভালমানের ক্লাশগুলো তৈরি করা গেল বলে আর চিন্তা করতে হবে না। মানসিকতা,মুড, বয়স যাই হউক না কেন কষ্ট করে বানানো সেইসব ক্লাশের সøাইড শো দিয়ে বারবার ক্লাশগুলো ভাল করে নেওয়া যাবে।
এদুর্বিষহ মহামারির কালে ও নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সম্মানিত শিক্ষকগণ শিক্ষাকে ভালবাসেন বলে, জাতি গঠনের কারিগর হওয়ার চেয়ে শিল্পী হয়ে উঠায় অনলাইনের মাধ্যমে আন্তরিকতার সাথে ক্লাশ ও পরীক্ষা নিয়ে যাচ্ছেন। তাই জাতি তাদের কাছে আরও বেশি ঋণি হয়ে চলল। সেই ঋণ স্বীকার করার জন্য এইসব দরদি শিক্ষকদের “স্যালুট’ জানাই। আর তাদের এই সৃষ্টি কর্মকে অব্যাহত রাখার জন্য যারা সরকারি বেতন না পেয়ে অমানবিক জীবনযাপন করে যাচ্ছেন তাদেরকে পর্যাপ্ত প্রনোদনা ভাতা দেয়ার জন্য শিক্ষক দরদি এই সরকারের নিকট আবেদন থাকাটা অযৌক্তিক নয়,তাও শিক্ষার স্বার্থে, জাতিকে এগিয়ে নেবার স্বার্থে।

লেখক : কলেজ অধ্যক্ষ, প্রাবন্ধিক