করোটির নিচে অন্ধকার

66

ক’দিনের অবিরাম প্রবল বর্ষণে জলে মাঠ উপছে পড়ছে। ঝিমিয়ে পড়া প্রকৃতি সুন্দর নরম ভোরের সোনালি রোদে হেসে ওঠেছে। মাঠ থেকে জল নেমে যাচ্ছে কলকলÑছলছল শব্দ তোলে নাচতে নাচতে। আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। পাখিরা ডাকছে। বালকÑবালিকারা আনন্দে কোলাহল করে খেলছে। বেঙের দল ঝাঁক বেঁধে ডোবা-নালায় জলকেলি করছে মহোৎসবে।
এমনি এক সুন্দর প্রভাতে বারেক মিয়া কোদাল কাঁধে নিয়ে বেরুলো। মাঠে যাবে। ক্ষেতে জমে থাকা জল আল কেটে ছেড়ে দিতে হবে। গোয়াল থেকে গরুটা ডাকছে সেই ভোর বেলা থেকেই। বারেক মিয়া তাকেও সঙ্গে নিলো। হালার বিষ্টি পঁচাইয়া ফেলাইছে, গরুটারই বা দোষ কি? বিড়বিড় করতে করতে বাড়ির আঙ্গিনা থেকে বের হয়ে গেলো সে।
তাহমিনা ক’দিন ধরেই ভিজে ধান খোলায় ভেজে শুকিয়েছে। সেই ধান থেকে চাল বের করেছে। তারপর ভাত বেধেছে। আজ ক’দিন থেকেই চলছে এমনটি। ঘরে চাল নেই। কারো কাছে চেয়েও পাওয়া গেলো না। ‘কি কইর‌্যা পাওয়া যাইবো? হগলেরই তো এক দশা।’ ঘরে শুকনো ধানও নেই বারেক মিয়ার। বর্গায় বিঘে তিনেক জমি চাষ করেছে। বারেক মিয়ার চোখে আচানক ফসল দিছে মালিকে। এবার আর না খাইয়্যা থাকতে হইব না। গত সন তো খরায় সব শেষ কইর‌্যা দিছিল’। আজ তাহমিনা ভিজে ধান এক চিলতে উঠোনে ভাঙ্গা একটা চাটাইয়ে শুকোতে দিয়েছে। শুকোলে নিজেই ভানবে। তারপর রাঁধবে। ‘ঘরের মরদ তো আইয়্যাই খাওনের লাইগ্যা পাগল হইয়া যাইবো’। অল্প কয়েকটা ধান বার বার উল্টে পাল্টে দিচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্ছাওয়ালা মুরগীটা বার বার করেই ঘুরে ঘুরে আসে ধান খেতে। ‘এইটার জ্বালা আর সহ্য হয় না। অসহ্য! তাহমিনা তার ডাগর দেহটায় ঢেউ তোলে হাত উচিয়ে মুরগী তাড়ায়। কিন্তু রাঁধবে কি? ভাবে মনে মনে। ঘরের দেউড়ীর গাছটায় কয়েকটা ঝিঙ্গে ঝুলে আছে। তরতাজা কয়েকটা ঝিঙ্গে তোলে আনে। ‘আহা, দুই চাইরডা মাছ যুদি’- আপন মনেই বলে তাহমিনা।
বারেক মিয়া মাঠে গিয়ে দেখে ধান ক্ষেতে গলায় গলায় জল। ধান পেঁকে এসেছে। সোনালি ধানে ভরা সারা মাঠ। পরম তৃপ্তিতে তার মনটা ভরে ওঠে। আর পাঁচ সাতদিন পরেই ধান কাটা যাবে। তাহমিনাকে এবার একটি ভাল শাড়ী কাপড় কিইন্যা দিতে হইবো। বেচারীর মাত্র একটা কাপড়। এমন সতেজ আর পুষ্ট দেহটা এই কাপড়ের ফাঁকে ফাঁকে বাইরইয়া আইতো চায়। আহা, এমন বউডারেও কিনা সে ঠিক মতন ভাত-কাপড় দিতে পারছে না, একটা দুঃখবোধ বারেক মিয়াকে পীড়িত করে।
মাঠ থেকে বাড়ি ফেরার পথে বারেক মিয়া খাল পাড়ে এসে দেখে, খালে টানা জালে মতি, গজেন, খুরশেদ, ইনছান এরা মাছ ধরছে। সে দাঁড়িয়ে দেখলো, প্রতি টানেই মাছ উঠছে। ‘একটা জাল পাই কই? কয়দিন ধইরা জাউ আর মরিচ পোড়া খাইয়্যা শরীলড়া কাহিল হইয়া গ্যাছে। হগলই তো মাছ ধরতাছে দেখা যায়।’ বারেক মিয়ার জাল নেই। সে এগিয়ে গিয়ে খুরশেদের পাশে বসে। একটা বিড়ি ধরায়। খুরশেদকেও দেয়। খুরশেদ বারেক মিয়ার পরাণের দোস্ত। গোবরে কাঁদায় গরুটার শরীর একাকার। এই বাদলের দিনে গোয়ালে কাদাজলের মধ্যে তাকে থাকতে হয়েছে। বারেক মিয়া ভাবে, ‘গরুডার শরীলডা ধুইয়া দেই’। সে বহমান খালের জলে গরুটাকে নামিয়ে গা ধুয়ায়। দেখে শুনে খটুট দেয়।
যাইরে খুশীদ। রাইণ কইরা আইস।
খাড়া, কয়ডা মাছ লইয়া যা।
না, লাগবো না।
হোন, লইয়া যা। এতোদিন পড়ে রইদ উঠছে। মাছ দেখলে ভাবি আইজ তোরে একটু বেশী কইর‌্যা আদর যতœ করবো। নে, ধর।
ঝলমলে কয়টা মাছ গামছায় বেঁধে দেয় খুরশেদ। বারেক মিয়া আসলে মনে মনে খুশীই হয় মাছগুলো পেয়ে।
সূর্য মাথার উপরে উঠে গেছে। মাটি থেকে একটা গন্ধ ছড়াচ্ছে। মাতাল করা গন্ধ। তাহমিনা এরমধ্যে ধান ভেনে ছোট্ট হাঁড়িতে ভাত চড়িয়েছে। ঝিঙ্গে কুটে রেখেছে। তাহমিনা ভাবছে, ‘হেই সকালে মানুষটা ঘর থাইক্যা বাইর হইয়া গেলো এখনো ফিরে না ক্যান? আইয়াই তো দাপাদাপি চিল্লাচিল্লি শুরু কইর‌্যা দিবো। ক্ষিধা সহ্য হয়না মানুষটার।’ নিভে যাওয়া চুলায় ভারি নিুম্ব একটু উপরে উঠিয়ে মাথাটা একটু নুইয়ে গাল ফুলিয়ে ফু দেয় সে। দু’চোখে ধোঁয়া লাগে। গাল বেয়ে জল ঝরে।
মিনা, কই তুই? এই দিকে আয়। উঠোনে এসে বারেক মিয়া চেঁচিয়ে ডাকে। তাহমিনা হাতের তালুতে দু’চোখ রগড়াতে রগড়াতে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আসে। খোলা অবিন্যস্ত মাথার চুল। শরীর থেকে শাড়ীটা খসে পড়েছে। বারেক মিয়া লোভীর মতো চেয়ে দেখে তাহমিনাকে।
কি হইলো? চিল্লাও ক্যান?Ñ বারেক মিয়া মাছ বাঁধা গামছাটা এগিয়ে দেয় তাহমিনাকে। মাছ পেয়ে খুশী হয় সে।
সন্ধে বেলায় খুরশেদ আসে। তাদের জ্ঞানের পরিধির মধ্যে থেকে সমাজÑ সংসারের আলাপ করে। তামাক খায়। তাহমিনা পান বানিয়ে দেয়। অজস্র তারার ফুল ফুটেছে আকাশে। মধ্যাকাশে শুক্ল পক্ষের চাঁদ উঠেছে। ঝিরঝরে বাতাস বইছে। নরম বাতাসে নিমগাছের আগায় নরম পাতা কাঁপছে। দাওয়ায় বসে এসব দেখে আর দু’বন্ধু আলাপ করে মাঠ থেকে জল নেমে যাচ্ছে। এ সব বলতে গিয়ে আশায় বুক বাঁধে দু’বন্ধু।
রাতে ঘুমানোর আগে তাহমিনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সুখ স্বপ্ন দেখে বারেক। সে এক অনাবিল আনন্দ। একটু আগেই তাহমিনা বারেক মিয়ার লোমশ এবং প্রশস্ত বুকে মুখ লুকিয়ে বলেছে, আরেকজন নতুন মানুষ আইতাছে।Ñ শুনে হত বিহŸলের মতো বারেক মিয়া জিজ্ঞাস করে, কি কইলি?
Ñ তুমি তো ছাওয়ালের বাপ হইবা।
Ñ আবেগে আতিশয্যে বারেক মিয়া তাহমিনাকে টেনে বুকে তুলে নেয়। তাহমিনার উদোম দেহটা আলতো করে হাতিয়ে আদর করে দেয়। ওষ্ঠে, গÐে, পুষ্ট কাঁধে অজ¯্র চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকে। কলকলিয়ে হেসে ওঠে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার ভান করে তাহমিনা।
দু’বছর ওদের বিয়ে হয়েছে। এ পর্যন্ত কেউ আসেনি। মাÑবাবা গিয়েছে। ছোট ভাইটি পর্যন্ত থাকে নি। কেউই থাকেনি। কাল ব্যাধিতে খেয়েছে তাদের। এ দু’বছরের মধ্যে বারেক মিয়ার ঘরÑসংসার-মন সব বিপর্যন্ত হয়েছে। তখন যদি তাহমিনা পাশে না থাকতো তবে তার বেঁচে থাকাটাই বিরম্বনাময় হয়ে উঠতো। অবশ্য নিন্দুকেরা বলে, একটা রাক্ষুসী বউ ঘরে আনছে বারেক। বউডা ঘরে আইয়াই একে একে সবাইকে খাইয়া ফেলাইছে।
বারেক মিয়া এ সব বিশ্বাস করে না। আল্লাহর মাল আল্লায় লইয়া গ্যাছে, এটাই তার বিশ্বাস। তাহমিনার দোষ কি? এই দুঃসময়ে তাহমিনা বুঝিয়েÑ সুঝিয়ে, আদর- যতেœ ভুলিয়ে রেখেছে। আর আজ এই শুভ সংবাদের মুহূর্তে বারেকের এই সব মনে হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে আদরে সোহাগে ভরিয়ে দেয় তাহমিনাকে।
প্রচÐ গর্জনে ঘুম ভেঙ্গে যায় বারেক মিয়ার। অজস্র মানুষের আর্ত চিৎকার সেই গর্জনের মুখে তলিয়ে যায়। এরমধ্যে তাহমিনাও জেগে ওঠে বারেক মিয়াকে জড়িয়ে ধরেছে। উঠে বসে ওরা। বুঝতে চেষ্টা করে ব্যাপারটা কি? কিন্তু তার আগেই শব্দটা দ্রæত এগিয়ে আসে। আর কিছুই ভাবতে পারে না তারা।
নদীর বাঁধ ভেঙে জলের তোড়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জলের প্রচন্ড ধারায় বারেক মিয়ার পর্ণকুটির ভেঙ্গে পড়েছে। ভেসে যাচ্ছে বারেক মিয়া আর তাহমিনা। সঙ্গে যাচ্ছে তাদের সন্তান, আশাÑ আকাঙ্খা, স্বাদÑআহ্লাদ আর একটু আগে জেগে থেকে দেখা সুখ স্বপ্নটা। অথৈ জলে বারেক মিয়া খটুজছে তাহমিনাকে। তাহমিনা খটুজছে বারেক মিয়াকে। কিন্তু কেউ কাউকে পাচ্ছে না। শুধু প্রবল ¯্রােতেÑউল্টে-পাল্টে যাচ্ছে দু’জন। তখন রাত নিশীথ।