কমছে দিনের পরিধি ও রাতের তাপমাত্রা

55

দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এবার অনেকটা দেরিতে বিদায় নিলেও ঋতুর পালাবদলের নিয়মে হেমন্তের শুরুতেই কমতে শুরু করেছে দিনের পরিধি ও রাতের তাপমাত্রা। ভোরবেলা দেশের নদী অববাহিকায় হালকা কুয়াশার চাদর কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদে ঘাসের ডগায় মুক্তোদানার মত জমতে শুরু করেছে শিশিরকণা। বর্ষপঞ্জি আর ক্যালেন্ডারের হিসাব মেনে শীত আসার এখনও ঢের বাকি থাকলেও প্রকৃতিতে বিরাজমান পরিস্থিতি জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আশ্বিনের একেবারে শেষদিনে গত ১৬ অক্টোবর দেশ থেকে বর্ষা আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিয়েছে। তার আগে থেকেই দিনের পরিধি ছোট হতে শুরু করলেও দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বিদায় ঘণ্টা বাজার পর থেকে রাতের তাপমাত্রাও কমছে। আগামী কয়েকদিনে তা আরও কমতে পারে। কার্তিকের শুরুতে বঙ্গোপসাগরে যে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে, তার বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এতে খুলনা বিভাগের দুয়েক জায়গায় হালকা বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টির খানিকটা আলামত দেখা গেলেও চট্টগ্রামসহ দেশের বাকি অঞ্চলগুলোতে অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানতঃ শুষ্ক থাকতে পারে।
অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ মো. আরিফ হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, মৌসুমি বায়ু বিদায় নিয়ে প্রকৃতিতে এখন ঋতুর পালাবদলের সন্ধিক্ষণ চলছে। আমাদের দেশে আবহাওয়া ও জলবায়ুগত যে বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান রয়েছে, তার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অক্টোবর-নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় হয়। তার মানে আবার এটা নয় যে, ঘূর্ণিঝড় হবেই। তবে প্রকৃতিতে যে তথ্য-উপাত্তগুলো বিদ্যমান তাতে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার দিকেই বেশি নির্দেশ করছে। মৌসুমি বায়ুর বিদায়ের পর বঙ্গোপসাগরে অন্তত দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যার অন্তত একটি রূপ নিতে পারে ঘূর্ণিঝড়ে। শেষপর্যন্ত নিম্নচাপ শক্তিশালী রূপ নিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হলে তার নামকরণ হতে পারে ‘কিয়ার’। আর ওই ঘূর্ণিঝড়ের কাঁধে সওয়ার হয়েই শীতের আগমন ঘটতে পারে।
প্রকৃতিপ্রেমী বা আবহাওয়াদিরা মনে করেন, ষড়ঋতুর দেশে হেমন্ত মানেই প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা। পালাবদলের এ দোলায় কেবল জীবজগতই নয়, গা ভাসায় বৃক্ষরাজীও। বদলে যায় মানুষের জীবনধারা। ঝরে পড়ে গাছের পত্রপল্লব। শহর কিংবা গ্রামে ধুনকদের ব্যস্ততা বাড়ে। লেপ-তোষক তৈরি বা মেরামত কিংবা শীত মোকাবেলার উপযুক্ত সময় হেমন্ত। প্রকৃতিতে তাই এখন ধানের ডগায় কিংবা দুর্বাঘাসের মাথায় জমছে শিশির বিন্দু। নদী অববাহিকায় নামছে হালকা কুয়াশার চাদর। কাল বা ঋতুচক্রের হিসাবে পৌষ-মাঘ দুই মাস শীতকাল হলেও দেশে শীত শুরু হয় কার্তিকের মাঝামাঝি থেকে। শরতের বিদায়, হেমন্তের আবির্ভাব। দিনের দৈর্ঘ্য হ্রাস। রাতের তাপমাত্রা কমতে থাকা। এ তো শীতেরই আগমনী বার্তা।
অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘণ্টায় দেশের কোথাও বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়নি। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩২ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করেছে দেশের সর্বত্র। এরমধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগেই তাপমাত্রার উর্ধ্বমুখী প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে সাগরকন্যা কক্সবাজারে। বিভাগের সবকটি অঞ্চলেই সর্বোচ্চ তাপমাত্রার গড় ছিল ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের সর্বনিমম্ন ২০ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী তেঁতুলিয়ায়। চট্টগ্রামের কোথাও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘর অতিক্রম করেনি।
আবহাওয়াবিদদের মতে, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নিজের বৈশিষ্ট্য ও আচরণে বর্ষপঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারে ছাপানো মাসভিত্তিক ঋতু বা কালের হিসাব মেনে চলাকে শিকেয় তুলে রেখেছে সেই কবে। মৌসুমের হিসাবেও সময়ের চেয়ে অসময়ের চর্চাই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই বলে দু’মাস বয়সী আস্ত একটা ঋতুই হাওয়া হয়ে যাওয়া নিশ্চয় বড় ধরনের ব্যতিক্রম। ‘তালপাকা’ ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিনের বিদায়ের দিনেই পরিপূর্ণভাবে বিদায় নিয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু অর্থাৎ বর্ষা। তার প্রভাবে শরতের নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলার বদলে কৃষ্ণমেঘ আর হঠাৎ গগণবিদারী বজ্রপাতকে সঙ্গী করে নেমে এসেছে বৃষ্টিধারা। আস্ত শরতই হাওয়া হয়ে গেল রেকর্ড ভাঙা বিলম্বিত বর্ষার পেটে। কিছুটা দেরিতে চেনারূপে ধরা দেয়া বর্ষা মৌসুম পূর্ববর্তী সমস্ত রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে দেরিতে বিদায় নিতে যাচ্ছে। গত ৫৮ বছরে এত দেরিতে মৌসুমি বায়ুর প্রস্থান ঘটেনি। তবে মৌসুমি বায়ুর দেরিতে প্রস্থান এটাই প্রথমবার নয়। গত আট বছরে অন্তত চারবার নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে প্রস্থান ঘটেছে মৌসুমি বায়ুর। যার ফলে মৌসুমি বায়ুর স্বাভাবিক গতিবিধি নিয়েও ভাবনার অবকাশ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। আগে মে মাসের শেষের দিকে বঙ্গোপসাগর থেকে টেকনাফ উপকূল দিয়ে দেশে প্রবেশ করত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু। তাতেই যাত্রা শুরু করত দেশের সবচেয়ে বড় বর্ষা ঋতু। বাদল ধারার এই ঋতুর বিদায় ঘটত সেপ্টেম্বরের শেষে এসে। এখন বর্ষা শুরু হতেই জুনের মাঝামাঝি সময় লেগে যাচ্ছে। মৌসুম শেষ হচ্ছে অক্টোবরে এসে। এবার জুনের প্রথম সপ্তাহেই মৌসুমি বায়ু টেকনাফ উপকূল দিয়ে দেশে প্রবেশ করলেও বর্ষার বিরামহীন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল একটু দেরিতে। ২০ জুন চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বর্ষা সক্রিয় হয়।