কবি শামসুর রাহমান উজ্জ্বল কথার মিছিলে ঐশ্বর্যময়

311

স্বদেশকে সযতেœ বুকে ধারণ করে উজ্জ্বল কথার রৌদ্র-ঝলসিত মিছিলে সামিল হয়েছেন একজন স্বাধীনতার কবি। কবি শামসুর রাহমান। যিনি বাঙালি চেতনা-ঐতিহ্যের সাথে আমৃত্যু নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। তিনি তাঁর কবিতায় নিজস্ব অনুভুতির চেতনায় শাণিত হয়ে স্বাধিকার, গণতন্ত্র, খেটে খাওয়া স্বপ্নবাজ মানুষের কথা নিঃশঙ্ক চিত্তে প্রকাশ করেছেন । কবিতার শব্দাবলিতে প্রকাশ পেয়েছে দ্রোহ, সংগ্রাম,ক্ষোভ, বেদনাবোধ, তীব্রতা, আর্তি ও বেদনার স্বপ্নগাথা। বহুমাত্রিক বোধের বোধিসত্তার উৎসারণে যুগযন্ত্রণা, পরাধীনতার গøানি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নাগরিক জীবনের দুর্ভোগ এবং মানবতার লাঞ্ছনার আর্তি শামসুর রাহমান উপমা, শব্দচয়ন, রূপক, উৎপ্রেক্ষা প্রভৃতি অলঙ্কারিক ব্যঞ্জনায় তাঁর কবিতায় সাবলীল ছন্দে ব্যক্ত করেছেন।
‘উনিশ’শ ঊনপঞ্চাশ রচনার মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে কবিতার ক্যানভাস চিত্রিত করেন সমকালীন পরিপ¦ার্শের মিথস্ক্রিয়ায় । সমকালকে ধারণ করে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। মুক্তিযুদ্ধ, নাগরিকবোধ ও প্রেম তাঁর কবিতার অনুষঙ্গ। শামসুর রাহমান কবিতার প্রতিটা ছত্রে প্রকাশ করেছেন স্বকীয় ধ্যান ধারণা – আমার কবিতা গণ-অভ্যূত্থানের চ‚ড়ায় নূহের/ দীপ্তিমান জলযান, আমার কবিতা বলিভিয়ার জঙ্গলে/চে গুয়েভারার বয়ে যাওয়া/রক্তের চিহ্ন গায়ে নিয়ে হেঁটে যায় মাথা উঁচিয়ে/যারা ডুগডুগি বাজিয়ে/যখন ইচ্ছে গণতন্ত্রকে বাঁদর নাচ নাচায়/তাদের পাকা ধানে মই দ্যায় আমার কবিতা, ফুঃ বলে/উড়িয়ে দ্যায় দুর্দশার মুষলপর্ব।/আমার কবিতা নাজিম হিকমতের মতো জেলের নীরন্ধ্র/কুঠরীতে বসে মুক্তির অক্ষরে লেখে আতœজীবনী।
শামসুর রাহমানের কবিতার প্রধান বিষয় ছিলো তাঁর সময় এবং সময়ের প্রবল প্রতিক‚লতা। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সমগ্র পাকিস্তান আমলে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন-সংগ্রাম ও রক্তদানের ব্যাপকতা যেমন তাঁর কবিতায় এসেছে, তেমনি প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশেরও নানা গøানির চিত্র। উনিশ’শ একাত্তরের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে কবি এক দুপুরে পুকুরপাড়ে বসে লিখেছিলেন -স্বাধীনতা তুমি ও তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা কবিতা দুটি। আরাধ্য স্বদেশ ভাবনায় শামসুর রাহমানের বিপ্লবী কলমে অনুভ‚তি জড়ানো হৃদয়ের প্রকাশ ঘটেছে কবিতার ছন্দে – স্বাধীনতা তুমি/রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান/ স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল-/ ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ/ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা, স্বাধীনতা তুমি/শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রæয়ারি উজ্জ্বল সভা/ স্বাধীনতা তুমি, পতাকা শোভিত / সেøাগান মুখর ঝাঁঝালো মিছিল। (স্বাধীনতা তুমি) তাঁর কবিতায় বারবার ওঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন শাহ, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সমর সেনদের নাম। পাশাপাশি দেখা যায় হোমার, বোদলেয়ার, লোরকা তাঁদের নামও তাঁর কবিতায় পাওয়া যায়। দাঁড়িয়ে আছেন এক দেবমূর্তি কবিতায় তিনি লিখেন-আমি বিহবলতা কাটিয়ে চেয়ার ছেড়ে/উঠে দাঁড়ালাম, আমার সত্তায় সশ্রদ্ধ মুদ্রা। রবীন্দ্রনাথ/আমার কাঁধে চাপ দিয়ে বসতে বললেন আমাকে।/লেখো তুমি, কবির ধ্যানে বিঘœ ঘটাতে চাইলে, /তিন অক্ষরের একটি শব্দের জন্য আবার সতৃষ্ণ হয়ে উঠি। কাজী নজরুলকে নিয়ে তাঁর উক্তি-“তোমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে, কী আশ্চর্য,/আমার মনে পড়লো ডেনমার্কের যুবরাজের উক্তি-/এই করোটির ভেতরে ছিলো জবান/এবং একদা সে গান গাইতে পারতো ।” মুক্তিযুদ্ধকালীন উত্তাল সময়ে দেশত্যাগ না করে স্বদেশের মায়ায় থেকে গেলেন দেশের মাটিতে। দেশের সাধারণ মানুষের জ্বালা-যন্ত্রণা, ক্ষোভ-ক্রোধ, বিদ্রোহ-ঘৃণা সবই ধারণ করেছেন নিজের সত্তায় । স্বদেশের মুক্তিকামী চেতনার আলোকে রচনা করলেন বেশ কিছু অমর কবিতা, সমকালীন সমস্ত বেদনাবোধ, বিক্ষোভ, উত্তাপ ও সন্তাপকে ধারণ করে নিজস্ব অনুভ‚তির চেতনায় শানিত হলো কবিতা।
বায়ান্নোর ভাষা সংগ্রামে উজ্জীবিত হয়ে নিজ বাসভ‚মে কাব্যগ্রন্থের বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালায় তিনি লিখেন-উনিশ শো বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পু®পাঞ্জলি/বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।/তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো, /বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে তিনি লিখেন-আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচ‚ড়া/থরে থরে রে শহরের পথে/কেমন নিবিড় হয়ে।/কখনো মিছিলে কখনো বা/একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়-ফুল নয়, ওরা/শহীদের কলুষিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।/একুশের কৃষ্ণচ‚ড়া আমাদের/চেতনারই রঙ। ত্রিশ লাখ শহীদের আতœত্যাগ মিশে আছে এ দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে। স্বাধীনতার জন্য এই যে বিসর্জন, তা বেশ কটি কবিতায় শামসুর রাহমান তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর রচিত এ ধরনের কবিতাগুলোর মধ্যে তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা কবিতাটি অগ্রগণ্য। কবির চোখে স্বাধীনতা আসবে বলে সাধারণ মানুষের ত্যাগ, বিসর্জন : তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা/তোমাকে পাওয়ার জন্যে/আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়? /আর কতবার দেখতে হবে খান্ডবদাহন ? /-নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/এই বাংলায়/তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা। (“তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা”।)
শামসুর রাহমান ও বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামে স্বতঃস্ফ‚র্ত ভাবে লিখেছেন একেকটি প্রেরণাদৃপ্ত কবিতা। কবি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলে ও তাঁর কলম থেমে থাকেনি। তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধের কবিতায় দীর্ঘ ন মাসের করুণ, বীভৎস, হৃদয়বিদারক বর্ণনা উঠে এসেছে । সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে কবি বন্দী শিবির থেকে কাব্যের ভ‚মিকায় লিখেছেন তখন ঢাকা এক কনসেনট্রেশন ক্যা¤প। সুদীর্ঘ ন মাস আমরা যে পরিবেশে বাস করেছি তাকে কাফকার জগত বললে কিছুই বলা হয় না। উৎপীড়ন, হত্যা এবং সন্ত্রাস আমাদের চারপাশে রচনা করেছিল এক ভয়ঙ্কর তমসাচ্ছন্ন ও বিভীষিকাময় পটভ‚মি। আমরা তৃষিত হয়ে পড়েছিলাম এক ঝলক আলোর জন্য। নীরন্ধ শ্বাসরোধকারী সেলের ভেতর বন্দী যেমন ব্যাকুল হয়ে থাকে এক ফোটা আলোর জন্য, ঠিক তেমনি। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ, শিশুরা নিশ্চুপ, ফৌজি জীপের গর্জন, ট্রাকের ঘর্ঘর, বুটের শব্দ, আগুন, আর্তনাদ আমরা এই নিয়েই ঢাকায় ছিলাম তখন। আমরা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতাম। সব সময় মনে হতো কেউ যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। ঘুমের ভেতর চিৎকার করে উঠতাম কোন কোন রাতে। বধ্যভ‚মির ধারে বেঁধে রাখা জীবজন্তুর অনুরূপ আমরা আতঙ্কে জেনেছি নিত্যসঙ্গী বলে। এমন আতঙ্কের মধ্যে থাকলেও অসংখ্য বাঙালির মতো স্বাধীনতার আশা ত্যাগ করেন নি। তাই তো তিনি স্বাধীনতাকে তাঁর কবিতায় নানা রঙে, রূপকে, উপমায় সাজিয়েছেন পরম নিপুণতায় । তাঁর কবিতায় সমাজ, স্বদেশ, গণ-আন্দোলন তাই স্থান পেয়েছে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁর অন্ধ সুন্দরী কাঁদে, বর্ণমালা দিয়ে গাঁথা,বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় ,গর্জে ওঠো স্বাধীনতা প্রভৃতি কবিতা আন্দোলনকে করেছে বেগবান। আবার সামরিক স্বৈরাচারকবলিত দেশের বাস্তবতা উঠে এসেছে উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ এবং স্বৈরাচারের পতন, নূর হোসেনের গুলিবিদ্ধ বুক হয়ে ওঠে তাঁর কাব্যের শিরোনাম-বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়। বুক তাঁর বাংলাদেশের হৃদয় কবিতায় তিনি লিখেছেন-সারারাত নূর হোসেনের চোখ এক ফোঁটা ঘুমও/শিশিরের মত/জমেনি, বরং তার শিরায় শিরায়/জ্বলছে আতশবাজি সারারাত, /কী এক ভীষণ নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়।
১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে। কবির নিমগ্ন অর্ন্তগতবোধে সৃজিত ষাটের দশকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ, আমি অনাহারী ইত্যাদি। প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, বন্দী শিবির থেকে, নিজ বাসভ‚মে, আমি অনাহারী, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে কবির কালিক বোধ ও প্রাণের ¯পন্দনে তিনি ¯পন্দিত করেছেন পাঠকদের-গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্য়াস্তে/ জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়। /বোন তার ভায়ের অ¤¬ান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে/নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো/হৃদয়ের সোনালি তন্তুর সূ²তায়/ বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন ¯েœহের বিন্যাসে।/ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত/মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট/শহরের প্রধান সড়কে/কারখানার চিমনি-চুড়োয়/গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে উড়ছে, উড়ছে অবিরাম/আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিতপ্রতিধ্বনিময় মাঠে, / চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।/আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/ সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক; /আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা। [ আসাদের শার্ট ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে তাঁর ধন্য সেই পুরুষ কবিতায় তিনি লিখেন-ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের উপর পতাকার মতো/দুলতে থাকে স্বাধীনতা, /ধন্য সেই পুরুষ যার নামের উপর ঝরে/ মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি। জাতির জনকের হত্যাকাÐের পর তাঁর কাব্যের শিরোনাম হয় শূন্যতায় তুমি শোকসভা। স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক উত্থানের পটভ‚মিতে কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা। শামসুর রাহমানের প্রায় সকল কবিতাই ছন্দে রচিত উজ্জ্বল কথার মিছিল। এ মিছিলের অগ্রভাগে শুদ্ধ ভাবনার কবি আমাদের পথের দিশা দেখাচ্ছেন তাঁর আলোয় । তাঁর নন্দনভাবনার ঐশ্বর্যময় অসীম আকাক্সক্ষার চিত্রকল্প আজো বাঙালির মুখে মুখে মুখরতা নিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে । মহীরুহপ্রতীম এ কবি বাংলা কবিতার অসীম আকাশে নান্দনিক নক্ষত্ররূপে আলো ছড়িয়ে আমাদের আলোকিত করবেন অনাদিকাল।স্বদেশকে সযতেœ বুকে ধারণ করে উজ্জ্বল কথার রৌদ্র-ঝলসিত মিছিলে সামিল হয়েছেন একজন স্বাধীনতার কবি। কবি শামসুর রাহমান। যিনি বাঙালি চেতনা-ঐতিহ্যের সাথে আমৃত্যু নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। তিনি তাঁর কবিতায় নিজস্ব অনুভুতির চেতনায় শাণিত হয়ে স্বাধিকার, গণতন্ত্র, খেটে খাওয়া স্বপ্নবাজ মানুষের কথা নিঃশঙ্ক চিত্তে প্রকাশ করেছেন । কবিতার শব্দাবলিতে প্রকাশ পেয়েছে দ্রোহ, সংগ্রাম,ক্ষোভ, বেদনাবোধ, তীব্রতা, আর্তি ও বেদনার স্বপ্নগাথা। বহুমাত্রিক বোধের বোধিসত্তার উৎসারণে যুগযন্ত্রণা, পরাধীনতার গøানি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নাগরিক জীবনের দুর্ভোগ এবং মানবতার লাঞ্ছনার আর্তি শামসুর রাহমান উপমা, শব্দচয়ন, রূপক, উৎপ্রেক্ষা প্রভৃতি অলঙ্কারিক ব্যঞ্জনায় তাঁর কবিতায় সাবলীল ছন্দে ব্যক্ত করেছেন।
‘উনিশ’শ ঊনপঞ্চাশ রচনার মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে কবিতার ক্যানভাস চিত্রিত করেন সমকালীন পরিপ¦ার্শের মিথস্ক্রিয়ায় । সমকালকে ধারণ করে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। মুক্তিযুদ্ধ, নাগরিকবোধ ও প্রেম তাঁর কবিতার অনুষঙ্গ। শামসুর রাহমান কবিতার প্রতিটা ছত্রে প্রকাশ করেছেন স্বকীয় ধ্যান ধারণা – আমার কবিতা গণ-অভ্যূত্থানের চ‚ড়ায় নূহের/ দীপ্তিমান জলযান, আমার কবিতা বলিভিয়ার জঙ্গলে/চে গুয়েভারার বয়ে যাওয়া/রক্তের চিহ্ন গায়ে নিয়ে হেঁটে যায় মাথা উঁচিয়ে/যারা ডুগডুগি বাজিয়ে/যখন ইচ্ছে গণতন্ত্রকে বাঁদর নাচ নাচায়/তাদের পাকা ধানে মই দ্যায় আমার কবিতা, ফুঃ বলে/উড়িয়ে দ্যায় দুর্দশার মুষলপর্ব।/আমার কবিতা নাজিম হিকমতের মতো জেলের নীরন্ধ্র/কুঠরীতে বসে মুক্তির অক্ষরে লেখে আতœজীবনী।
শামসুর রাহমানের কবিতার প্রধান বিষয় ছিলো তাঁর সময় এবং সময়ের প্রবল প্রতিক‚লতা। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সমগ্র পাকিস্তান আমলে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন-সংগ্রাম ও রক্তদানের ব্যাপকতা যেমন তাঁর কবিতায় এসেছে, তেমনি প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশেরও নানা গøানির চিত্র। উনিশ’শ একাত্তরের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে কবি এক দুপুরে পুকুরপাড়ে বসে লিখেছিলেন -স্বাধীনতা তুমি ও তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা কবিতা দুটি। আরাধ্য স্বদেশ ভাবনায় শামসুর রাহমানের বিপ্লবী কলমে অনুভ‚তি জড়ানো হৃদয়ের প্রকাশ ঘটেছে কবিতার ছন্দে – স্বাধীনতা তুমি/রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান/ স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল-/ ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ/ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা, স্বাধীনতা তুমি/শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রæয়ারি উজ্জ্বল সভা/ স্বাধীনতা তুমি, পতাকা শোভিত / সেøাগান মুখর ঝাঁঝালো মিছিল। (স্বাধীনতা তুমি) তাঁর কবিতায় বারবার ওঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন শাহ, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সমর সেনদের নাম। পাশাপাশি দেখা যায় হোমার, বোদলেয়ার, লোরকা তাঁদের নামও তাঁর কবিতায় পাওয়া যায়। দাঁড়িয়ে আছেন এক দেবমূর্তি কবিতায় তিনি লিখেন-আমি বিহবলতা কাটিয়ে চেয়ার ছেড়ে/উঠে দাঁড়ালাম, আমার সত্তায় সশ্রদ্ধ মুদ্রা। রবীন্দ্রনাথ/আমার কাঁধে চাপ দিয়ে বসতে বললেন আমাকে।/লেখো তুমি, কবির ধ্যানে বিঘœ ঘটাতে চাইলে, /তিন অক্ষরের একটি শব্দের জন্য আবার সতৃষ্ণ হয়ে উঠি। কাজী নজরুলকে নিয়ে তাঁর উক্তি-“তোমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে, কী আশ্চর্য,/আমার মনে পড়লো ডেনমার্কের যুবরাজের উক্তি-/এই করোটির ভেতরে ছিলো জবান/এবং একদা সে গান গাইতে পারতো ।” মুক্তিযুদ্ধকালীন উত্তাল সময়ে দেশত্যাগ না করে স্বদেশের মায়ায় থেকে গেলেন দেশের মাটিতে। দেশের সাধারণ মানুষের জ্বালা-যন্ত্রণা, ক্ষোভ-ক্রোধ, বিদ্রোহ-ঘৃণা সবই ধারণ করেছেন নিজের সত্তায় । স্বদেশের মুক্তিকামী চেতনার আলোকে রচনা করলেন বেশ কিছু অমর কবিতা, সমকালীন সমস্ত বেদনাবোধ, বিক্ষোভ, উত্তাপ ও সন্তাপকে ধারণ করে নিজস্ব অনুভ‚তির চেতনায় শানিত হলো কবিতা।
বায়ান্নোর ভাষা সংগ্রামে উজ্জীবিত হয়ে নিজ বাসভ‚মে কাব্যগ্রন্থের বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালায় তিনি লিখেন-উনিশ শো বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পু®পাঞ্জলি/বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।/তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো, /বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে তিনি লিখেন-আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচ‚ড়া/থরে থরে রে শহরের পথে/কেমন নিবিড় হয়ে।/কখনো মিছিলে কখনো বা/একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়-ফুল নয়, ওরা/শহীদের কলুষিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।/একুশের কৃষ্ণচ‚ড়া আমাদের/চেতনারই রঙ। ত্রিশ লাখ শহীদের আতœত্যাগ মিশে আছে এ দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে। স্বাধীনতার জন্য এই যে বিসর্জন, তা বেশ কটি কবিতায় শামসুর রাহমান তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর রচিত এ ধরনের কবিতাগুলোর মধ্যে তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা কবিতাটি অগ্রগণ্য। কবির চোখে স্বাধীনতা আসবে বলে সাধারণ মানুষের ত্যাগ, বিসর্জন : তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা/তোমাকে পাওয়ার জন্যে/আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়? /আর কতবার দেখতে হবে খান্ডবদাহন ? /-নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/এই বাংলায়/তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা। (“তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা”।)
শামসুর রাহমান ও বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামে স্বতঃস্ফ‚র্ত ভাবে লিখেছেন একেকটি প্রেরণাদৃপ্ত কবিতা। কবি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলে ও তাঁর কলম থেমে থাকেনি। তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধের কবিতায় দীর্ঘ ন মাসের করুণ, বীভৎস, হৃদয়বিদারক বর্ণনা উঠে এসেছে । সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে কবি বন্দী শিবির থেকে কাব্যের ভ‚মিকায় লিখেছেন তখন ঢাকা এক কনসেনট্রেশন ক্যা¤প। সুদীর্ঘ ন মাস আমরা যে পরিবেশে বাস করেছি তাকে কাফকার জগত বললে কিছুই বলা হয় না। উৎপীড়ন, হত্যা এবং সন্ত্রাস আমাদের চারপাশে রচনা করেছিল এক ভয়ঙ্কর তমসাচ্ছন্ন ও বিভীষিকাময় পটভ‚মি। আমরা তৃষিত হয়ে পড়েছিলাম এক ঝলক আলোর জন্য। নীরন্ধ শ্বাসরোধকারী সেলের ভেতর বন্দী যেমন ব্যাকুল হয়ে থাকে এক ফোটা আলোর জন্য, ঠিক তেমনি। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ, শিশুরা নিশ্চুপ, ফৌজি জীপের গর্জন, ট্রাকের ঘর্ঘর, বুটের শব্দ, আগুন, আর্তনাদ আমরা এই নিয়েই ঢাকায় ছিলাম তখন। আমরা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতাম। সব সময় মনে হতো কেউ যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। ঘুমের ভেতর চিৎকার করে উঠতাম কোন কোন রাতে। বধ্যভ‚মির ধারে বেঁধে রাখা জীবজন্তুর অনুরূপ আমরা আতঙ্কে জেনেছি নিত্যসঙ্গী বলে। এমন আতঙ্কের মধ্যে থাকলেও অসংখ্য বাঙালির মতো স্বাধীনতার আশা ত্যাগ করেন নি। তাই তো তিনি স্বাধীনতাকে তাঁর কবিতায় নানা রঙে, রূপকে, উপমায় সাজিয়েছেন পরম নিপুণতায় । তাঁর কবিতায় সমাজ, স্বদেশ, গণ-আন্দোলন তাই স্থান পেয়েছে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁর অন্ধ সুন্দরী কাঁদে, বর্ণমালা দিয়ে গাঁথা,বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় ,গর্জে ওঠো স্বাধীনতা প্রভৃতি কবিতা আন্দোলনকে করেছে বেগবান। আবার সামরিক স্বৈরাচারকবলিত দেশের বাস্তবতা উঠে এসেছে উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ এবং স্বৈরাচারের পতন, নূর হোসেনের গুলিবিদ্ধ বুক হয়ে ওঠে তাঁর কাব্যের শিরোনাম-বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়। বুক তাঁর বাংলাদেশের হৃদয় কবিতায় তিনি লিখেছেন-সারারাত নূর হোসেনের চোখ এক ফোঁটা ঘুমও/শিশিরের মত/জমেনি, বরং তার শিরায় শিরায়/জ্বলছে আতশবাজি সারারাত, /কী এক ভীষণ নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়।
১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে। কবির নিমগ্ন অর্ন্তগতবোধে সৃজিত ষাটের দশকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ, আমি অনাহারী ইত্যাদি। প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, বন্দী শিবির থেকে, নিজ বাসভ‚মে, আমি অনাহারী, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে কবির কালিক বোধ ও প্রাণের ¯পন্দনে তিনি ¯পন্দিত করেছেন পাঠকদের-গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্য়াস্তে/ জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়। /বোন তার ভায়ের অ¤¬ান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে/নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো/হৃদয়ের সোনালি তন্তুর সূ²তায়/ বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন ¯েœহের বিন্যাসে।/ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত/মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট/শহরের প্রধান সড়কে/কারখানার চিমনি-চুড়োয়/গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে উড়ছে, উড়ছে অবিরাম/আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিতপ্রতিধ্বনিময় মাঠে, / চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।/আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/ সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক; /আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা। [ আসাদের শার্ট ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে তাঁর ধন্য সেই পুরুষ কবিতায় তিনি লিখেন-ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের উপর পতাকার মতো/দুলতে থাকে স্বাধীনতা, /ধন্য সেই পুরুষ যার নামের উপর ঝরে/ মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি। জাতির জনকের হত্যাকাÐের পর তাঁর কাব্যের শিরোনাম হয় শূন্যতায় তুমি শোকসভা। স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক উত্থানের পটভ‚মিতে কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা। শামসুর রাহমানের প্রায় সকল কবিতাই ছন্দে রচিত উজ্জ্বল কথার মিছিল। এ মিছিলের অগ্রভাগে শুদ্ধ ভাবনার কবি আমাদের পথের দিশা দেখাচ্ছেন তাঁর আলোয় । তাঁর নন্দনভাবনার ঐশ্বর্যময় অসীম আকাক্সক্ষার চিত্রকল্প আজো বাঙালির মুখে মুখে মুখরতা নিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে । মহীরুহপ্রতীম এ কবি বাংলা কবিতার অসীম আকাশে নান্দনিক নক্ষত্ররূপে আলো ছড়িয়ে আমাদের আলোকিত করবেন অনাদিকাল।