কবি জীবনানন্দ দাশের নায়িকারা

521

কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার কল্পিত নায়িকারা স্বনামেই খ্যাত। বনলতা সেন, শঙ্খমালা, সুদর্শনা, শ্যামলী, সুরঞ্জনা আর অরুণি মাসান্যালকে চেনেন না এমন জীবনানন্দ পাঠক বিরল। বনলতা সেন ইতিহাস চেতনা নির্ভর কবি তাহলে ও এই কবিতায় কবি সিংহল সমূদ্র থেকে মালয় সাগরে ঘুরে হাজার বছর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগত পৌঁছেন। পরেতি নিবিদর্ভ নগরে গিয়ে সাক্ষাৎ পান বনলতা সেনের। দিপ্তী ত্রিপাটী বলেন, ‘কবি সমকালীন যুগে প্রেমের অচরিতার্থ রূপ দেখে ব্যাথিত হয়েছিলেন। ফলে তিনি প্রেমের ও সৌন্দর্য্যরে প্রকৃত রূপকে খুঁজেছেন ভুগোল ও ইতিহাসের বৃহত্তর পটে। কবি নিজেই বলেন, পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে সমূদ্রের ফেনিল জলরাশি থেকে বনলতা সেন তাঁকে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিলেন।’
জীবনানন্দ দাশ বনলতা সেনের সৌন্দর্য্য বর্ণনায় বলেন,
‘চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা/
মুখ তার শ্রারস্তীর কারুকার্য/ অতিদূর সমুদ্রের পর / হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারয়েছে দিশা ’ এই বনলতা সেনও যখন কবির সাথে একান্তে মুখোমুখি বসেন তখন দু’জনের মাঝখানে এক অনড় অন্ধকার দু’জনের প্রণয়ে দেয়াল হয়ে বিরাজে।
আমরা দেখি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘স্বপ্ন ’ কবিতায় কল্পনাচারীর বর্ণনা করছেন এভাবে :
‘মুখে তার লোধ্ররেণু লীলাপদ্ম হাতে/
কর্ণমূলে কুন্দকলি কুরুবক মাথে/
তনুদেহে রক্তাম্বর নীবিবন্ধে বাধা/
চরণে নুপুর খানি বাজে আধা আধা ’
রবীন্দ্রনাথ এখানে কালিদাশ ও বৈষ্ণব কবিদের আবহে বিমুগ্ধ ছিলেন। আর জীবনানন্দ দাশ নাটোরের বনলতা সেনকে দেশ কালে সীমাবদ্ধ না রেখে ইতিহাস ও ভূগোলের বিস্তৃতি দিয়ে তাকে বৈশ্বিক চেতনায় উদ্ভাসিত করেছেন। কবির ‘নগ্ননির্জন হাত’ কবিতায় কবি চুড়িবিহীন অদৃশ্য এক রমণীকে কল্পনা করেন।
‘পথে পথে শব্দ পাই কাহাদের নরম শাড়ির,
¤øান চুল দেখা যায়, সান্তনার কথা নিয়ে কারা
কাছে আসে- ধূসর কড়ির মতো হাত গুলো . ..”
‘শঙ্খমালা’ কবিতায় কবি বলেন,
‘কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে/
কে সে এক নারী এসে ডাকিল আমারে/
বলিল , তোমারে চাই :
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যাথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার – পাখনায় ’।
আবার ‘হায়চিল’ কবিতায়ও একই চিত্রকল্প দেখি।
‘বেতের ফলের মতো তার চোখ মনে আসে/
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে দূরে ’
‘আকাশ লীনা ’ কবিতায় কবি সরাসরি সম্বোধন করেন ‘সুরঞ্জনা’ কে :
সুরঞ্জনা ,ওইখানে যেও নাকো তুমি , বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে.. ..
ফিরে এসো সুরঞ্জনা ,
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে’। তিনি ‘সুরঞ্জনা’কে কল্পনার ভূবনে ফিরে আসার জন্য বলেন। তাকে ঘাসের সাথে মিলিয়ে আকাশে বাতাসে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনেন – যেখানে ভালোবাসা জন্মায়।
‘বুনোহাঁস’ কবিতায় এসেছে অরুণিমা সান্যালের নাম :
‘মনে পড়ে কবেকার পাড়াগা’র
অরুণিমা সান্যালের মুখ’। ‘সুদর্শনা’ কবিতায় বলেন, ‘
সুদর্শনা , তুমি আজ মৃত ..’ । সুদর্শনার মতো আরো পাঁচ নারী শ্যামলী, সবিতা, সুরঞ্জনা আর সুচেতনা তাঁকে বনলতা সেনের মতো দুদন্ড শান্তি দিতে পারেনি। সুচেতনা’য় কিছুটা শান্তির আভাস পাওয়া যায়। তিনি বলছেন : সুচেতনা , তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে ।’
জীবনানন্দ দাশের কল্পিত নায়িকারা ও রক্ত মাংসের মানবী। তিনি তাঁর কল্পিত রমণীদের সমস্ত মাধুরী মিশিয়ে প্রকৃতির সাথে একাকার করেছেন। প্রকৃতির রূপ লাবণ্যের সব উপকরণ দিয়ে তিনি তাদের সাজিয়েছেন। আবার তাদেরকেই তিনি ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতা, ইতিহাস আর ঐতিহ্যপ্রীতির সেতুবন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। এখানেই অন্য কবিদের থেকে তিনি পৃথক এবং নি:সন্দেহে সার্থক।