কবি ও বিজ্ঞানী

390

ছাব্বিশ
গত বছরের এই সময়ে ‘আমাদের বিদ্যালয়’ রচনা লিখতে গিয়ে কেউ যদি লিখত-‘আমাদের বিদ্যালয়ের নাম শ্যামলপুর বিদ্যানিকেতন। তুলা টিলার উপরে বিদ্যালয়টি অবস্থিত। ইহা এল(খ) আকৃতির।’ এখন লিখলে সে এল(খ) এর জায়গায় ইউ(ট) লিখে বাকীসব একই লিখবে। অবশ্য ইউ(ট) আকৃতির না লিখে অশ্ব খুরাকৃতিও লিখতে পারে।
পূর্বপাশে নতুন দ্বিতল ভবন হওয়ায় বিদ্যালয়ের আকৃতির এই পরিবর্তন।
নতুন ভবনের কাজ প্রায় শেষের দিকে। শুধু উপর তলার চুনকাম বাকী আছে।
বিদ্যালয়ের পশ্চিম ভবনের নাম ‘প্রশাসনিক ভবন’, উত্তর ভবনের নাম ‘একাডেমিক ভবন’। পূর্ব ভবনে তেমন কোন কার্যক্রম শুরু হয় নাই, তাই তার নির্দিষ্ট কোন নামও নেই। তবে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হয়ে গেলে এই ভবনের নাম ‘বিজ্ঞান ভবন’ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
‘বিজ্ঞান ভবন’ নাম হওয়ার কারণটা বেশ পরিষ্কার। ভবনের নিচ তলার ১০১নং কক্ষ ও ১০২নং কক্ষ বিজ্ঞান ক্লাবের জন্য নির্ধারন করা হয়েছে। দুই বাঙালি বিজ্ঞানীর নামে কক্ষ দুইটির নামকরণ করা হয়েছে। দরজার উপরের চৌকাঠে নামফলক লাগানো আছে। ১০১নং কক্ষের নাম ‘আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কক্ষ’। ১০২নং কক্ষের নাম ‘ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা কক্ষ’। ১০৩নং কক্ষটা বেশ বড়সড়। মাঝখানের পার্টিশানটা না দেওয়ায় একাই ১০১নং ও ১০২নং কক্ষের সমান। এই কক্ষটা হবে লাইব্রেরি ও সেমিনার কক্ষ, যার চৌকাঠে লেখা আছে ‘বিদ্যাসাগর কক্ষ’। পুরাতন লাইব্রেরি এই কক্ষে স্থানান্তরিত হবে। ভবনের উপরের তলায় চারটি কক্ষ। ২০১নং কক্ষটি হবে রসায়ন বিজ্ঞান পরীক্ষাগার, ২০২নং কক্ষটি হবে পদার্থ বিজ্ঞান পরীক্ষাগার। আর ২০৩নং কক্ষটি হবে জীব বিজ্ঞান পরীক্ষাগার। ২০৪নং কক্ষটি হবে স্টোর। যেখানে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদি রাখা হবে। পুরাতন বিজ্ঞানাগার উপরের এই কক্ষগুলোতে চলে আসবে।
বিদ্যাসাগর কক্ষে একটি টেবিল, তিনটি চেয়ার আর একটি লো বেঞ্চ আছে। এই কয়টি আসবাবপত্র ছাড়া নতুন ভবনে আর কোন আসবাবপত্র নেই।
বাসুদেব মন্ডল এখন বিদ্যাসাগর কক্ষে। সামনে টেবিল রেখে চেয়ারে বসা। কোন কক্ষে কোন প্রজেক্ট রাখা যায় তা নিয়েই ভাবছেন। ভাবতে ভাবতেই চোখ চলে গেছে দেয়ালে টাঙানো তিন ছবির দিকে। ছবিগুলো সমীরণ বড়–য়ার আঁকা। আর কিছুদিন পরে নিচের তিন কক্ষে তিন ছবি শোভা পাবে।
ডানের ছবিটা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের। বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড-এর প্রতিষ্ঠাতা। বাসুদেব মন্ডল খানিকক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে মনেমনে বলতে থাকলেনÑকাঁচা পাকা দাড়ি। চুলগুলো এলোমেলো। কিন্তু দু’টি চোখে কী অদ্ভুত দ্যুতি! ব্যবসা ও বিজ্ঞান দু’টাই একসাথে চালিয়েছেন। জন্ম বাগেরহাটের কপোতাক্ষ নদের তীরে বাড়–লি গ্রামে। এই কপোতাক্ষের তীরে মাইকেল মধুসূদন দত্তেরও জন্ম। মাইকেল বাংলা কবিতায় যাদুকরি পরিবর্তন এনেছেন। লিখেছেন বিখ্যাত সব সনেট। শুধু কি বাংলা কবিতায়? তিনি আধুনিকতা এনেছেন নাটকে, প্রহসনে। আর পি.কে. রায় বাঙালির বিজ্ঞান ভাবনায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন প্রায়োগিক বিজ্ঞান, শিল্পকারখানা গড়ে তোলার তাড়না। চিরকুমার এই মানুষটি সারা জীবনের উপার্জন ব্যয় করেছেন বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নয়নে। মানবতার সেবায়।
প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পাশের ছবি তাঁরই ছাত্র ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদার। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান শিক্ষার অন্যতম পথিকৃত। বাসুদেব মন্ডলের চোখ এখন ড. খুদার ছবিতে কেন্দ্রিভূত। চোখে চশমা, মাথায় ছোট ছোট হালকা চুল। চোখেমুখে একটা গাম্ভির্য ভাব। যেন কোন ধ্যানে মগ্ন। তিনি এদেশে বিজ্ঞান আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
বাসুদেব মন্ডল কুদরাত-এ-খুদার ধ্যানমগ্ন ছবিতে নিজেকে লীন করে দিলেন। তিনি খুদাকে নিয়ে ভাবছেন। হঠাৎ করে সেই ভাবনা কাগজে লিখতে থাকলে-
‘কুদরাত-এ-খুদা ১৯২৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়নে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এস-সি পাশ করেন। তারপরই সরকারি বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যান লন্ডনে। সেখানে লন্ডন বিশ^বিদ্যালয় থেকে ১৯২৯ সালে ডি.এস-সি. ডিগ্রি লাভ করেন। একই সময়ে ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ডি.আই.সি ডিগ্রি লাভ করেন। ফিরে এলেন দেশে। দেশে ফিরে চাকুরী না পেয়ে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তির জন্য আবেদন করেন। মৌলিক কোন গবেষণা নিবন্ধ দাখিলের শর্ত দিয়ে, বৃত্তিটি তাঁকে দেয়া হয়। তিনি সেই শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। ১৯৩১ সালে যোগ দেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। শুরু হয় নতুন এক জীবন। এ জীবন অধ্যাপনার ও গবেষণার। তাঁর গবেষণার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে জৈব চক্রাকার অণুর গঠন বের করা অর্থাৎ স্টেরিও কেমেস্ট্রি নিয়ে। তাঁর গবেষণা লব্ধ আবিস্কার প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রিকায়।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলো, তিনি চলে এলেন ঢাকায়। সরকার তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ না দিয়ে, নিয়োগ দেয় শিক্ষা প্রশাসনে। এই কাজের সাথে বিজ্ঞান গবেষণার কোন যোগ ছিল না। আসলে সরকার তাঁর মত বাঙালী সংস্কৃতির মানুষকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় আনার সাহস করেন নি। কারণ কোলকাতা থাকা কালেই মুসলিম লীগ নেতা ও বাংলার প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের সাথে তাঁর সম্পর্ক ভাল ছিল না।
অবশেষে ১৯৫৫ সালে তাঁকে ‘সিএসআরআই’ এর পূর্বাঞ্চলীয় শাখা গঠনের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। পূর্বাঞ্চলে গবেষণাগারের পরিচালকরূপে কুদরাত-এ-খুদাকে কাজ শুরু করতে হয় প্রায় শূন্য অবস্থা থেকে। তিনি কাজ করে গেছেন গবেষক ও প্রশাসকরূপে। দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন ত্বরান্বিত করাই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য। তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে নির্ভেজাল বাঙালী, নিবেদিত প্রাণ রসায়নবিদ, বিজ্ঞান সংগঠক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।
বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার সুবিধা ও অসুবিধাগুলো তিনি বিশ্লেষণ করেছেন একজন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে। বিজ্ঞানী হিসাবে তাঁর সমস্ত ব্যস্ততার মধ্যেও সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞানের বই লিখেছেন। তিনিই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক উচ্চতর পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য চার খন্ডে প্রকাশিত জৈব রসায়ন গ্রন্থটি যেমন বিশাল তেমন জ্ঞানগর্ভ।
শিক্ষাবিদ হিসেবে ড. কুদরাত-এ-খুদার অবিস্মরণীয় কীর্তি হলো তাঁর তত্ত¡াবধানে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন। নতুন বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এমন কোন সমস্যা এবং সমাধানের দিক নির্দেশনা নেই যা ১৯৭৪ সালে প্রণীত এই শিক্ষা প্রতিবেদনে ছিল না। এই শিক্ষা কমিশনের মূলনীতি ছিলÑসেক্যুলার সার্বজনীন বিজ্ঞানমুখী ও এক ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন।
সারা জীবন বিজ্ঞান সাধনায় আত্মমগ্ন এই মানুষটি শেষ জীবনে হঠাৎ করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। যেদিন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তাঁর পড়ার টেবিলে একটি রসায়ন বই খোলা ছিল। হয়তো ভেবেছিলেন ফিরে এসে ওই বই নিয়ে আবার বসবেন। কিন্তু আর ফিরে এলেন না।
১৯০০ সালের ১লা ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মাড়গ্রামের এক খান্দানী পীর পরিবারে জন্মগ্রহণকারী এই বিজ্ঞান সাধক ১৯৭৭ সালের ৩রা নভেম্বর ঢাকার পি.জি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।’
বাসুদেব মন্ডলের ভাবনা থেমে গেছে। একই সাথে লেখাও থেমে গেল। বেশ বড়সড় একটা লেখা হয়েছে। তিনি লেখাটি প্রথম থেকে পড়লেন। পড়া শেষে মনেমনে বললেন-আরেকটু ঘষামাজা করলেই বেশ সুন্দর একটা লেখা হয়ে যাবে। বিজ্ঞান ক্লাব উদ্বোধনের দিন এটা উপস্থাপন করা যাবে।
বাসুদেব মন্ডল কাগজের উপর কলমটা রাখলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে হাত দু’খানা মাথার পিছনে নিলেন। মাথাটাকে একটু ডানে-বামে ঘুরালেন। তারপর সোজা হয়ে বসলেন। কলমের খোলা মুখ বন্ধ করলেন। কাগজটাকে মাঝখান বরাবর ভাঁজ করে ডায়েরির মধ্যে রাখলেন। তারপর আবার চেয়ারে হেলান দিলেন। সেইসথে চোখ চলে গেছে ছবির দিকে।
তিনি তাকিয়ে আছেন চাদর গায়ে দেওয়া বিদ্যাসাগরের ছবির দিকে। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অস্ফূট স্বরে বললেনÑবিদ্যাসাগর বললেই ঈশ^র চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ ভেসে আসে। কিন্তু বিদ্যাসাগর কোন নাম না, একটা উপাধি। একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত লেখা পড়া করলে এই উপাধি দেওয়া হতো। যে উপাধি তিনি সংস্কৃত কলেজের সমাপনী সনদ পাওয়ার আগে হিন্দু ল’ কমিটি পরীক্ষা পাশের জন্য পেয়েছিলেন তা আজ তাঁর নামে পরিণত হয়েছে।
বাসুদেব মন্ডল এখন অনেকটা ভাবনাহীন। তবে তাকিয়ে আছেন বিদ্যাসাগরের ছবির দিকে । আর মিটমিট করে হাসছেন। এমন সময় হেডস্যার চৌকাঠ পেরিয়ে ভিতরে পা রেখেছেন। বাসুদেব মন্ডল হেলানো অবস্থা থেকে সোজা হলেন, কিন্তু হাসি লুকাতে পারলেন না।
হেডস্যার আগাতে আগাতে বললেনÑকী ব্যাপার একা একা হাসছেন ?
বাসুদেব মন্ডল হাসিটা আরেকটু চওড়া করে বললেন-বিদ্যাসাগরের কপাল দেখে হাসি পেল। বেশ বড়সড় একখান কপাল।
হেডস্যার চেয়ারে বসতে বসতে বললেন-বড় মানুষের কপাল তো বড় হবেই। তবে তিনি উড়িয়াদের মতো সামনের দিকে মাথা খানিকটা কামিয়ে রাখতেন। তাই ছবিতে তাঁর কপাল বেশ প্রশস্ত দেখায়।
বাসুদেব মন্ডল এই কথাতে বেশ মজা পেলেন। তাঁর মধ্যে কৌতুহল কাজ করছে। চোখেমুখে একটা জিজ্ঞাসু ভাব ফুটে উঠেছে। যার অর্থ হচ্ছে, এ রকম আরো মজার কথা আছে না কি?
হেডস্যার বিষয়টা ধরতে পারলেন। তিনি হেসে বললেন-বিদ্যাসাগর ইংরেজ রাজকর্মকর্তাদের সান্নিধ্যে জীবন অতিবাহিত করলেও, সারা জীবন থান ধুতি, চাদর আর চটি পায়ে ঘরে বাইরে চলাচল করেছেন। এ নিয়ে ইংরেজ কর্মকর্তাদের আপত্তি থাকলেও তিনি তাঁর অভ্যাস পাল্টান নি। একবার ছোটলাট হ্যালিডে সাহেব তাঁকে ইংরেজদের পোশাক পরার জন্য, সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিলেন। দু-তিন বার এসব পোশাক পরার পর বিদ্যাসাগর লাট সাহেবকে জানিয়ে দেন, এ পোশাক পরতে বাধ্য করলে সেটাই হবে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা। অবস্থা বুঝে হ্যালিডে তাঁর অনুরোধ প্রত্যাহার করে নিয়ে বিদ্যাসাগরকে তাঁর পছন্দের পোশাক পরে লাটভবনে আসার অনুমতি দেন।
বাসুদেব মন্ডলের শুনতে ভালই লাগছে। হেডস্যার মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে বলে যেতে লাগলেন-সাদাসিধে এই মানুষটার আত্মসম্মান বোধ বেশ টনটনে। এই নিয়ে একটা ঘটনা বলি, বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক। আর জেমস কার হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ। একদিন বিশেষ প্রয়োজনে বিদ্যাসাগর হিন্দু কলেজে কার সাহেবের কাছে যান। দেখেন, কার সাহেব জুতোসহ পা দুইটি সামনের টেবিলে তুলে রেখেছেন। বিদ্যাসাগরকে দেখেও পা নামান নি, বরং পায়ের দিকে চেয়ার দেখিয়ে তাতে বসতে বললেন। এর কিছুদিন পর কার সাহেবের বিদ্যাসাগরের প্রয়োজন পড়ল। সাহেব এসেছেন খবর শুনে বিদ্যাসাগর তাড়াতাড়ি তাঁর চটি দুখানা পায়ে গলিয়ে পা দুটো টেবিলে তুলে নাড়তে নাড়তে সাহেবকে স্বাগত জানালেন এবং কথাবার্তা সারলেন। সাহেব ফিরে গিয়ে উপরওয়ালাকে নালিশ জানালেন। বিদ্যাসাগরকে কৈফিয়ত তলব করা হয়। তিনি ইংরেজিতে তার সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন। হুল ফুটানো ব্যঙ্গাত্বক জবাব।
হেডস্যার মৃদু শব্দে হাসছেন। এই হাসিতে আত্মতৃপ্তি আছে। মনে হচ্ছে তিনিই বিদ্যাসাগর।
বাসুদেব মন্ডল ভাবলেন-স্যারের মধ্যে একটা ছোটখাট দ্ব›দ্ব ঢুকিয়ে দিলে কেমন হয়?
তিনি ভাবনা মতন এগোলেন। হেডস্যারের হাসি তখনও থামে নাই। বাসুদেব মন্ডল সেই হাসির মধ্যে বললেন-ল্যাম্প পোস্টের নিচে পড়া এক ব্রাহ্মণের ছেলে অর্জন করলেন বিশাল পান্ডিত্য। হয়ে গেলেন বিদ্যাসাগর। আবার তিনি দয়ার সাগর। নিজের মেধা ও শ্রম দিয়ে যা তিনি অর্জন করেছেন তা ব্যয় করেছেন জনস্বার্থে। সাহয্যের ক্ষেত্রে তাঁর কোন জাতপাত ছিল না। যিনি একসময় বলতেন, রাজ নারায়ণ দত্তের ছেলে গুণে পয়সা দেয় না, সেই মধু কবিকেও সাহায্য করেছেন। আবার হীরা বুলবুল বাইজির ছেলেকে হিন্দু কলেজে ভর্তি করিয়ে তখনকার জাত্যাভিমানে ভরা হিংসাপূর্ণ সমাজে মানুষের অধিকার স্থাপনের জন্য লড়াই করেছেন।
হেডস্যার টেনে টেনে বললেন-বাববা! একটু টোকা দিতেই রস একেবারে হুরহুর করে বের হতে শুরু করেছে।
বাসুদেব মন্ডল হেসে বললেন-বিদ্যাসাগর নিয়ে আমার জানা একেবারেই কম। এসব আমার মা থেকে শুনা। মায়ের কাছ থেকে শুনেছি, বিদ্যাসাগর খুব মাতৃভক্ত ছিলেন। বিদ্যাসাগরের কাছে মায়ের টেলিগ্রাফ এসেছে ‘চলে আস’। বড় সাহেব ছুটি দিলেন না। তবু তিনি বের হলেন। ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই নিয়ে দাদার বইতে একটা লেখা ছিল। তারই একটি লাইন হচ্ছে, চটি জুতা হাতে লইয়া, ছাতা মাথায় দিয়া ঈশ^র চন্দ্র দামোদর নদী পার হইলেন। কী এক অদ্ভুত কারণে মেজদা এই লাইনটাকে একটু ওলট-পালট করে পড়তেন, ছাতা হাতে লইয়া, চটি জুতা মাথায় দিয়া ঈশ্বর চন্দ্র নদী পার হইলেন।
হেডস্যার হেসে উঠলেন, একইসাথে বাসুদেব মন্ডলও।
হেডস্যার হাসির রাশ টেনে বললেন-আর কোন ইন্টারেস্টিং কথা?
Ñনা, আর নেই। ওহ্, এটা ইন্টারেস্টিং কি না বুঝতে পারছি না। আমাদের সময় ষষ্ঠ সপ্তম শ্রেণিতে আরবি সংস্কৃত প্রচলন ছিল। সপ্তম শ্রেণিতে বাবা ‘অমর বইঘর’ থেকে একটা সংস্কৃত বই এনেছিলেন। বইটির নাম মনে নেই। তবে বইয়ের মলাটে বিদ্যাসাগরের নাম ও ছবি ছিল। বাংলায় বচন দুইটি হলেও সংস্কৃতে বচন তিনটি। একবচন, দ্বিবচন, বহুবচন। নর-নরো-নরা। বিষয়টা জেনে বেশ ভাল লেগেছিল।
Ñএইতো নেই নেই করেও আস্তে আস্তে বের হচ্ছে। আপনার এই বিষয়টার মতন আমারও একটা ঘটনা আছে। আমার ধারণা ছিল ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ রবীন্দ্রনাথের লেখা। পরে হুমায়ুন আজাদের লাল নীল দীপাবলি থেকে জেনেছি, এটা বিদ্যাসাগরের লেখা। তাঁর বর্ণ-পরিচয় বইয়ের একটি ছন্দময় চরণ। এটা জেনে ভুল ভেঙ্গেছিল, আবার কেমন কেমন যেন লাগছিল। কত সময় কত জায়গায় বলেছি‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ রবীন্দ্রনাথের প্রথম সৃষ্টি, এটা দিয়ে তাঁর সাহিত্য কর্ম শুরু।
হেডস্যার একটু থেমে বললেন+এই লাল নীল দীপাবলিতে বিদ্যাসাগরের গদ্যাংশের একটি নমুনা পড়েছিলাম। সীতার বনবাস থেকে নেয়া। বেশ চমৎকার।
হেডস্যার গদ্যাংশটি আবৃত্তি করে গেলেন-‘এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি। এই গিরির শিখরদেশ, আকাশপথে সততসঞ্চরমাণ জলধরমন্ডলীর যোগে, নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত, অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপ সমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নলিরা গোদাবরী, তরঙ্গ বিস্তার করিয়া, প্রবল বেগে গমন করিতেছে।’
বাসুদেব মন্ডল এর মাঝে ভাবলেন-স্যার বিদ্যাসাগরের সাহিত্য জীবনে ঢুকে পরেছেন। এখনই দ্বন্দ্বটা ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।
বাসুদেব মন্ডল সেই মোতাবেক বললেন-বিদ্যাসাগর গদ্যসাহিত্যের জনক। তিনি তিনটি ক্ষেত্রে বেশ জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে বাংলায় আধুনিক শিক্ষার বিস্তার, বাংলা গদ্য ও সাহিত্যের বিকাশ এবং বিধবা বিবাহ, নারী শিক্ষাসহ নারীর অনুকূলে সমাজ সংস্কার। তাহলে স্যার এই তিন ক্ষেত্রের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র কোনটাতে বেশি উজ্জ্বল?
হেডস্যার সরু চোখে তাকালেন। শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-‘তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা’। আবার ‘ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর’ শিরোনামে এক সনেটে লিখেছেন-
বঙ্গ সাহিত্যের রাত্রি স্তব্ধ ছিল তন্দ্রার আবেশে।
অখ্যাত জঢ়ত্ব ভারে অভিভূত। কী পূণ্য নিমিষে
তব শুভ অভ্যুদয়ে বিকীরিল প্রদীপ্ত প্রতিভা
এমন আশার রশ্মি নিয়ে এল প্রতুষ্যের বিভা,
এটুকু বলে হেডস্যার থামলেন। একটু ভেবে নিয়ে বললেন-প্রশ্নটার উত্তর একটু পরেই দিই। আপনি তো অক্ষয় কুমার দত্তকে চিনেন?
-হ্যাঁ, বিজ্ঞান প্রচারক।
-তিনিতো বিজ্ঞান মুখেমুখে প্রচার করেন নাই। বিভিন্ন ইংরেজি বইপত্র ঘেঁটে লিখেছেন ‘পদার্থবিদ্যা’। এটাই প্রথম বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই। তাছাড়া লিখেছেন ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’ যা একটি অনুবাদ বই। তাঁর জনপ্রিয় পাঠ্যবই ‘চারুপাঠ’। তাঁর আরো অনেক বই আছে। সবই গদ্যে লেখা। অবশ্য তাঁর প্রথম বইটি কাব্যের ‘অনঙ্গমোহন’। তিনি ‘তত্ত¡বোধিনী’ প্রত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছিঅক্ষয় কুমার দত্তের কাজের কিছু ক্ষেত্র আছে। সময়ের বিবেচনায় তা বেশ জোরালো এবং গুরুত্বপূর্ণ। তার একটি হচ্ছে সাহিত্য চর্চা, যা গদ্য নিয়ে। আরেকটি হচ্ছে বিজ্ঞান চর্চা ও প্রচার। আর হচ্ছে পত্রিকার সম্পাদনা। এবার বলুন তো অক্ষয় কুমার দত্ত কোন ক্ষেত্রে বেশি উজ্জ্বল?
এমন প্রশ্নে বাসুদেব মন্ডল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। দ্বন্দ্ব ঢুকাতে চেয়েছিলেন হেডস্যারের মধ্যে, উল্টো হেডস্যার নিজেই দ্বন্দ্ব ঢুকিয়ে দিলেন।
হেডস্যার মিটমিট করে হাসছেন। পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে বাসুদেব মন্ডলের সামনে রাখলেন।
বাসুদেব মন্ডল কিছু বলার আগেই উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আসি বলে বের হলেন।