কবি ও বিজ্ঞানী

80

কথা সাহিত্যিক স্বদেশ দত্তের ‘কবি ও বিজ্ঞানী’ একটি ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস। আটাশটি পরিচ্ছদে বিভক্ত উপন্যাসটিতে কবি-সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানমনস্ক জনের মধ্যে সমান্তরাল চিন্তাকে উপন্যাসের কাহিনী বিন্যাসে পাঠকদের জন্য সুখপাঠ্য করে তুলেছেন।
– বিভাগীয় সম্পাদক
সাতাশ
ছয় দিনের মতন হয়ে গেছে, হেডস্যারের দেওয়া কাগজের ভাঁজ এখনও খোলা হয় নাই। বাসুদেব মন্ডলের সাধারণত এরকম হয়। ছোটবেলায় মায়ের দেওয়া শিক্ষা করবো, করবো বলে কোন কাজ ফেলে রাখতে নেই। রামায়ণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতেন লঙ্কেশ্বর রাবণ স্বর্গে যাওয়ার সিঁড়ি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আজ করব, কাল করব করে করে আর পারলেন না।
তবে এইক্ষেত্রে পড়ব পড়ব বলে পড়া হয় নাই, সেই কথাটি পুরোপুরি সত্যি নয়। যদিও আধা সত্য বা আধা মিথ্যা বলে কিছু নেই।
বাসুদেব মন্ডল ভাঁজ করা কাগজ হাতে নিয়ে নিজেকে নিজে কৈফিয়ত দেওয়ার মতন ভেবে চলেছেন স্যার চলে যাওয়ার পরই কাগজের ভাঁজ খোলা যেত। কিন্তু ক্রীড়া স্যার চলে আসায় আর হয়ে উঠল না। কত ডিগ্রি কোণে বর্শা নিক্ষেপ করলে পাল্লা সবচেয়ে বেশি হয়, তা গাণিতিক ভাবে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেশ বড় একটা সময় চলে গেল। এরপর খেলার মাঠে যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন। ছাত্রছাত্রীদের নিক্ষেপ কোণ ৪৫ ডিগ্রি হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। কী আর করা ? সবকিছু রেখে যেতে হল খেলার মাঠে। পরের দিনগুলোতে ক্লাব আর ল্যাব সাজানোর কাজে কেটে গেল। অবশ্য ল্যাবের কাজে তেমন সময় দিতে হয় নাই। ফিজিক্স, কেমেস্ট্রির নতুন দুই স্যার বেশ তড়িৎ কর্মা।
ভাবনার মাঝে পায়ের পাতায় হুল ফুটিয়ে দিয়েছে মশা। সাথে সাথে ভাবনায় ছেদ পড়ল।
বাসুদেব মন্ডল কাগজখানা টেবিলে রেখে পা তুলে বসেছেন। হুল ফুটানো জায়গায় চুলকাচ্ছে। তিনি সেখানে হালকা করে হাত বুলাতে লাগলেন। একইসাথে বিরক্তির সুরে বলে উঠলেন সন্ধ্যা হলেই কোত্থেকে যে, মশা চলে আসে ? কামড়াবার আর সময় পেলি না ?
গলার স্বরে খানিকটা ঝাঁঝ মেশানো। তা চলে গেছে অন্দর মহলে।
ভিতর থেকে শর্মিলা বলে উঠলেন মশার আবার সময় অসময় কী ? সুযোগ পেলে তো কামড়াবে। দাঁড়াও ধূপের ব্যবস্থা করছি।
বাসুদেব মন্ডল পা নামিয়ে রাখলেন।
শর্মিলা মাটির সড়ায় ধূপ জ্বালিয়ে এনেছেন। সড়াখানা পায়ের কাছে রাখতে রাখতে বললেন দেখ, আগুনে আবার পা দিয়ে বস না।
আগুনে কেন পা দিব ?
দিতেও তো পার। বিজ্ঞানীরা না কি বেখেয়ালী হয় ?
তাই না কি ? কে বলেছে ?
তুমি বলেছ। নিউটন তাঁর বাগদত্তাকে আংটি পরাতে গিয়ে কী এক ভাবনায় পড়ে গেলেন। ধরে আছেন বাগদত্তার হাত। এরই মাঝে ধূমপানের নেশা পেয়ে বসেছে। প্রেমিকার আঙ্গুলকে সিগারেট ভেবে লাইটার দিয়ে আগুন ধরাতে গেলেন। বাস, বিয়ে গেল ভেঙ্গে।
বাসুদেব মন্ডল ‘এ্যাঁ’ করে উঠলেন। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না, নিউটনকে নিয়ে এই ধরণের স্থ’ূল রসিকতা কখন করলেন ?
শর্মিলা দ্ব›দ্ব ঢুকিয়ে দিয়ে বেশ মজা পাচ্ছেন। তিনি দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। ঘন্টার কাঁটা সাতটার কাছাকাছি। তিনি আর দেরি না করে, হাসতে হাসতে ভিতরে চলে গেলেন।
বাসুদেব মন্ডল মৃদু স্বরে ‘থাক’ বলে, সরাসরি কাগজের ভাঁজ খুললেন। লিগেল সাইজের দুইটি কাগজ। বেশ সুন্দর ঝকঝকে লেখা। ‘প্রিয় বিজ্ঞানী’ দিয়ে শুরু। বাসুদেব মন্ডল একটুখানি হেসে পড়তে শুরু করলেন।
‘কথাগুলো সরাসরি বলতে পারতাম। প্রায়ই সব কথা বলা হয়ে উঠে না। আবার অনেক সময় বলার চেয়ে লেখায় প্রকাশ করা সহজ। আসল কথায় যাওয়ার আগে কিছু গল্প বলে নিই। গল্পের বিষয় ইতিহাস।
ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের এক বইয়ে পড়েছিলাম কোন হিন্দু লেখক প্রথম হজরত মোহাম্মদ(দ.) এর জীবনী লিখিয়াছেন? তার উত্তর হচ্ছে ঐতিহাসিক রামপ্রাণ গুপ্ত। তাঁর লিখিত ‘প্রাচীন ভারত’ গ্রন্থ বেশ সুখপাঠ্য। এই ঐতিহাসিক অনেকটা স্বশিক্ষিত। প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষা ম্যালেরিয়ার জন্য দিতে পারেন নাই। পরের বছর গণিতে অকৃতকার্য হন। এর পরের বছরও গণিতে অকৃতকার্য হলেন। টাঙ্গাইল শহরের বড় কালী বাড়ী রোডের দক্ষিণ দিকে একটি স্মৃতি স্তম্ভ ছিল। তাতে শ্বেত পাথরের ফলকে উৎকীর্ণ ছিল
রামপ্রাণ গুপ্ত
জন্ম ১৮৬০ খৃষ্টাব্দ
মৃত্যু ১৯২৭ খৃষ্টাব্দ
“যে যায় যাক
যে থাকে থাক
শুনে চলি
তোমারই ডাক”
এই স্মৃতিস্তম্ভ স্বাধীনতার পর হারিয়ে গেছে।
১ম কাগজের লেখা এখানে শেষ। পরের কাগজে যাওয়ার আগে বাসুদেব মন্ডল ভাবলেন স্যার, এই লেখায় কী বুঝাতে চাচ্ছেন? মানুষ ইচ্ছা করলেই নিজেকে নিজে শিক্ষিত করতে পারে। না কি, অতীতকে সংরক্ষণ করতে হয়, যা ভবিষ্যৎকে প্রেরণা যোগায়।
বাসুদেব মন্ডল ভাবনা রেখে পরের কাগজে চলে গেলেন।
‘আমরা জানি, আমির হোসেনের বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু যে বিষয়টা আমাদের প্রায় সকলেরই অজানা তা বলছি। আমির হোসেনের বাবার কাছ থেকেই শোনা।
আমির হোসেনের বাবা যুদ্ধে গেলেন। তখন তাঁর বিয়ে হয় নাই। কিন্তু ভালবাসার একজন আছেন। কথা ছিল যুদ্ধ শেষে ফিরে আসলে দেখা হবে। পাশের বাড়ির মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেছে মানুষরূপী হায়েনারা। সেইসব হায়েনারা মেয়েটার উপর চালিয়েছিল বর্বরতা।
যুদ্ধ শেষে বিজয়ের পতাকা নিয়ে ফিরে এলেন ফকির হোসেন। ফকির হোসেন এসেছেন তাঁর ভালবাসার কাছে। ভালবাসার মানুষটি তখন মুখ লুকাতে চাচ্ছেন। অনেক চাপাচাপির পর বর্ণনা করলেন সেইসব নর পিশাচদের নির্যাতনের কথা। তাঁর পেটে ছোট্ট ভ্রæণ।
মেয়েটি অপেক্ষায় ছিল তার ভালবাসার মানুষটির জন্য। এখন তাকে কাছে পেয়েও দূরে সরে যেতে চায়। সে আর বাঁচতে চায় না। ফকির হোসেন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা আত্মত্যাগ করতে জানেন। ভালবাসতে জানেন। তিনি তাঁর ভালবাসাকে মরতে দিতে পারেন না। বিবি কুলসুম হয়ে গেলেন, কুলসুম হোসেন। ছোট ভ্রুণটা বড় হতে লাগল। একসময় ভূমিষ্ঠ হলো। নাম হলো আমির হোসেন।’
বাসুদেব মন্ডল শিহরিত হয়ে উঠলেন। সারা শরীর শীতকাঁটা দিয়ে উঠল। কী অসাধারণ ভালবাসা। দুই মুক্তিযোদ্ধা পরম বিশ্বস্ততায় একে অপরের হাত ধরল। একইসাথে বাঁচিয়ে রাখল মানবতা। বাসুদেব মন্ডলের মধ্যে সহসা ক্রিয়া করতে লাগল দ্বৈত ভাব। যার একটি হচ্ছে ভালবাসা। এই ভালবাসা মুক্তিযোদ্ধার প্রতি। যারা যুদ্ধ করেছে। যারা সম্ভ্রম হারিয়েছে। যারা দুঃখ কষ্টের মধ্যে ভালবেসে গেছে এদেশের মাটি ও মানুষকে। আরেক ভাব ঘৃণা। এই ঘৃণা সেইসব জানোয়ারদের প্রতি, যারা এইদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ আর লুণ্ঠন করেছিল।
বাসুদেব মন্ডল কিছুক্ষণের জন্য সেই দ্বৈত ঘোরে আটকে গেলেন। ধীরে ধীরে সেই ঘোর কাটিয়ে পরের অংশ পড়তে লাগলেন।
‘আমাদের এইদেশ ত্যাগের মাধ্যমে পাওয়া। এইদেশকে আমাদেরই গড়তে হবে। যার জন্য প্রয়োজন মেধা ও বিবেক। আমার কাছে মনে হয় মেধার উৎস মাথা এবং বিবেকের উৎস হৃদয়। এই দুয়ের প্রতিবিম্ব বিজ্ঞানী ও কবি। আমাদের বিদ্যালয়ে কবি ও বিজ্ঞানীর সমন্বয় ঘটেছে। সেই সমন্বয়ে আমি অনুঘটক হিসাবে কাজ করতে পারায় ভাগ্যবান। আমার খুবই ভাল লাগছে পরম করুণাময়ের ইচ্ছায় একটি বিজ্ঞান ক্লাবের উদ্বোধন ঘটবে। একই দিনে প্রকাশিত হবে একটি কবিতার বই। এরপরই একটি নতুন কাজে হাত দিব।
আমার এক নতুন খেয়াল জেগেছে। ছোট একটা যাদুঘর। মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘর। যাদুঘরটা হবে আমার বাড়ির আঙ্গিনায়। সংগ্রহের কাজ শুরু করেছি। এইক্ষেত্রে আপনাকে আমার প্রয়োজন – তবে সংগ্রহের জন্য নয়, সংরক্ষণের জন্য।’
পড়া শেষ। বাসুদেব মন্ডল মনেমনে বলে উঠলেন এ তো দেখি মহৎ উদ্যোগ। এই উদ্যোগের সাথে থাকতে পারাটাই একটা বিশাল পাওয়া।
বাসুদেব মন্ডল ভাবছেন স্যারের চাওয়াটা একেবারে পরিস্কার। সংগৃহীত বস্তুকে সংরক্ষণ করতে হবে। সংরক্ষণের জন্য বস্তুর গঠন উপাদান সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। সংগৃহীত বস্তুগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। জৈব বস্তু ও অজৈব বস্তু। বস্তুর গুণগত মান ঠিক রাখার জন্য কক্ষের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জরুরি। এইসবের কারণে ভৌত ক্ষতি হয়ে থাকে। আর এইসব রোধ করা গেলে জৈব ক্ষতিও রোধ করা যায়। আশেপাশে ধোঁয়ার উৎস না থাকলে রাসায়নিক ক্ষতি নিয়ে তেমন কোন ভাবনা থাকে না।
বাসুদেব মন্ডল যাদুঘরে কী কী বস্তু ঠাঁই পেতে পারে তা নিয়ে ভাবছেন যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘর, সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি চিহ্ন সংরক্ষণ করার কথা। সেই হিসেবে আলোকচিত্র, বই, পুরনো পত্রিকা, ব্যবহৃত কাপড়, তৈজসপত্র আরো কত কিছু ?
বাসুদেব মন্ডল ভাবনা থামিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। দরজা খোলা। আকাশ দেখা যাচ্ছে। আকাশের দিকে ভাল করে তাকালেই, আকাশ বাইরে আসার ডাক দেয়।
বাসুদেব মন্ডল সেই ডাক উপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
আটাশ
আকাশে শুক্লা পঞ্চমীর চাঁদ। বাসুদেব মন্ডল উঠানে দাঁড়িয়ে উত্তর আকাশে তাকালেন। ধ্রুবতারাটা হাসছে। তারই উত্তরে সপ্তর্ষিমন্ডল প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে ঝুলে আছে। বাসুদেব মন্ডল সেই ঝুলে থাকা প্রশ্নবোধক চিহ্নের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। মাথায় কালপুরুষ দেখার খেয়াল জেগেছে। কালপুরুষ কেমনে দেখতে হয় তা বাবা শিখিয়েছেন। প্রথমে খুঁজে নিতে হয় কোমরবন্ধের তিন তারা। চিত্রলেখা, ঊষা আর অনিরুদ্ধ।
বাসুদেব মন্ডল আকাশে চোখ বুলাতে লাগলেন। খুঁজছেন কালপুরুষ। পেলেন না। কিছুক্ষণ পর ‘থাক’ বলে হাঁটতে লাগলেন। তিনি উঠান পেরিয়ে হালদ দিয়ে হাঁটছেন। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন মেঠো পথে। এই পথ দখিন বিলের মাঝ দিয়ে চলে গেছে। মিশেছে রাজপথের সাথে।
পথের মাঝখানে খাল। খালের উপর বাঁশের সাঁকো। বাসুদেব মন্ডল সাঁকো দিয়ে গেলেন না। শুকনা খাল, হেঁটে পার হলেন।
খাল পেরিয়ে কিছুদূরে আম গাছ। আম গাছ তলে বসবেন বলে থামলেন। কিন্তু সেখানে বসলেন না। আরেকটু সামনে গিয়ে উঁচু মাটির ঢিবিতে বসলেন। এখান থেকে খাল পার আর রাজপথ দু’ই দেখা যায়। খাল পারের বাঁশ ঝাড় থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক। আর রাজপথে মাঝে মাঝে হর্ন বাজিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি।
বাসুদেব মন্ডলের মাথায় আবার কালপুরুষ দেখার খেয়াল চেপেছে। তিনি হাত দু’খানা পিছনে রেখে মাটিতে ভর দিলেন। বসেছেন হাঁটু ভাঙ্গা ‘দ’ এর মতন। তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। এমন সময় সুরুজ আলী পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
গলার স্বর শুনেই বাসুদেব মন্ডল চিনতে পারলেন। তিনি যেমন ছিলেন, তেমন আছেন। সেই অবস্থাতেই বললেন বস।
সুরুজ আলী বসতে বসতে বলল কী দেখেন, স্যার ?
দেখছি না। খুঁজছি। কালপুরুষ।
কালপুরুষ ? এখন তো কালপুরুষের সময় না।
মানুষ অনেক সময় জানা জিনিসও ভুল করে। কিন্তু একটুখানি ধরিয়ে দিলেই সেই ভুল সহজে ভেঙ্গে যায়। বাসুদেব মন্ডলেরও তা হল। মুহুর্তের মধ্যে মনে পড়ল কালপুরুষ মাঘ-ফাগুনের তারার মেলা।
তিনি আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে বললেন আসলেই তো। থাক। কী মনে করে ? কোথায় যাচ্ছ ?
আপনার কাছে।
আমার কাছে ? তাহলে ভুল করে কালপুরুষ দেখতে গিয়ে ভালই হল। এখন ঘরে গিয়ে আমায় পেতে না। আবার তোমার বৌদিও কিছু বলতে পারত না।
বাসুদেব মন্ডল ছোট বাচ্চাদের মতন হেসে উঠলেন। সেই হাসির মধ্যেই জিজ্ঞেস করলেন কোন কাজে ? না, এমনি ।
বাড়িতে হেডস্যার এসেছিলেন। রেডিওটা নিয়ে গেছেন।
রেডিও নিয়ে গেছেন মানে ?
আমার বাপ-দাদার আমলের রেডিওটা। স্যার সন্ধ্যায় এসে রেডিওটা চাইলেন। দিলাম। হাতে নিয়ে বললেন, তুমি যেমন যত্নে রেখেছ, আমিও এটা যত্নে রাখব। তোমার যত্নে রাখা জিনিসটা আমি নিতে চাই। কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। স্যার একটা জিনিস চাচ্ছেন, না করা যায় না। স্যার রেডিওটা নিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, আমাদের বিজ্ঞানীর কাছে যাও। কথাবার্তা বল। তোমার দ্বিধান্বিত মনের উত্তর পেয়ে যেত পার।
বাসুদেব মন্ডল সোজা হয়ে বসলেন। স্বল্প চাঁদের আলোতেও সুরুজ আলীর জিজ্ঞাসু মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি মনে মনে বললেন স্যারের কাগজটা ঠিক সময়েই খুলেছিলাম।
তিনি সুরুজ আলীকে অপেক্ষায় না রেখে বললেন স্যার তাঁর বাড়ির আঙ্গিনায় একটি মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি যাদুঘর করবেন।
মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘর ?
হ্যাঁ, মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘর। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি চিহ্ন রাখা হবে। সেই স্মৃতি চিহ্ন সংরক্ষণের তত্ত্বাবধানে আমাকে রাখতে চান।
সুরুজ আলী তার উত্তর পেয়ে গেছে। আবছা আলোতেও তার উজ্জ্বল মুখ খুব সহজে ধরা দিচ্ছে। তার আনন্দময় অভিব্যক্তি কবিতা হয়ে প্রস্ফূটিত হলো
আহা মুক্তিযুদ্ধ
কে করে রুদ্ধ ?
আমরা স্বাধীন
বদলায় দিন
ঐ বীর সেনানী
মুছে দিল গ্লানি
স্বাধীন বাংলাদেশ
সেদিনের চিহ্ন
যাদুঘরে পূর্ণ
ধরে আছে অতীতের রেশ।
সুরুজ আলীর মুখে এখন চওড়া হাসি।
বাসুদেব মন্ডলও হাসছেন। সেই হাসি থামিয়ে বললেন উত্তর পেয়ে গেছ। এখন ভার শূন্য। ভার শূন্য অবস্থায় আকাশ দেখার মজাই আলাদা। চল আকাশ দেখি।
বাসুদেব মন্ডল সেই আগের মতন ‘দ’ হয়ে বসেছেন। তাঁরই অনুকরণে সুরুজ আলীও বসেছে।
দুইজন সৃষ্টিশীল মানুষ মনের আনন্দে আকাশ দেখছে। আকাশ মনের প্রশস্ততাকে বাড়িয়ে দেয়।
…… সমাপ্ত …..