কবিতায় স্বাধীনতার আখ্যান

435

বাংলা সাহিত্যের কাব্য সৃজনের সংগ্রামীযোদ্ধারা তাঁদের কবিতায় চেতনার স্ফুলিঙ্গে স্বাধীনতাকে অনির্বাণ শিখার সহস্র প্রতীতিতে সাজিয়েছেন পরম নৈপুণ্যে। কবি নজরুল স্বাদেশিকতার দ্রোহ উন্মাদনায় বাঙালিকে টেনে নিয়ে গেছেন যুদ্ধের ময়দানে- কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙ্গে ফেল বলে। লাথি মার ভাঙ্গরে তালা, যতসব বন্দীশালায় আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি বলে কবিতাকে তিনি শাণিত করেছেন ক্ষুরধার লেখনীর অগ্নিবাণে। স্বাধিকারের দাবিতে সোচ্চার কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার কবিতাতেই বিধৃত করেছেন বাঙালির স্বাধীনতার আর্তি। বাঙালি জাতি জ্বলে পুড়ে ছারখার হতে পারে তবু মাথা নোয়াবার নয়।
কবিদের কবিতার শৈল্পিক ছন্দের চিন্ময় প্রকাশ লড়াকু মানুষকে সবচেয়ে বেশি উজ্জীবিত করেছে। কবিতার জমিনে তাই ফুটে ওঠে বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। সংকটকালীন সময়ে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও সুকান্তের কবিতা মুক্তিযোদ্ধাদের সীমাহীন প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধিকারের আকাক্সক্ষায় মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়কাল থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর কবিতা রচিত হয়েছে সমকালীন কবিদের দেশপ্রেমের শাণিত লেখনীর শব্দশৈলীতে। এসব কবিতায় যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং বাঙালির দুর্জয় সাহসের বীরত্ব গাথা চিত্রিত হয়েছে অনুপম দ্রোহ সাহসের পঙক্তিমালায়। পরাধীনতা ও শোষণের গ্লানি মোচনের স্পর্ধিত উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কবিতার শরীরে। অন্তর্জীবনে সমর্পিত কবি শামসুর রাহমানের সন্ত্রাসবন্দী বুলেটবিদ্ধ দিনরাত্রি কবিতায় অসাধারণ কাব্য নৈপুণ্যে বর্ণিত হয়েছে হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা – কখনো নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে, /মনে হয় ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই। /দিন-দুপুরেই জীপে একজন তরুণকে কানামাছি করে নিয়ে যায় ওরা, /মনে হয় চোখ-বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভ‚মিতে। বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর হৃদয়ের গভীর থেকে তুলে আনে পঙক্তিমালা কবি শামসুর রাহমান এর কবিতায় -তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা কবিতায় এই কবি জেগেছেন পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে এবং অকপটে উচ্চারণ করেছেন কঠিন সত্য -তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে/ আর কতকাল ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়? /আর কতকাল দেখতে হবে খান্ডবদাহন? /..রাইফেল কাঁধে বনে-জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো/ সেই তেজী তরুণ যার পদভারে একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে-/ সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।/ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত/ ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে/ নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিদ্বিদিক এই বাংলায়/তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।
স্বাধীনতার জন্য আকুল অপেক্ষা, প্রজন্মপ্রহর আর অর্থনৈতিক স্থিতি-অস্থিতির কালযাপনের ক্লান্তি শামসুর রাহমান অনুভব করেন ক‚ন্য থালা হাতে পথের ধারে বসে-থাকা হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরীর উপলব্ধির গাঢ়তায়। কবি বাঙালি জাতির মনন-চেতনাকে এঁকেছেন এভাবে : তোমার জন্যে,/ সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,/ কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,/ মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,/ গাজী গাজী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে/ রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস/ এখন পোকার দখলে/ আর রাইফেল কাঁধে বনে-জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো / সেই তেজী তরুণ যার পদভারে/ একটি নতুন পৃথিবী জন্ম হতে চলেছে-/ সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা। প্রত্যাশিত স্বাধীনতার উপমা, ব্যঞ্জনা কবিতার ছন্দে উদ্ধৃত হয়েছে রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান আর নজরুলের সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা সৃজন-ব্যাকুলতায়। তিনি স্বাধীনতা দেখেছেন আপন অভিব্যক্তির সাবলীল দৃষ্টিভঙ্গিতে- স্বাধীনতা তুমি/ বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর/ শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।/ স্বাধীনতা তুমি/ চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ। … স্বাধীনতা তুমি/ গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,/হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।/ স্বাধীনতা তুমি/ খোকার গায়ে রঙিন কোর্তা,/ খুকীর অমন তুলতুলে গালে/ রৌদ্রের খেলা। শামসুর রাহমান কাব্যিক দ্যোতনায় স্বপ্ন বুনেছেন স্বাধীন দেশের উর্বর মাটিতে এবং নির্মাণ করতে চেয়েছেন অফুরান শান্তির কথামালায় স্বাধীনতার আখ্যান। কবি শামসর রাহমান অনাকাক্সিক্ষত দুঃশাসন, অবরুদ্ধ জীবনের আর্তিময় দহন কাল , জাতির বিপর্যয়, বোধ আর ভাবনার মিশেলে মানবিক – উর্বর ভ‚মিতে গড়েছেন কবিতা সৃজনের ক্ষেত্র । অন্যদিকে অগ্রজের পদচিহ্ন কবিতায় কবি আতাউর রহমান লিখেছেন : অগ্রজের রক্তাক্ত পদচিহ্ন ধরে/ আমি এগিয়ে চললাম গভীর অন্ধকার ছিন্ন করে/ আমি সূর্যোদয়কে সম্ভব করলাম। হেলাল হাফিজের-এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় /এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। মুক্তিযুদ্ধের নারকীয়তা কবিতার শরীরে পেয়েছে অনন্যমাত্রা । অন্তর্গত কবিতায় সৈয়দ শামসুল হক উদ্ধৃত করেছেন সেই কথা -হঠাৎ স্তব্ধতা বিদর্ঢু হয়ে যাবার একটি শব্দ আমরা/ শুনতে পাই।/ হঠাৎ চব্বিশটি রক্তাক্ত দেহ-রমণী, শিশু, যুবক, প্রৌঢ়-/আমরা দেখতে পাই এক মুহূর্তের জন্যে,/ রক্তাক্ত এবং লুণ্ঠিত, /দ্বিতীয়বার আর নয়, /রক্তাক্ত, লুণ্ঠিত এবং প্রাণহীন-/দেয়ালের পায়ের কাছে চত্বরে তারা শুয়ে আছে।
কবি সৈয়দ শামসুল হক ও তাঁর কবিতার পঙক্তিতে ফুটিয়ে তুলেছেন রণাঙ্গনের গেরিলা যোদ্ধাকে-অবিরাম/ দক্ষিণ ভিয়েতনাম/ কম্বোডিয়া/ বাংলাদেশ/ অ্যাংগোলায়/ মোজাম্বিকে তুমি/ নিসর্গের ভেতর দিয়ে সতর্ক নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে যাও সারাদিন সারারাত….
কবি নির্মলেন্দু গুণ স্বাধীনতাকে জননীর নাভীমূল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা উলঙ্গ শিশুরূপে আখ্যায়িত করেছেন। দেশের স্বাধীনতা যখন বস্ত্রহীন তখন কে না চায় ঔ বস্ত্রহীন শিশুটি তার শরীরে পোষাক পরিধান করিয়ে সভ্যতার আলোয় অস্তিত্বের জানান দিতে। কবির এই যে স্বাধীনতাকে উলঙ্গ সন্তানের ন্যায় পোষাক পরিয়ে দেয়ার মতো সুন্দর উপমায় রূপায়িত করা, যা অতুলনীয়। স্বদেশের অস্তিত্বের সন্ধান করেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ এভাবে জননীর নাভীমূল ক্ষতচিহ্ন রেখে/ যে তুমি উলঙ্গ শিশু রাজপথে বেরিয়ে এসেছো/ হে আমার দুঃখ স্বাধীনতা তুমি পোষাক পরো/ স্বাধীনতা তুমি দীর্ঘজীবী হও, বেঁচে থাকো/ আমার অস্তিত্বে, স্বপ্নে। কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে মনে করেছেন। তাঁর কবিতার মধ্যে ইতিহাস চেতনা মূর্ত হয়ে ধরা দেয়। নির্মলেন্দু গুণ জাতির জনকের এ ভাষণকে কবিতা বলেছেন, বলেছেন অমর কবিতা-কখন আসবে কবি? /কখন আসবে কবি? /শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে / অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। /তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, /হৃদয়ে লাগিল দোলা /জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা- /কে রোধে তাঁহার বজকণ্ঠ বাণী? /গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতা খানি: /এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম /এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিদের লেখা কবিতাগুলোয় কবিরা সমকালকে ধারণ করে বৈপ্লবিক চেতনা, নতুন মূল্যবোধ, নতুন স্বপ্নের চিত্র এঁকেছেন শব্দের তুলিতে ।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর মাগো ওরা বলে কবিতাটি এখনো ধ্বনিত হয় বাংলার আনাচে কানাচে। কবিতালগ্ন কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সারাজীবন অনুভবে খুঁজে বেরিয়েছেন প্রসন্ন-উর্বর মাটি, দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন উদার চোখ, ক‚ন্যবৃত্তের গভীরে সঙ্গীতময়তা, বৃক্ষ-মৃত্তিকা-কৃষক-শস্য-ভালোবাসার বর্ণাঢ্য অভয়-অরণ্য। কবির অনুভব -পাখিরা বসতে পারে এমন কোনো বৃক্ষ নেই/ জোনাকি লুকাতে পারে এমন কোনো গুল্ম নেই/ সূর্য শীতল হবে এমন কোনো নদী নেই/ এবং আমার বিচিত্র শব্দাবলী বিবর্ণ/ বৈশাখের শিলাপাতে আহত শস্যের মতো বিচ‚র্ণ/ যুবকের বুকে ভালোবাসার মতো আগ্নেয়াস্ত্র/ এক টুকরো খামারের জন্য,/ মেয়েরা শেফালির ঝুড়িতে আগুন চেপে ঘুরে বেড়ায়/ অথচ ওরা মা হতে পারতো/ এবং আমার চিৎকার মাটির ক‚ন্যতায়-/ যে সাহসী সে যুদ্ধে গেছে/ যারা যুদ্ধে যায় তারা ফিরে আসে না। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর এই কবিতায় মা মাটির ঐতিহ্য আর মর্যাদা ফিরে পাবার আহাজারি -প্রার্থনা অন্তর্লীন ভাবনায় উচকিত । প্রকৃত অর্থে, কবি স্বাধীনতাকেই আহব্বান করেছেন অগণন উন্মুখ মানুষের নীরব কাতারে দাঁড়িয়ে। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প কবিতায় যন্ত্রণাময় বিশাল এক অধ্যায়ের বর্ণনা করেছেন মাত্র কয়েকটি লাইনে। বাতাসে লাশের গন্ধ পাই কবিতাটিতে “জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ সেই পুরোনো শকুন” অতীত বিস্মৃতির ভেতর যেন বর্তমান যোগসূত্র স্থাপন করে শিল্পের ভেতর মূর্ত হয়েছে দ্রোহ এবং দেশপ্রেম। মুক্তিযুদ্ধের সেই ঘৃণা, ক্ষোভ, দহনের ভেতর পুড়ে যাচ্ছে কবি ও পাঠকের জীবনদৃষ্টি…আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই, /আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি, /ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে-/এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়? / … রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে,/ সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা/ স্বাধীনতা সে আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন/ স্বাধীনতা সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল/ ধর্ষিতা বোনের শাড়ি এ আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা। কবির এ বোধ বাঙালি জাতিকে এক প্রবল প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়।
মগ্নচৈতন্যে নিবিষ্ট আবুল হাসান কবিতার সৃজন আলোর পথে স্বাধীনতার পতাকায় দেখতে থাকেন চেনা মানুষের মুখ, মুখের প্রতিচ্ছবি – আপনজন হারানোর যন্ত্রণাদগ্ধ বিবর্ণ অনুভব- তবে কি আমার ভাই আজ/ ঐ স্বাধীন পতাকা?/ তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদিতে উৎসব? (উচ্চারণগুলো শোকের) কবি চিরন্তন আবেগ উত্থিত শাব্দিক ব্যঞ্জনায় বুকের গভীরে একটি স্বদেশ রেখে কবিতার জমিন অনাবাদী না রাখার প্রত্যয়ে স্থিত থাকেন। দেশমাতার প্রতি তার প্রাণিত আহব্বান – উদিত দুঃখের দেশ, হে কবিতা হে দুধভাত তুমি ফিরে এসো!/… সবুজ দীঘির ঘন শিহরণ? হলুদ শটির বন? রমণীর রোদে/দেয়া শাড়ি? তুমি কি দ্যাখোনি আমাদের/ আত্মহুতিদানের যোগ্য কাল! তুমি কি পাওনি টের/ আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া চোখের কোণায় তুমি কি বোঝোনি আমাদের/ হারানোর, সব হারানোর দুঃখ- শোক? তুমি কি শোনোনি ভালোবাসা/ আজও দুঃখ পেয়ে বলে, ভালো আছো হে দুরাশা, হে নীল আশা? (উদিত দুঃখের দেশ) স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে কবি হেলাল হাফিজ কবিতায় স্বাধীনতাকে এঁকেছেন নিজস্বতায় – এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। কবিতায় স্বাধীনতাকে কবি জসীম উদ্দীন প্রকাশ করেছেন অনন্যতায়- আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, মৃত্যু পেছনে আগে, / ভয়াল বিশাল নখর মেলিয়ে দিবস রজনী জাগে।/ কখনো সে ধরে রেজাকার বেশ, কখনো সে খান-সেনা, / কখনো সে ধরে ধর্ম লেবাস পশ্চিম হতে কেনা। কবিতায় কবি শহীদ কাদরী স্বাধীনতাকে রূপায়িত করেছেন এক তন্ময় বালকের সৃষ্টির বিন্যস্ততায়- মধ্য দুপুরে, ধ্বংসস্ত‚পের মধ্যে, একটা তন্ময় বালক/ বাঁশ, লোহা, টুকরো ইট, বিদর্ঢু কড়ি-কাঠ, একফালি টিন, /ছেঁড়া চট, জং ধরা পেরেক জড়ো করলো এক নিপুণ/ ঐন্দ্রজালিকের মতো যত/ এবং অসতর্ক হাতে কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই/ প্রায় অন্যমনস্কভাবে তৈরি করলো কয়েকটা অক্ষর/ স্বাধীনতা। কবি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেছেন- কবিতায় আর কী লিখব? /যখন বুকের রক্তে লিখেছি/ একটি নাম/ বাংলাদেশ। কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ তাঁর স্বাধীনতা ওগো স্বাধীনতা কবিতায় সে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করেছেন ক্লান্ত, দারুণ ক্লান্ত আমি-আরো কতবার মরব স্বাধীনতা/ ওগো স্বাধীনতা, তোমার জন্য গুলিতে গুলিতে জর্জরিত/ আমার মুখ/উৎপাটিত আমার চোখ এবং একটি একটি করে/ ত‚র্যে নিয়েছে / আর কতদাম দিতে হবে বল? বল বল/ দাও দাও / দাও তোমার উত্তর।
কবিদের কাব্য সৃজনের স্রোতধারা এতই বেগবান ছিল জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মাহমুদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী প্রমুখ যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর জীবনসমগ্রতার বাস্তবতাকে বিচিত্রভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁদের কবিতায় । জসীম উদ্দীনের মুক্তিযোদ্ধা, সুফিয়া কামালের উদাত্ত বাংলা, আহসান হাবীবের স্বাধীনতা, হাসান হাফিজুর রহমানের তোমার আপন পতাকা,আবু জাফর ওবায়দুল্লার আমি কিংবদন্তির কথা বলছি, হুমায়ুন আজাদের মুক্তিবাহনীর জন্যে, আবিদ আজাদের এখন যে কবিতাটি লিখব আমি শিরোনামে কবিতার মতো অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কবিতা রয়েছে যা পাঠ করে পাঠককুল নিজেদের চেতনাকে শাণিত করার মাধ্যমে জেগে ওঠে দেশের বিপন্ন সময়ে । কবি রফিক আজাদের নেবে স্বাধীনতা, কবি খালেদা এদিব চৌধুরীর চিরকাল স্বাধীনতা, স্বাধীনতা কোমল পাথর,কবি হায়াৎ সাইফের স্বাধীনতা, কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজীর প্রিয় স্বাধীনতা, কবি কামাল চৌধুরীর সেই মুখখানি স্বাধীনতা প্রিয় ছিল, কবি মিনার মনসুরের প্রিয় স্বাধীনতা, কবি আলী জহিরের স্বাধীনতার অমর জ্যোতি, কবি জাহিদ মোস্তফার স্বাধীনতা প্রাণের অধিক ইত্যাদি কবিতাগুলো মূলত স্বাধীনতা ও দেশ নিয়ে লেখা কবিতা। প্রার্থিত স্বাধীনতাকে একেক জন কবি একেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন কিন্তু এখানে সর্বত্রই স্বদেশ প্রেমের তপ্ত আবেগ পরিস্ফুটিত। কবিতায় স্বাধীনতা কিংবা স্বাধীনতার কবিতা যেভাবেই লিপিবদ্ধ হোক না কেন তা শিল্পিত উচ্চারণে ও বর্ণিল শোভায় আমাদের ঐতিহ্য- ইতিহাস , চেতনা, সংগ্রামকে ধারণ করে নিপুণ শক্তিতে। কালের পরিক্রমায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম এর তাৎপর্য কবিরা অনুভব করেছেন আপন আপন বোধে ও প্রতিভার আলোয় এবং প্রকাশ করেছেন হৃদয়ের উৎসারিত সৃজনশৈলী দিয়ে। যা বাংলা সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ এবং স্বাধীনতাকে করেছে অর্থপূর্ণ ।