কবিতার সংজ্ঞায় কবিদের ভাবনা

603

কবিতা সাহিত্যের আদিমতম একটি শাখা। ধারণা করা হয়, যখন পৃথিবীর মানুষের কোন অক্ষর জ্ঞান ছিল না, তখনো মানুষের মুখে কবিতা ছিল। কবিতা বিভিন্ন কালে বিভিন্ন রূপে এসেছে। কবিতার ভিন্ন ভিন্ন রূপ গুলোই আজ কবিতার বিভিন্ন শাখায় পরিণত হয়েছে। এই কবিতা নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। বলা হয়, প্রায় সবার হৃদয়ে একটি কবি সত্তা বসবাস করে। মানুষ তার মনের ভেতরের যে কোন ভাব, চিন্তা ভাবনা, আবেগ ও অনুভূতি গুলো যখন ছন্দোবদ্ধ আকারে প্রকাশ করে, তখনই সেটা হয়ে উঠে কবিতা। তবে এটা কবিতার কোন সংজ্ঞা নয়। আজ পর্যন্ত কোন কবি কবিতার কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে পারেন নাই। কবিতা নিয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত কবিগণ কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নিজ নিজ ভাবনা গুলো প্রকাশ করেছেন মাত্র। সেই ভাবনা গুলো থেকেই আমরা কবিতার সংজ্ঞা খোঁজে বের করার চেষ্টা করি।

বিশ্ববিখ্যাত গ্রীক কবি ও দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়ো।” এখানে তিনি কবিতার মাধ্যমে মানুষের সুগভীর ভাবনার প্রকাশ ও এর বিশালতার কথাই বলেছেন। কবিতা নিয়ে উনার ভাবনার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি কিন্তু কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচ্য নয়।

উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান কবি পার্সি বিশি শেলি কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, কবিতা পরিতৃপ্তির বিষয়। কবিতা তখনই স্বার্থক হয়, যখন কবি মনের পরিতৃপ্তিতে পূর্ণতা আসে।” তার ভাষায় বুঝানো হচ্ছে, কবিতা হলো মানুষের পরিতৃপ্তির বিষয়। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মূহুর্তের বিবরণ হচ্ছে কবিতা। শেলীর এই বক্তব্যের সাথে অনেকেই সহমত প্রকাশ করেছেন এবং এটি বেশ গ্রহণযোগ্য। তবে কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে পরিপূর্ণ নয়।

ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম রোমান্টিক কবি জন কীটস বলেছেন, কবিতা মুগ্ধ করবে তার সু² অপরিমেয়তায়, একটি মাত্র ঝংকারে নয়। পাঠকের মনে হবে এ যেন তারই সর্বোত্তম চিন্তা যা ক্রমশ ভেসে উঠছে তার স্মৃতিতে।” জন কীটস আরো অধিক বিস্তৃত ভাবে কবিতা সম্পর্কে উনার ভাবনার প্রকাশ করেছেন। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, শুধুমাত্র ছন্দে ও অন্ত্যমিলে কোন কিছু লিখলেই সেটা কবিতা হবে না। কবিতা পাঠকের হৃদয়ে দাগ কাটবে এবং নিজের ভাবনা গুলো কবিতায় খোঁজে পাবে। কবিতা নিয়ে কীটসের এই বক্তব্য অর্থবহ হলেও গ্রহণযোগ্যতা তুলনামূলক কম। কবিতার এই সংজ্ঞাটি কিছুটা বিতর্কিত। তবে উনার ধারণাটি কবি সমাজে বেশ প্রচলিত। তাই অনেক কবিগণ কীটসের সাথে সুর মিলিয়ে বলে থাকেন, ছন্দ মিলিয়ে কোন কিছু লিখলেই সেটা কবিতা হয় না।

নিজ নিজ ভাবনা থেকে এভাবে কবিতা নিয়ে পৃথিবী বিখ্যাত কবিগণ বিভিন্ন ভাবে কবিতার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। যেমন, কবি মেকল বলছেন, কবিতা বললে আমরা বুঝি সেই শিল্প, যা শব্দকে ব্যবহার করে এমন ভাবে, যা কল্পনার রাজ্যে জাগিয়ে দেয় এক স্বপ্ন।” কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, কবিতা হলো পারফরমেনস ইন ওয়ার্ডস। কবি কোলরিজ বলেছেন, গদ্য মানে শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো। আর পদ্য মানে সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো।” কবি এডগার এলান বলেছেন, কবিতা হলো সৌন্দর্যের ছন্দোময় সৃষ্টি।” কবি এলিয়ট বলেছেন, কবিতা রচনা হলো রক্তকে কালিতে রূপান্তর করার যন্ত্রনা। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, কবিতা সমস্ত জ্ঞানের শ্বাস-প্রশ্বাস আর সূক্ষ আত্না ।” কবি কার্লাইল বলেছেন, কবিতা হলো মিউজিক্যাল থট। কবিতা নিয়ে এই বিখ্যাত কবিদের ভাবনা গুলো খুব সুন্দর ও গ্রহণযোগ্যতা আছে। তবে কারো বক্তব্য কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।

কবিতা নিয়ে আরো দুজন বিদেশি বিখ্যাত কবি চমত্কার দুটি সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। কবি সেন্ট অগাস্টিন কবিতা সম্পর্কে উনার ভাবনা থেকে বলেছেন, যদি জিজ্ঞাসা করা না হয়, আমি জানি। যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি জানি না। এখানে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, কবিতা কি, সেটা আমরা জানি। যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন কবিতার সংজ্ঞা দেওয়া মুশকিল। মনে হবে, কবিতা একটা রহস্যময়, অজানা কিছু, যা আমরা জানিনা। আর কবি জনসন বলেছেন, কবিতা হলো মেট্রিক্যাল কম্পোজিশন। আনন্দ এবং সত্যকে মেলাবার শিল্প। যেখানে রিজনকে কে সাহায্য করার জন্যে ইমাজিনেশন এর ডাক পড়ে। এখানে উনার বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কবিতা হচ্ছে এমনি এক শিল্প, যা দিয়ে আনন্দের সাথে সত্যকে প্রকাশ করা হয়। আর সেটা প্রকাশ করার জন্য কল্পনার প্রয়োজন হয়। কবিতা বিষয়ক এই দুটি বক্তব্য থেকে কবিতার গভীরতা ও বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, তবে কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে স্পষ্ট নয়। অনেকেই আবার স্বীকার করেন, পয়েট্রি ইজ ইমিটিশন অব লাইফ, ক্রিটিসিজম অব লাইফ, মিরর অব লাইফ”। এটাও কবিতার পরিপূর্ণ সংজ্ঞা নয়, শুধুমাত্র কবিতা সম্পর্কিত একটি ধারণা হিসেবে বিবেচ্য করা যায়।

বিদেশি বিখ্যাত কবিদের পাশাপাশি আমাদের বিখ্যাত বাঙালি কবিগণও কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নিজেদের ধারণা প্রকাশ করেছেন। উনাদের দেওয়া কবিতার ধারণা থেকেও আমরা কবিতার সংজ্ঞা সম্পর্কে জানতে পারবো। কবি হুমায়ুন আজাদের মতে, যা পুরোপুরি বুঝে উঠবো না, বুকে ওষ্ঠে হৃৎপিন্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাবো না, যা আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও, রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে, তার নাম কবিতা।” উনার দেওয়া সংজ্ঞাটি বেশ জটিল এবং তিনি এর কোন পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করেন নাই। তবে সুগভীর চিন্তা ভাবনা ও উপলব্ধি করলে সহজেই বোধগম্য।

কবি সিকান্দার আবু জাফর বলেছেন, আমি কবিতা লিখি অনায়াসে । যেমন সকলেরই ক্ষেত্রে জীবনের আশে-পাশে অসংখ্য সুলভ দূর্লভ মূহুর্ত নানা রূপে অনাবৃত হয়েছে আমার সামনে। আমি কোন কোন সময় সেই সব মূহুর্তের স্বাক্ষর লিপিবদ্ধ করেছি সত্য-বিচ্যুতি না ঘটিয়ে। সেই আমার কবিতা।” এটি খুব অর্থপূর্ণ একটি সংজ্ঞা এবং সহজেই বোধগম্য। এই আলোচনা থেকে বুঝতে পারি, আমার চোখের সামনে যা কিছু দেখি এবং অনুভব ও কল্পনা করে যা সৃষ্টি হয় তাই কবিতা।

কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, কবিতা বোঝার বিষয় নয়, এটাকে অনুভব করতে হয়। কারণ কবি সম্ভবত বুঝেসুঝে কবিতা লেখেন না, কেবল মাত্র বিষয়কে সামনে রেখে তাকে অনুভব করেই কবিতার জন্ম হয়।” কবিতা নিয়ে তিনি খুব সহজ একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। এখানে তিনি কবিতাকে খুব সহজ করে উপস্থাপন করেছেন। উনার সংজ্ঞায় বুঝা যায়, কবিতা জটিল কিছু নয়। মানুষের মনের আবেগ ও অনুভূতির কাব্যিক প্রকাশ হলো কবিতা।

কবি সৈয়দ শামসুল হকের মতে, কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ। সর্বোত্তম ভাবের সাথে সর্বোত্তম শব্দের সংযোগই পারে সর্বোত্তম কবিতা সৃষ্টি করতে। এই সংজ্ঞাটি অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্যতা আছে। পৃথিবীর কিছু বিখ্যাত কবিদের দেওয়া সংজ্ঞার সাথে উনার এই সংজ্ঞার কিছু মিল পাওয়া যায়।

কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, যে লেখাটি সমকালের স্মৃতি বা স্বপ্নকে তুলে আনতে সক্ষম এবং একই সাথে সমকালকে অতিক্রমের যোগ্যতা রাখে, তাকেই বোধহয় কবিতা বলা যেতে পারে।” তিনি কিছুটা শংসয় নিয়ে কবিতার সংজ্ঞাটি দিয়েছেন। তবে উনার দেওয়া সংজ্ঞা বেশ স্বতন্ত্র ও অর্থবহ। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, কবিতা সমকালকে তুলে ধরতে সক্ষম এবং ভবিষ্যতের ভাবনায় বিচরণ করতে পারে।

বিখ্যাত কবিদের দেওয়া কবিতার সংজ্ঞা থেকে আমরা কবিতার কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা খোঁজে বের করতে পারবো না কিন্তু উপলব্ধি করতে পারবো। কবিতা আসলেই বুঝার মতো খুব বেশি কিছু নেই, কবিতা শুধুই উপলব্ধি করার বিষয়। কবিতা উপলব্ধি করতে পারলেই কবিতার জন্ম দেওয়া যায়। আমার মতে, কবিতা অনেকটাই আসমানী কিতাবের ন্যায় ঈশ্বর প্রদত্ত দান। যাহা কবির মননে আসে এবং সুগভীর চিন্তা ভাবনার পর সুসজ্জিত ও অলংকৃত শব্দ বিন্যাস এবং কাব্যিক ছন্দ বিন্যস্ত কিছু বাক্যের মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ হয়।” এটা একান্তই আমার নিজস্ব ধারণা, তবে এতে কারো ভিন্ন মত থাকতেই পারে এবং এটাই স্বাভাবিক।

যারা কবিতা লিখেন, আমরা তাদের কবি বলি। আবার এটা নিয়েও বিতর্ক আছে কারণ অনেকেই বলেন কবিতার মতন অন্ত্যমিলে কিছু লিখলেই সেটা কবিতা হয় না। তাই সবাইকে কবি বলা যাবে না। যারা কবিতা লিখেন, তাদের কাছে প্রশ্ন রাখা হলেও কবিতার কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে পারেন না। এর কারণ হচ্ছে কবিতাকে কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায় বেঁধে রাখা যায় না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে কবিতা আমাদের সামনে এসেছে। ভবিষ্যতেও আরো বিভিন্ন রূপে আমাদের সামনে আসবে। কবিতাকে কোন নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে রাখা যায়নি, যদিও কবিতা লেখায় অনেক নিয়মনীতি আছে। কবিতার বিভিন্ন রূপের জন্য বিভিন্ন নিয়মনীতি থাকবে কিন্তু কবিতা থাকবে চিরকাল উন্মুক্ত। কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায় কবিতাকে কখনো আবদ্ধ করা যাবে না।