কথিত ‘বড় ভাইয়ের’ শেল্টারে খুন চুরি ডাকাতি ছিনতাই

68

নগরীতে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশতাধিক গ্যাং রয়েছে। তাদের হাতে আছে ছুরি, কিরিচ, চাপাতিসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র। সবাই ইয়াবাসক্ত। বেশিরভাগের বয়স ১৮। স্কুল ও এলাকাভিত্তিক অবস্থান তাদের। এসব কিশোর খুন, চুরি, ডাকাতি, মাদক ব্যবসা, ছিনতাইসহ সবধরনের অপরাধে জড়িত। তাদের হাতে গত দেড় বছরে খুন হয়েছে ১০ জন। বুধবার রাতে মাদারবাড়ি থেকে ৫ কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা কয়েকশ’ চুরি-ডাকাতিতে জড়িত বলে স্বীকার করেছে। কথিত ‘বড় ভাইয়ের’ শেল্টারে তারা অপরাধ কর্মকান্ড চালায়।
এ ধরনের একটি গ্যাংয়ের সন্ধান পেয়েছে ডবলমুরিং থানা পুলিশ। একটি হত্যাকান্ডের তদন্ত করতে গিয়েই তাদের সন্ধান পায়। এ হত্যাকান্ডে জড়িত সাত কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হত্যাকান্ডের কথাও স্বীকার করেছে। তারা বলেছে, জেলে আটক ‘বড় ভাই ’ ছগিরের নির্দেশে মফিজকে খুন করতে গিয়ে ভুলে রাজুকে খুন করে। গ্রেপ্তারকৃতরা খুন, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপকর্মে জড়িত বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।
এদিকে গত ১০ মে মুরাদপুরে সহপাঠীকে গালমন্দ করায় ক্ষুব্ধ হয়ে মোস্তাক আহমদ নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে কিশোর দল। এ দলের সাতজনকে গ্রেপ্তার করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। তাদের চার জনের বয়স ১৮, বাকি তিন জনের ১৬ ও ১৭। বড় ভাই তুহিনের নির্দেশে এ হত্যাকান্ড বলে তারা আদালতে জবানবন্দি দেয়।
এর আগে এপ্রিল মাসে মাদারবাড়ি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয় ৫ কিশোর। তারা হলো, মো. বাদশা, মো. রাসেল, নুর উদ্দিন, জাকির হোসেন ও মো. সোহেল। তাদের কাছ থেকে অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। তারা চুরি-ডাকাতির সাথে জড়িত বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। এ পর্যন্ত তাদের গ্যাং দু’শরও বেশি চুরি-ডাকাতি করেছে।
আগ্রাবাদ হাজীপাড়ায় সাতজন এবং পাঁচলাইশের সাতজনের মধ্যে চারজনের বয়স ১৮। এর আগে মাদারবাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ৫ জনের সকলের বয়সই ১৮।
গত বছরের গোড়ার দিকে জামালখানে ছুরিকাঘাতে খুন হয় কলেজিয়েট স্কুলের মেধাবি ছাত্র আদনান ইসফার (১৫)। তারপরই বেরিয়ে আসতে থাকে কিশোর গ্যাংয়ের কাহিনী। ওই হত্যাকান্ডের পর গ্রেপ্তার হয় আরমান, সাব্বির, মুনতাসির, মহিম ও আবু সাঈদ। তারা সকলে কিশোর। গ্রেপ্তারকৃতরা খুনের কথা স্বীকারও করে। তাদের বয়সও ১৬ থেকে ১৮ এর মধ্যে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নগরীতে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাং। প্রতিটি গ্যাংয়ে রয়েছে ৫ থেকে ১০ জন কিশোর। এলাকাভিত্তিক অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত তারা। এহেন অপরাধ নেই যা তারা করছে না। তাদের ছত্রছায়ায় রয়েছে রাজনৈতিক দলের শীর্ষ গডফাদার ও বড় ভাইয়েরা।
পুলিশ জানায়, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই কাজে লিপ্ত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দিনের বেলায় কৌশলে বিভিন্ন ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যায়। সেখানে টার্গেট করে ফিরে আসে। রাতে ইয়াবা সেবনের পর অস্ত্র নিয়ে চুরি-ডাকাতি করতে বের হয়। ৭ থেকে ১০ জন মিলে চুরির ঘটনা ঘটায়। এদের একজন গ্রিল কাটে, দুজন ভেতরে প্রবেশ করে এবং বাকিরা অস্ত্র নিয়ে পাহারা দেয়।
নগরীর ঘাটফরহাদবেদ, স্টেশন রোড, বিআরটিসি মোড়, কদমতলী, চকবাজার, মেডিকেল হোস্টেল, শিল্পকলা একাডেমি, সিআরবি, খুলশি, ফয়’স লেক, ডেবারপার, চান্দগাঁও শমসের পাড়া, ফরিদের পাড়া, আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনি, সিডিএ, ছোটপুল, হালিশহর, বন্দর কলোনি ও পতেঙ্গায় এলাকাভিত্তিক গ্যাং গড়ে উঠেছে।
সিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার (্ক্রাইম ও অপারেশন) আমেনা বেগম বলেন, কিশোররা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। খুন, ছিনতাইসহ সবধরনের অপকর্মই করছে। এলাকার বড় ভাইদের নির্দেশনায় অপরাধ করে যাচ্ছে তারা। তিনি বলেন, এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাং রোধে পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। অপরাধে জড়িত কিশোররা ছাড়াও তাদের বড় ভাইদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তিনি এ ব্যাপারে বাবা মাকেও সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রিকশাচালক রাজু হত্যায় জড়িত সাতজনই কিশোর। তাদের সকলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এসব কিশোরদের বেশিরভাগের বয়স ১৮ বা ১৮ ছুঁই ছুঁই।
জানা যায়, কিশোর গ্যাংগুলো সবচেয়ে বেশি ছিনতাই করে মোবাইল। কোনো কিশোর এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় থামায়। আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুর সাথে কথা বলার অজুহাতে ফোন চায়। এরপরই সেটা নিয়ে কেটে পড়ে। বাধা দিলে ছুরি মেরে দেয়। ঘাটফরহাদবেগ খুলফাপট্টির মুখে দাঁড়িয়ে থাকে এধরনের ৬/৭ জন কিশোর। তারা প্রতিনিয়ত মোবাইল ছিনতাই করে নিয়ে যায়।
সূত্র জানায়, এসব কিশোর সেবন করছে ইয়াবা ও ফেনসিডিলসহ নানা মাদকদ্রব্য। আধিপত্য বিস্তারে এদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে অবৈধ অস্ত্রও। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়া কিশোরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানও। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো- রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ছত্রছায়ায় এসব কিশোরদের ব্যবহার হচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে সামাজিক ও পারিবারিক অনুশাসনের অভাবে কিশোররা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে।
সিএমপি সূত্রে জানা যায়, কিশোর গ্যাংয়ের হাতে দেড় বছরে খুন হয়েছে ১০ জন। এরমধ্যে ৮ জনই কিশোর। মূলত আধিপত্য বিস্তার নিয়েই তারা খুন হয়। গত বছরের জুন মাসেই খুন হয় ৪ জন। হালিশহর, পতেঙ্গা, এ কে খান গেট ও বায়েজিদে এসব খুনের ঘটনা ঘটে। আধিপত্য বিস্তার নিয়েই খুন হয় এ চারজন। এছাড়া চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, মুরাদপুর, পাঁচলাইশ এলাকায় খুন হয় আরো তিন কিশোর।
বর্তমানে এ গ্যাং ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে তাদের আকার। বড় ভাইদের শেল্টারেই তারা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, কিশোর গ্যাং আমাদের জন্য নতুন এক যন্ত্রণা। এলাকাভিত্তিক তাদের অবস্থান। এসব কিশোর নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। খুন করতেও দ্বিধা করছে না। ইয়াবাসক্ত হয়ে বা টাকার লোভে তারা বিপথগামী হচ্ছে। কথিত বড় ভাইয়েরা তাদের বিপথে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা এসব বড় ভাইদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছি।