কথার জাদুকর

25

বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ। গত ১৩ নভেম্বর ছিল ক্ষণজন্মা এই জননন্দিত সাহিত্যিকের ৭২তম জন্মদিন। স্বাধীনতা- উত্তর বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক তিনি। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্রকার, গীতিকার, গল্পকার, চিত্রকর, নাট্যকারসহ আরও অনেক কিছু। কলাম লেখক হিসেবে ও কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যেও তাঁর খ্যাতি ছিল। ১৯৭২ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হলে হুমায়ূন আহমেদের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি বাংলার পাঠক সমাজকে কথার জাদুতে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন। পাঠক তৈরির কারিগর ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সব বয়সী পাঠকরাই তাঁর লেখার ভীষণ ভক্ত ছিল। আশির দশকে তিনি জনপ্রিয় কলাম লেখকদের একজন ছিলেন। সাপ্তাহিক ঢাকা পত্রিকায় তিনি তখন কলাম লিখতেন। যদিও এই লেখাসমূহ অগ্রন্থিত রয়ে গেছে।
বৈচিত্র্যময় লেখার মাধ্যমে লেখক হুমায়ূন আহমেদ সহজ-সরল রচনা আর রসবোধ দিয়ে পাঠককে অনায়সে কাছে টেনেছেন। মাটি ও মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতে পেরেছিলেন বলেই তিনি পাঠকসমাজকে এত বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি উপহার দিতে পেরেছিলেন। কী চলচ্চিত্রে, কী নাটকে, কী উপন্যাসে, কী গল্পে সৃজনশীল লেখার মাধ্যমে সবখানেই ছিল তার ধারাবাহিক সাফল্য। তিনি অনেক কঠিন কথা সহজভাবে ও সহজ কথা কঠিনভাবে গল্পে তুলে আনতেন। কত কৌশলী ও হৃদয়গ্রাহী করে যে তিনি গল্প বলতে পারতেন তা অতুলনীয়। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প ও ছোটগল্পসমূহ পাঠককূলে ব্যাপক প্রশংসা পায়। হুমায়ূন আহমেদ চরিত্র রূপায়ণে অতি দক্ষ শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর চরিত্রগুলো পাঠক মহলে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। হিমু, মিসির আলী, বাকের ভাই, রূপা ও শুভ্র চরিত্রগুলো এখনো ব্যাপক জনপ্রিয়। কোনো যুক্তি ও বিচার-বুদ্ধির তোয়াক্কা না করে উদ্ভট সব কর্মকান্ডই ‘হিমু’ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। অপরদিকে হিমুর বিপরীত চরিত্র ‘মিসির আলী’। যুক্তিবাদী ‘মিসির আলী’ যুক্তির বাইরে এক পাও হাঁটেন না। মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত মিসির আলী অতিপ্রাকৃত ঘটনা তো বিশ^াসই করেন না! ‘শুভ্র’ চরিত্রটি একজন পরিপূর্ণ মানবের প্রতিচ্ছবি হিসেবে সে সময় খ্যাতি পেয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের নাটকে সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘বাকের ভাই’ চরিত্রটি। অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদের অসম্ভব রূপবতী মেয়ে চরিত্র ‘রূপা’। এমনসব ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রায়ণের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ পাঠক ও টেলিভিশন দর্শকদের আনন্দে ভাসিয়েছেন। টিভি নাটকেও হুমায়ূন আহমেদের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ছিল। ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘আজ রবিবার’, ‘কোথাও কেউ নেই’ ও ‘বহুব্রীহি’ ব্যাপক দর্শকনন্দিত নাটক। চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যাপক মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন সবার প্রিয় এই লেখক। তিনি সর্বমোট আটটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এসব চলচ্চিত্রের কাহিনী তৈরি, চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও প্রযোজনাও তিনি করেছেন। চলচ্চিত্রসমূহের বেশিরভাগ গান তাঁরই লেখা। তাঁর প্রথম সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। তাঁর আটটি চলচ্চিত্রই সে সময় ব্যবসাসফল ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- ‘আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা’, ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’, ‘যদি মন কাঁদে’, ‘বরষার প্রথম দিনে’, ‘আমার আছে জল’, ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে তিনি দর্শকের মনে নতুন আঙ্গিকে জায়গা করে নিয়েছেন। ‘আগুণের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্র দর্শকদের মন থেকে কখনো মুছে যাবে না। হুমায়ূন আহমেদের লেখায় অসংখ্য জনপ্রিয় কথা বা উক্তি আছে, যা পাঠকদের কাছে প্রবাদতুল্য। এমন শত শত উক্তির মধ্যে জনপ্রিয় একটি উক্তি হলো- ‘ভালোবাসা একটা পাখি। যখন খাঁচায় থাকে তখন মানুষ তাকে মুক্ত করে দিতে চায়। আর যখন খোলা আকাশে তাকে ডানা ঝাপটাতে দেখে তখন খাঁচায় বন্দী করতে চায়।’ ঢাকার অদূরে হুমায়ূন আহমেদ গড়ে তোলেন ‘নুহাশ পল্লী’। প্রতিবছরই এই নুহাশ পল্লীতে প্রিয় লেখকের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁকে স্মরণ করে হুমায়ূন ভক্তরা। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখনীর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে যে লক্ষ-কোটি পাঠক তৈরি করে গেছেন তা সমগ্র বাংলা সাহিত্যের জন্যই ভালোই হয়েছে। সবমিলিয়ে বাংলা সাহিত্যে এক আধুনিক ধারা তৈরি করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন আহমেদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, লোকজন আগ্রহ নিয়ে আমার বই পড়ছে, এটাই আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি।’ এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, লক্ষ লক্ষ তরুণ তাঁর লেখা পড়ে বই পড়ায় আগ্রহী হয়েছে। সৃজনশীল কর্মকান্ডের স্বীকৃতি হিসেবে জনপ্রিয় এ লেখক পেয়েছেন দেশি-বিদেশি অসংখ্য পুরস্কার। এসব পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (একাধিকবার), শিশু একাডেমি পুরস্কার ইত্যাদি। ২০১২ সালে এই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও তাঁর লেখনীর মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। বাংলা সাহিত্য যতদিন টিকে থাকবে প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদও ঠিক ততদিন টিকে থাকবেন সবার হৃদয়ে।