কক্সবাজার সৈকতে নির্জনতায় প্রাণ পেয়েছে প্রকৃতি

95

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের প্রকৃতি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। করোনাভাইরাসে ভ্রমণ নিষিদ্ধ থাকায় বেশ কিছুদিন ধরে এখানে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। জনশূন্য সৈকতে নির্জনতার সুবাদে জেগে উঠেছে প্রকৃতি। বালিয়াড়িতে ঝাঁকে ঝাঁকে বিচরণ করছে লাল কাঁকড়া, ডালপালা মেলতে শুরু করেছে সাগরলতা। লোকালয়ের কাছে এসেই ডিগবাজিতে মেতেছে একদল ডলফিন। সৈকতে প্রকৃতির এমন পরিবর্তনকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন পরিবেশবিদরা।
সাধারণত প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখর থাকে সৈকত। তবে পর্যটনের বিকাশে প্রকৃতি ও পরিবেশ কতটা বিনষ্ট হয়েছে তা টের পাওয়া যাচ্ছে এখন। দালান নির্মাণ, যত্রতত্র বর্জ্য ফেলাসহ বিভিন্ন কারণে জীববৈচিত্র্য হারাতে বসেছিল। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়লেও একদিক দিয়ে পরিবেশের জন্য তা ইতিবাচক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সৈকতজুড়ে গোলাপি-অতিবেগুণি রঙের ফুলে ভরা সাগরলতা জন্মেছে। পরিবেশবিদ ও সাংবাদিক বিশ্বজিত সেন বাঞ্চুর কথায়, ‘একদশক আগে এমন সৌন্দর্যময় পরিবেশ ছিল। গত দশ বছরে প্রকৃতির এমন রূপ দেখা যায়নি এখানে। যদিও এগুলোই কক্সবাজার ভ্রমণে পর্যটকদের কাছে ছিল অন্যরকম আকর্ষণ। কিন্তু মানুষের অবাধ বিচরণের কারণে সাগরলতা হারিয়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি ক্ষতি হয়েছে বালিয়াড়ির।’
প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতো বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে বলে মনে করেন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সৈকতে নির্জন পরিবেশ পেয়ে সাগরলতা জন্মেছে, ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরতে শুরু করেছে লাল কাঁকড়া। সৈকত জুড়ে লাল কাঁকড়ার আনাগোনা ও কচ্ছপের বিচরণের মাধ্যমে যেন ফিরে এসেছে একদশক আগের চিত্র। কিছুদিন আগে ডলফিনের একটি দল সমুদ্রতীরের কাছাকাছি এসে সময় কাটিয়েছে। প্রকৃতি টিকিয়ে রাখতে হলে এমন নির্জনতা প্রয়োজন। এতে করে সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি পাবে।’
স্থানীয় সাংবাদিক আহমদ গিয়াসের মতে, ‘পরিবেশবিদ্যায় বালিয়াড়িকে উপকূলের রক্ষাকবচ আর সাগরলতাকে বালিয়াড়ি তৈরির কারিগর ভাবা হয়। সাগরে ঝড়-তুফান বা ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ¡াস ঠেকিয়ে উপকূলকে রক্ষা করে বালিয়াড়ি। আর মাটির ক্ষয়রোধসহ শুকনো উড়ন্ত বালুরাশিকে আটকে বালিয়াড়ি সাজায় সাগরলতা। তাই বলা যায়, সৈকতের পরিবেশ পুনরুদ্ধারে সাগরলতার ভূমিকা অপরিসীম।’ বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বায়োলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ মুহাম্মদ শরীফ জানান, সমুদ্র সৈকতের নোনা জলে বেঁচে থাকে অসংখ্য জলজ উদ্ভিদ। সাগরের তলদেশ ছাড়াও বেলাভূমিতে জন্মায় এগুলো। এর মধ্যে সাগরলতা অন্যতম।
ডলফিন প্রসঙ্গে এই গবেষকের মন্তব্য, ‘বঙ্গোপসাগরে এই প্রাণীর উপস্থিতি খুব কমসংখ্যক। এর মধ্যে দুটি ডলফিন পরিবার কক্সবাজারের সোনাদিয়া ও মহেশখালীর কাছাকাছি অবস্থান করে থাকে। সাগরে মূলত তারা দলবেঁধে চলাফেরা করে। বর্তমানে চ্যানেলগুলোতে প্রতিনিয়ত তাদের দেখা মেলে। ডলফিন নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ করে, তাই এখন জনমানবহীন নির্জনতায় সাগরতীরের কাছাকাছি চলে আসে তারা।’
এদিকে শুক্রবার (৩ এপ্রিল) নতুনভাবে জেগে ওঠা সৈকতের প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন। তার চোখে, বালিয়াড়ির ওপর সাগরলতা দূর থেকে দেখতে অনেকটা সবুজ গালিচার মতো লাগে। ডিসি’র উপলব্ধি, ‘প্রকৃতিকে বাধাগ্রস্ত না করে নির্বিঘেœ বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া হলে তারা কত দারুণ পরিবেশ দিতে পারে সাগরলতা ইতোমধ্যে তা প্রমাণ করেছে।’
জেলা প্রশাসক আশ্বাস দিয়েছেন, কক্সবাজার শহরের দরিয়ানগর থেকে দক্ষিণে এক কিলোমিটার পর্যন্ত সৈকতকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে সাগরলতার বনায়ন করা হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা ও এর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বালিয়াড়ির পেছনের অংশে সৃজন করা হবে নারিকেল বাগান।